নিতাই চন্দ্র রায়

  ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

টার্কি

প্রাণিজ আমিষের গুরুত্বপূর্ণ উৎস

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে টার্কির চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে এর উৎপাদন। দেশের বিভিন্ন স্থানে উৎসাহী উদ্যোক্তারা টার্কি পালনের দিকে ঝুঁকছেন। গড়ে তুলছেন ছোট-বড় খামার এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা নিচ্ছেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদফতর থেকে। নতুন এই পাখিটির বাসস্থান, খাদ্যপানি ব্যস্থাপনা, রোগ-বালাই দমন, মাংস প্রক্রিয়াকরণ, বাজারজাতকরণ এবং রফতানি প্রক্রিয়া-সংক্রান্ত ব্যাপারে নতুন উদ্যোক্তাদের তেমন কোনো বাস্তব ধারণা নেই। নেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ। অল্প সময়ে অধিক লাভের আশায় গ্রামগঞ্জের সাহসী যুবকরা টার্কি পালনের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে বিনিয়োগ করছে লাখ লাখ টাকা। টার্কির ডিম ও মাংস সুস্বাদু খাবার। টার্কি পালনে উৎসাহিত করতে খামারিদের ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আশির দশকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পোলট্রি খামারে ব্যবহারিক ক্লাসে শকুন সদৃশ্য এই বিশাল আকৃতির পাখিটির সাথে প্রথম পরিচয় হয়। এটি যে একদিন বাংলাদেশের খামারে ও বাড়িঘরে হাঁস-মুরগির মতো লালিত-পালিত হবে। প্রতি কেজি টার্কি বিক্রি হবে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় এ কথা তখন ভাবতেও পারিনি।

ইউরোপীয়রা সর্বপ্রথম আমেরিকায় টার্কি দেখতে পায়। তখন তারা পাখিটিকে এক ধরনের গিনিয়া মুরগি বলে মনে করতেন। পরবর্তী সময়ে তারা তুরস্ক থেকে মধ্য ইউরোপে পাখিটিকে নিয়ে আসেন এবং তুরস্কের নামানুসারে পাখিটির নামকরণ করেন টার্কি। উত্তর আমেরিকায় টার্কি সর্বপ্রথম গৃহপালিত পাখি হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বর্তমানে ইউরোপসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এই পাখিটি কম-বেশি পালন করা হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের কাছে টার্কির মাংস বেশ জনপ্রিয়। টার্কি এখন প্রাণিজ প্রোটিনের চাহিদা মিটিয়ে অর্থনীতিতেও রাখছে ব্যাপক অবদান। টার্কির মাংসে বেশি প্রোটিন ও কম চর্বি থাকে এবং অন্যান্য পাখির মাংসের চেয়ে এটির মাংস অধিক পুষ্টিকর। টার্কির মাংসে অধিক পরিমাণে জিংক, আয়রন, পটাশিয়াম ও ফসফরাস থাকে। এই উপাদানগুলো মানবদেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী এবং নিয়মিত টার্কির মাংস খেলে কোলেস্টেরলের পরিমাণ হ্রাস পায়। এ ছাড়া টার্কির মাংসে অধিক পরিমাণে এমাইনো এসিড ও ট্রিপটোফেন থাকায় এটি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। টার্কির মাংসে অধিক পরিমাণে ভিটামিন ই থাকে। এসব কারণে পশ্চিমা দেশগুলো টার্কির মাংস ভীষণ জনপ্রিয়। পৃথিবীর দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টার্কি পালন করা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড ও ব্রাজিলে। আশার কথা বাংলাদেশেও এখন ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্বল্প পরিসরে টার্কি পালন শুরু হয়েছে। তৈরী হচ্ছে ছোট ও মাঝারি আকারের অনেক খামার। কেউ কেউ শখ করে দেশি মুরগির মতো মুক্ত পরিবেশে বসতবাড়িতে ৪-৫টি করে টার্কি পালন করছেন। ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবাদে বেকার যুবক-যুবতীদের অনেকে টার্কি পালনে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। কিছু কিছু খামার থেকে টার্কির মাংস বিদেশে রফতানি করার প্রচেষ্টাও চালানো হচ্ছে। আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে টার্কির মাংস রফতানি দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

বিভিন্ন কারণে দেশে টার্কি পালন দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। কারণগুলো : ১. টার্কি দেশি মুরগির মতো ঝামেলাহীনভাবে সহজে প্রতিপালন করা যায়। ২. টার্কি পালনে তুলনামূলকভাবে খরচ কম, লাভ বেশি। কারণ, এটি দানাদার খাবারের পাশাপাশি শাক, ঘাস, লতাপাতা খেতেও পছন্দ করে। ৩. টার্কি ব্রয়লার মুরগির চেয়েও দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ৪. টার্কি দেখতে খুব সুন্দর এবং এর উপস্থিতি বাড়ির সৌন্দর্যবর্ধনে সহায়তা করে।

একটি স্ত্রী টার্কি ৩০ সপ্তাহ বয়স থেকে ডিম পাড়া শুরু করে। প্রয়োজনীয় আলো-বাতাস, পরিষ্কার পানি এবং খাবার সরবরাহ করা হলে একটি স্ত্রী টার্কি বছরে ৮০ থেকে ১০০টি ডিম পাড়ে। ডিমের আকার আমাদের দেশের হাঁসের ডিমের মতো। তবে প্রতিটি ডিমে ৮ থেকে ১৫টি ছোট ছোট বাদামি বর্ণের দাগ থাকে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে ২৮ দিন সময় লাগে। টার্কি নিজেই ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা উৎপাদন করতে পারে। তবে দেশি মুরগি অথবা ইনকিউবেটর দিয়ে ডিম ফোটালে ভালো ফল পাওয়া যায়। ২০ সপ্তাহে একটি পুরুষ পাখির গড় ওজন হয় ৬ থেকে ৭ কেজি এবং স্ত্রী পাখির গড় ওজন হয় ৩ থেকে ৪ কেজি। ১৪ থেকে ১৫ সপ্তাহ বয়স হলো পুরুষ পাখির বাজারজাতকরণের সঠিক সময়। আর স্ত্রী পাখির ক্ষেত্রে তা হলো ১৭ থেকে ১৮ সপ্তাহ।

লাভজনকভাবে প্রতিপালনের জন্য টার্কির বাসস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। মুক্ত ও আবদ্ধ উভয় অবস্থাতেই টার্কি পালন করা যায়। তবে টার্কি পালনের জন্য টিন, ছন, খড়ের ছাদ দেওয়া ঘর বা কংক্রিটের দালানই উপযুক্ত জায়গা। বাড়িতে বা খামারে টার্কি পালনের জন্য মোট খাবারের ৫০ ভাগ সবুজ ঘাস ও শাক (পালং, সরিষা, কলমি, হেলেঞ্চা ও বাঁধাকপি) ব্যবহার করা যাবে। একটি পূর্ণবয়স্ক টার্কির জন্য দিনে ১৪০ থেকে ১৫০ গ্রাম খাবারের দরকার হয়। এ ছাড়া ব্রয়লার বা লেয়ার মুরগির খাবারও এরা খেয়ে থাকে। শাকে অনেক সময় কীটনাশক থাকে। তাই শাক দেওয়ার আগে এগুলো এক ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখার পর কেটে খাওয়াতে হবে। অন্যান্য পাখির তুলনায় টার্কির জন্য বেশি ভিটামিন, আমিষ ও খনিজ পদার্থ দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই মাটিতে খাবার সরবরাহ করা যাবে না। সব সময় টার্কিকে পরিষ্কার পানি দিতে হবে। টার্কির একটি আদর্শ খাবারে ধান ২০ শতাংশ, গম ২০ শতাংশ, ভুট্টা ২৫ শতাংশ, সয়াবিন মিল ১০ শতাংশ, ঘাসের বীজ ৮ শতাংশ, সূর্যমুখীর বীজ ১০ শতাংশ ও ঝিনুকের গুঁড়া ৭ শতাংশ থাকা উচিত। সময়মতো রোগবালাই দমনের জন্য টিকা প্রদান টার্কি পালনে পূর্ব শর্ত। আমাদের দেশে টার্কিতে সাধারণত পক্স, সালমোনেলেসিস, রানিক্ষেত, মাইটস ও এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রভৃতি রোগ দেখা যায়। এসব রোগ প্রতিরোধের জন্য টার্কিকে নিয়মমতো টিকা প্রদান করতে হবে। তবে রোগাক্রান্ত পাখিকে কোনো মতেই টিকা দেওয়া চলবে না। এ ছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ টিকাও পাখিকে কোনো অবস্থাতেই প্রয়োগ করা যাবে না। অন্যদিকে নিয়মমাফিক পরিচ্ছন্ন খাবার ও সঠিক খামার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অনেক রোগবলাইয়ের আক্রমণ থেকে টার্কিকে রক্ষা করা সম্ভব।

টার্কির মাংস পুষ্টিকর ও সুস্বাদু হওয়ায় এটি আমাদের খাদ্য তালিকায় একটি আদর্শ আমিষ জাতীয় খাদ্য হতে পারে। পাশাপাশি দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাংসের চাহিদা পূরণেও এটি রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যারা ডায়াবেটিক ও হৃদরোগে ভোগছেন অথবা যারা খাসি/গরুর মাংস খান না, তাদের জন্য টার্কির মাংস হতে পারে একটি প্রিয় বিকল্প। তা ছাড়া বিয়ে-শাদি, বৌ-ভাত, গায়ে-হলুদ, আকিকা, বনভোজন, জন্মদিনের মতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে টার্কির মাংস হতে পারে খাসি/গরুর মাংসের উত্তম বিকল্প। এতে খরচও তুলনামূলকভাবে কম হবে এবং খাবারও হবে মজাদার।

বাণিজ্যিক খামার করে মাংস উৎপাদন করলে ১৪ থেকে ১৫ সপ্তাহের একটি টার্কির গড় ওজন পাওয়া যাবে ৫ থেকে ৬ কেজি। এতে ৪০০ টাকা কেজি দরে একটি টার্কির বিক্রয় মূল্য দাঁড়ায় ২০০০ থেকে ২৪০০ টাকা। একটি টার্কির ১৪ থেকে ১৫ সপ্তাহ পালন করতে সর্বোচ্চ খরচ হবে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা। সে হিসেবে একটি টার্কি থেকে কমপক্ষে ৫০০ টাকা লাভ করা যায় সহজেই, যা অন্য পাখি পালনের মাধ্যমে সম্ভব নয়। বর্তমানের ছোট আকারের খামার করার যে চাহিদা দেশব্যাপী তৈরি হয়েছে, তাতে আগামী ৩-৪ বছরে কয়েক লাখ টার্কির প্রয়োজন হবে এবং সে ক্ষেত্রে দামও বেশি পাওয়া যাবে। এখন ১০০ টাকা দামে প্রতিটি টার্কির ডিম এবং ২০০ থেকে ২৫০ টাকা দামে একদিন বয়সী টার্কির প্রতিটি বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ টার্কির মাংস রফতানি করে তাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ব্রাজিল ২০১৫ সালে ১ লাখ ৩২ হাজার ৯০০ টন টার্কির মাংস রফতানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশি মুদ্রা উপার্জন করে।

দেশে ও বিদেশে রফতানির জন্য সরকারি উদ্যোগে টার্কির বাজার সৃষ্টি হলেই টার্কি পালন একটি লাভজনক খাত হিসেবে বিবেচিত হবে। হাঁস, মুরগি ও কবুতরের মতো দেশে এখনো টার্কির মাংস বিক্রির উপযুক্ত বাজার ও চাহিদা সৃষ্টি হয়নি। টার্কির জন্য প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিনও সহজলভ্য নয় এবং পাখিটি পালনের ব্যাপারে খামারিদের প্রশিক্ষণেরও যতেষ্ট অভাব রয়েছে। এসব সমস্যার সমাধান হলে গ্রামীণ ও নগর অর্থনীতিতে টার্কি পালন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এতে অনেক বেকারের কর্মসংস্থান এবং দারিদ্র্যবিমোচনের পথও প্রশস্ত হবে। হবে মাংস রফতানির এক নতুন দিগন্তের সূচনা।

লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close