আবদুল আউয়াল

  ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

নিবন্ধ

রবীন্দ্রসাহিত্যে নিম্ন-মধ্যবিত্ত

বাংলাসাহিত্যে মধ্যযুগ অস্ত যাওয়ার পর যে রেনেসাঁ যুগের সূচনা হয়, তার অন্যতম পুরোহিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মূলত মাইকেল ও বঙ্কিমচন্দ্র যুগের পরপরই রবীন্দ্রযুগের আগমন। বলা যায়, রবীন্দ্রসাহিত্য সত্যিকার অর্র্থেই উজ্জ্বল রবির মতোই আলোকিত করেছে বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি অঙ্গন। যার কিরণ ছড়িয়ে পড়েছে পূূর্র্ব থেকে পশ্চিমে। বাঙালি সমাজচিত্র সর্বজনীনভাবে বিশ্ববাসীর কাছে সাহিত্যরূপে পরিবেশন করার প্রথম প্রবাদ পুরুষ ধরা যায় রবীঠাকুরকে।

রবীন্দ্রনাথের পিতামহ ছিলেন শ্রী দ্বারকানাথ ঠাকুর। যিনি একাধারে একজন সফল ব্যবসায়ী ও সমাজসচেতন পুরুষ। লন্ডনে বিলাসবহুল জীবনযাপনকারী দ্বারকানাথ ঠাকুর পেয়েছিলেন ‘প্রিন্স’ উপাধি। তারই ছেলে মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সর্বকনিষ্ঠ ছেলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথম জীবনের প্রায় ত্রিশ বছর পার করেছেন তৎকালীন কলকাতা শহরে সমস্ত নাগরিক সুবিধায়। কলকাতার সম্ভ্রান্ত জোড়াসাঁকুর ঠাকুর পরিবারে জন্ম নিলেও কবির বিচরণ, পর্যবেক্ষণ ও পদচারণ ছিল বাঙালি সমাজের প্রতিটি স্তরে। জাত, ধর্ম-বর্ণ, কুল-বিত্ত নির্বিশেষে সবাই পেয়েছে রবীন্দ্রসাহিত্যে স্থান যথার্থভাবে। রবীন্দ্রসাহিত্য বাংলা সাহিত্যে যে নবজাগরণ (রেনেসাঁ) যুগের সূচনা করেছে, তাকে ইউরোপীয় রেনেসাঁ থেকে কোনো অংশে কম বলা যায় না। সেখানে শেকসপিয়র যেভাবে অমর সৃষ্টির মাধ্যমে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত ও সহস্র বছর এগিয়ে নিয়ে গেছেন, তেমনি রবীঠাকুর তার বিশাল সৃষ্টিভা-ার দিয়ে বাঙলা ভাষাকে করেছেন সমৃদ্ধ ও প্রসারিত। এ বিষয়ে রবীন্দনাথ নিজেই জবানবন্দি দেন এভাবে, ‘বাংলা গদ্য আমার নিজেকেই গড়তে হয়েছে। ভাষা ছিল না, পর্বে পর্বে স্তরে স্তরে তৈরি করতে হয়েছে আমাকে। (প্রবাসী, আষাঢ়, ১৩৪৮)’।

এ কথা স্বীকার্য, বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ, গতিশীল করার লক্ষ্যে প্রথম বিশ্বসাহিত্যের কাছে হাত পাতেন মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, যিনি পশ্চিমা সাহিত্যের ঢং-এ, রূপে আর উপকরণে বাংলা সাহিত্যকে করতে চেয়েছিলেন বিশ্বসাহিত্যে গ্রহণযোগ্য। তারই উত্তরসূরি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ আরো ব্যাপকভাবে সুযোগ পেয়েছিলেন বিশ্ব-সাহিত্য আন্দোলন ও ধারার সঙ্গে পরিচিত হতে। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে ইউরোপীয় সাহিত্যে যে নতুন ধারা তৈরি হয়, তারই নাম ‘রোমান্টিসিজম’। সাহিত্যের পৃথিবীতে আসে নতুন রূপ, সাধারণ মানুষকে নিয়ে সাহিত্য, সাধারণ মানুষের ভাষায় সাহিত্য, অতঃপর সাধারণ মানুষের জন্য সাহিত্য, (খরঃবৎধঃঁৎব ভড়ৎ পড়সসড়হ ঢ়বড়ঢ়ষব)। ফলে সে সময় সাহিত্য আকাশে ধ্রুব তারার মতো জন্ম নিলেন উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, এস টি কোলরিজ, শেলী, বায়রন, কীটসের মতো জ্বলন্ত সাহিত্য প্রতিভারা। ইউরোপীয় সাহিত্যিকরা রোমান্টিসিজমের মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিলেন এবং বুঝিয়ে দিয়েছিলেন নিম্ন মধ্যবিত্ত সিংহভাগ মানুষকে বাদ দিয়ে উচ্চবিত্ত সমাজের অর্চনা কখনোই অমর সাহিত্য সৃষ্টি হতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিচিত ছিলেন ইউরোপীয় রোমান্টিসিজমের সঙ্গে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুবাদও করেছেন বেশ কিছু রোমান্টিক কবিদের কবিতা। এ কথা অনুভব করা অসাধ্য ছিল না বাঙলা সমাজে সাহিত্য রচনার উপকরণ অধিকাংশ নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানবসমাজ ব্যতিরেকে সম্ভব নয়। রবীঠাকুরের কলমে সফলভাবে প্রকাশ পেয়েছে পূর্ব ও পশ্চিম বাঙলার নি¤œ মধ্যবিত্ত পেশাজীবী মানুষ, তাদের সংগ্রাম, টিকে থাকা, জীবনযাত্রা, হাসি-কান্না ইত্যাদি। এ কথা সত্য, রবীন্দ্র সময়ে এ বিতর্ক ছিল যে রবীন্দ্রসাহিত্য শুধু উচ্চবিত্তদের জীবনকে চিত্রায়ণ করে মাত্র, মধ্যবিত্তরা এতে ঠাঁই পায় না। রবীন্দ্রনাথ নিজেই এর প্রতিবাদ করে কিছুটা তীক্ষèভাবে বলেন, ‘আমার রচনায় যারা মধ্যবিত্ততার সন্ধান করে পাননি বলে নালিশ করেন তাদের কাছে আমার একটা কৈফিয়ত দেওয়ার সময় এলো। একসময় মাসের পর মাস আমি পল্লী জীবনের গল্প রচনা করে এসেছি, আমার বিশ্বাস এর পূর্বে বাংলা সাহিত্যে পল্লী জীবনের চিত্র এমন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হয়নি।’ (চৈত্র, ১৩৪৭)। ১৮৯০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন জমিদারির কাজে নিয়োজিত ছিলেন, তখন তিনি খুব কাছ থেকে পরিচিত হতে পেরেছিলেন পূর্ব বাঙলার দরিদ্র, নিম্নবিত্ত , মধ্যবিত্ত সমাজের সাথে ধর্ম-বর্ণ জাত নির্বিশেষে। থাকতে হয়েছে কুষ্টিয়ার শিলাইদাহ, নওগাঁর আত্রাই আর সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে। হতদরিদ্র কৃষকসমাজের জীবন সংগ্রাম কবিকে করেছে ব্যথিত। কবি তৈরি করেছেন কৃষকদের জন্য সমবায় সমিতি, চাষাবাদের আধুনিকায়নের জন্য নিয়ে আসেন ট্রাক্টর। ব্যক্তিগতভাবে রবীন্দ্রনাথ ইউরোপীয় রোমান্টিক ধারার কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের সুপাঠক ছিলেন। তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে বলতে হয়, ওয়ার্ডসওয়ার্থ শিল্পবিপ্লবের সময়েও যেমনি তুলে ধরেছেন পল্লীর নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন (ঞযব ঝড়ষরঃধৎু জবধঢ়বৎ, ঞরহঃবৎহ অননবু ইত্যাদি কবিতা উল্লেখযোগ্য), রবীন্দ্রনাথও তেমনি ব্রিটিশ নগরায়ণের সময় ভুলে যাননি পল্লীর নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনচিত্র। পল্লী জীবন পর্যবেক্ষণে সফল উদাহরণ হিসেবে ধরা যায় তার ছোট গল্পসমূহকে। ‘ছুটি’ (পৌষ, ১২৯৯) গল্পে তিনি এঁকেছেন গ্রামের দুরন্ত কিশোর ফটিকের পল্লীর দুরন্ত জীবন, পল্লীর বিদ্যালয়, শিক্ষাচিত্র। পল্লী বালকদের শিক্ষার জন্য চাই উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা। রবীন্দ্রনাথ তার সাহিত্যকর্মে এ বিষয়ে যেভাবে সচেতন ছিলেন, তেমনি সচেষ্ট ছিলেন তার সমাজকর্মে। তাই তো কলকাতা শহর থেকে বহুদূরে পল্লী মায়ের আঁচল ঘেরা গ্রাম বোলপুরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় (২৩ ডিসেম্বর, ১৯২১)’ (শান্তিনিকেতন), ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য তৈরি করলেন ‘আশ্রম’। নিজেই সেখানে পাঠদান করিয়েছেন আমৃত্যু। শ্রদ্ধার সঙ্গে বলতে হয়, পল্লীমায়ের আঁচলে রেখে পল্লী ছাত্রদের সুশিক্ষিত করার এমন উদাহরণ বিশ্বের অন্য কোনো সাহিত্যিক দেখাতে পারেননি। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত নগরজীবনের টানাপড়েনও কবির নজর কাড়ে যথার্থভাবে। ‘বাঁশি’ (২৫ আষাঢ়, ১৩৩৯) কবিতায় কবি চিত্রায়িত করেন হরিপদ কেরানির নগর জীবন সংগ্রাম। পঁচিশ টাকা বেতনের কেরানি কেরোসিনের পয়সা বাঁচানোর জন্য সন্ধ্যা কাটায় শেয়ালদা স্টেশনে, দত্তদের বাড়িতে তার ছেলেকে পড়িয়ে আহার মিলে, তাতে খাবারের পয়সা বাঁচে। বর্ষার সময় বহু ছিদ্রে রসসিক্ত ছাতা নিয়ে অফিসে যেতে দেরি হয়, তাতে মাইনে কাটা যায় মাঝে মাঝে। কবিগুরু হরিপদ কেরানিকে মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন। কবি তুলনা করেছেন তার জীবনকে টিকটিকির জীবনের থেকেও অসহায়রূপে, যেখানে প্রাণী ও মানুষের মধ্যে পার্থক্য ধরা যায় শূন্যÑ‘আমি ছাড়া ঘরে থাকে আরেকটি জীব এক ভাড়াতেই, সেটা টিকটিকি। তফাত আমার সঙ্গে এই শুধু, নেই তার অন্নের অভাব।’ (বাঁশি)। নিতান্ত সাধারণ মানুষের জীবনবোধ কবি অবলোকন করেন এভাবে, ‘ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা-নিতান্তই সহজ সরল (১৭ জ্যৈষ্ঠ, ১২৯৯)’। রবিঠাকুর সম্পর্কে নোবেল বিজয়ী আইরিশ কবি ইয়েটস বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ সবার চেয়ে মহত্তর কবি।’ (এজরা পাউন্ডের ১৯১৩ সালের মার্চের ঋড়ৎঃহরমযঃষু জবারব-িএর সমালোচনা; অনুবাদক : বিষ্ণু দে)।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close