আলমগীর খান

  ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

তৃণমূলে স্বাস্থ্যসেবা

তৃণমূলপর্যায়ে গ্রামের সব সাধারণ মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার ত্রুটি ও চিকিৎসাব্যবস্থার কর্মকর্তাদের আমলাতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে সব সাধারণ মানুষ সে ব্যবস্থার সুফল একইভাবে নিতে পারছে না। হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মানসিক ব্যবধান রয়েছে। এ ছাড়া চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত লাভের আকাক্সক্ষার ফলেও চিকিৎসাব্যবস্থার সুফল সবাই সমানভাবে পায় না, সবচেয়ে বঞ্চিত হয় নিরক্ষর দরিদ্র মানুষ। এ সংকটের মধ্য দিয়েই প্রাইভেট ক্লিনিক ও চিকিৎসাব্যবস্থা প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। যেগুলোর মূল উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন। যার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই অসহায় নিরক্ষর দরিদ্র মানুষ। এ ধরনের পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য প্রয়োজন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে তার দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া ও সেইসঙ্গে রোগপ্রতিরোধমূলক চিকিৎসাব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যসচেতনতা। তবে এই প্রয়োজনটি বোঝা যত সহজ, এটি বাস্তবায়নের সঠিক কৌশল নির্ণয় করে তা অবলম্বন করা তার চেয়ে অনেক কঠিন।

যেকোনো সেবা তৃণমূলে পৌঁছে দেওয়ার একটি ব্যবস্থাপনা খরচ বা ম্যানেজমেন্ট কসট্ আছে, যা সাধারণত বেশ বড়ই হয়। মানে খাজনার চেয়ে বাজনা খরচই অনেক সময় বেশি হয়ে পড়ে। বিভিন্ন প্রকল্পের বেলায় এরূপ ঘটনা ঘটে। তবে যদি একটি মূল প্রকল্পের কাঁধে উঠিয়ে কিছু আনুষঙ্গিক সেবা-প্রকল্প চালানো যায়, তা কম ব্যয়ে সম্ভব। সে ক্ষেত্রে উন্নয়ন বা সেবা-প্রকল্প টেকসই হতে পারে। তৃণমূল পর্যায়ে এনজিওদের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক আছে। এই নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে কিছু সেবা প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব। অর্থাৎ একটি কার্যক্রমের ঘাড়ে চড়ে আরো কিছু সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব উল্লেখযোগ্য বাড়তি খরচ ছাড়াই। সহজ করে বললে, ধরা যাক ঢাকা থেকে কোনো গাড়ি যাত্রী নিয়ে নিয়মিত কোনো একটি প্রত্যন্ত এলাকায় যায়। বাড়তি খরচ ছাড়াই ওই গাড়িতে কিছু জরুরি ওষুধপত্র বা শিক্ষা-উপকরণ ওই প্রত্যন্ত এলাকায় নিয়মিত পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। এ হলো কারো ঘাড়ে চড়ে বা পিগিব্যাক কৌশলে যাওয়া। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রামপর্যায়ে দরিদ্র মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে একটি বেসরকারি উন্নয়নসংস্থা এরূপ একটি কর্মকৌশল গ্রহণ করেছে ও তা সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করছে। সিদীপের এ উদ্যোগ ইতোমধ্যে গ্রামাঞ্চলে জনপ্রিয়তা পেয়েছে ও এর ফলে স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্ত মানুষের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। ২০১৩ সাল থেকে এ কর্মসূচি চললেও এটি শুরু করতে গিয়ে সংস্থাকে হোঁচট খেতে হয়েছে। এ কর্মসূচির জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনা কৌশল ও কর্মপদ্ধতি নির্ধারণের পূর্ব পর্যন্ত এটি সফল হয়ে ওঠেনি। দরিদ্র মানুষের কাছে স্বল্প খরচে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছার কারণে সংস্থা সঠিক কর্মকৌশল উদ্ভাবনে ও কর্মসূচি প্রচলনে সক্ষম হয়, যার ফলে বর্তমানে এটি একটি স্বনির্ভর কর্মসূচি, অর্থাৎ এমন একটি বড় আয়তনের কর্মসূচি, যেখানে ব্যয়কে আয় থেকে নির্বাহ করা সম্ভব হচ্ছে। প্রান্তিক দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কল্যাণের জন্য গৃহীত অনেক সামাজিক কর্মসূচি এ রকম প্রাথমিক সংকটের মুখে পড়তে পারে, কিন্তু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সঠিক কর্মকৌশল নির্ধারিত হয়। সিদীপের স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচির বেলায়ও তাই ঘটেছে এবং সঠিক কৌশল খুঁজে পাওয়ার ফলে বর্তমানে এটি সংস্থার লক্ষ্য অনুযায়ী ব্যাপক মানুষের কাছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে সহজলভ্য করতে পেরেছে।

প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কুটি ও ধরখারে শুরু হয়ে বর্তমানে এ স্বাস্থ্য কর্মসূচিটি গ্রামপর্যায়ে সংস্থার ৭৭টি শাখা কার্যালয়ে চালু রয়েছে। উদ্দেশ্য, দেশের প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া এবং সুস্থ-সবল জনগোষ্ঠী তৈরিতে ভূমিকা রাখা। সংস্থাটির কর্ম-এলাকাগুলোয় একজন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (এসএসিএসও) প্রতিদিন সকালে মাঠপর্যায়ে গিয়ে মোবাইল ক্লিনিক পরিচালনার মাধ্যমে এবং দুপুরের পর সংস্থার স্থানীয় অফিসের নিজস্ব চেম্বারে অবস্থান করে সর্বসাধারণকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করেন। পাশাপাশি উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা/বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মাধ্যমে সুবিধাজনক স্থানে মাসে ১-২টি স্যাটেলাইট ক্লিনিক বা স্বাস্থ্য ক্যাম্প করা হয়।

সিদীপ স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচির এই সঠিক কর্মকৌশল ও পদ্ধতি কী এবং কীভাবে এই কর্মসূচিকে আরো সফল ও টেকসই করার মাধ্যমে আরো ব্যাপক সংখ্যক গ্রামীণ দরিদ্র মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া যায় তা অনুসন্ধান করে দেখার প্রয়োজন অনুভব হয়। এ প্রয়োজন থেকে বিষয়টি নিয়ে একটি কোয়ালিটেটিভ গবেষণা পরিচালনা করেন উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ শাহজাহান ভূঁইয়া। Piggyback Social Marketing Strategy for Health Program শীর্ষক এ গবেষণা প্রতিবেদনটি সিদীপ এ বছর মার্চে পুস্তকাকারে প্রকাশ করেছে। কর্মসূচিটিতে সংস্থার কোনো ঋণগ্রহীতা সদস্য বার্ষিক ২০০ টাকা মূল্যের বিনিময়ে একটি স্বাস্থ্যকার্ড ক্রয় করতে পারেন। এই কার্ড থাকলে ওই সদস্যের পুরো পরিবার সংস্থার নিয়োগপ্রাপ্ত উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের কাছ থেকে সারা বছর চিকিৎসাসেবা নিতে পারে। গড়ে কোনো পরিবারের মোট সদস্য পাঁচজন হলে প্রতিদিন খরচ হবে প্রত্যেকের জন্য দিনে মাত্র ১১ পয়সা। অবশ্য রক্ত পরীক্ষা, গর্ভধারণ পরীক্ষা, রক্তে শর্করার মাত্রা নির্ণয়, রে থেরাপি, নেবুলাইজেশন ইত্যাদির জন্য বাড়তি টাকা দিতে হয়। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এনে যখন কোনো ক্যাম্প করে চিকিৎসা করা হয়, তখন সদস্যরা বিনা খরচে ও অন্যরা কিছু অর্থের বিনিময়ে এ সেবা গ্রহণ করে থাকেন।

গবেষক তার গভীর তাত্ত্বিক জ্ঞান ও দীর্ঘ উন্নয়ন-অভিজ্ঞতার আলোকে এ স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচিটির বিশেষত্ব এবং শক্তি ও দুর্বলতার দিকসমূহ তুলে ধরেছেন। McKinsy’s 7S Model, æCore Design” School Model of Strategy Formation I 4Ps of Marketing Mix এই ৩টি ধারণা-কাঠামোর আলোকে তিনি সিদীপের স্বাস্থ্য কর্মসূচির বিচার-বিশ্লেষণ করে এর প্রায়োগিকতা নির্ণয় করেছেন। কর্মসূচিটিকে আরো দরিদ্রবান্ধব ও টেকসই করার জন্য এ প্রতিবেদনটি উল্লেখযোগ্যভাবে সহায়তা করবে। এ কর্মসূচির সাফল্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দিক এর স্বল্প খরচ ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে সরাসরি মানুষের দোরগোড়ায় যাওয়া। কিন্তু তা যে সম্ভব হয়েছে তার কারণ গ্রামপর্যায়ে সংস্থাটির শাখা কার্যালয়। কর্মসূচিতে নিয়োজিত এসএসিএমও এ শাখা কার্যালয়ে অবস্থান করে চিকিৎসাসেবাটি দিয়ে থাকেন। একেবারে দরিদ্র মানুষের কাছে থাকা ও যাওয়ার জন্য এটি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে। আবার সংস্থার মূল কার্যক্রম ক্ষুদ্রঋণের পাশে থেকে একই এলাকায় প্রায় একই মানুষের মাঝে এ সেবাকার্যটি চালানোর জন্য কর্মসূচিতে কোনো বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে না। মূল কার্যক্রমের নেটওয়ার্ক ও শক্তির ওপর ভর করে এটি চলতে পারছে। এগুলো হচ্ছে এই কর্মসূচির বৈশিষ্ট্য ও সাফল্যের কারণ। অন্যান্য সংস্থাও এ ধরনের কর্মকৌশল অবলম্বন করে দেখতে পারে। যাতে স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন সেবা সহজে তৃণমূলে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, শিক্ষালোক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close