সাধন সরকার

  ২৫ আগস্ট, ২০১৮

বিশ্লেষণ

এ স্রোত থামাতে হবে

বিশ্বের সবচেয়ে জনঘনত্বের শহর, অন্যতম দূষণের শহর, সবচেয়ে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির শহর, অন্যতম অপরিকল্পিত রাজধানী এবং বিশে^র অন্যতম বসবাস অযোগ্য শহর কোনটি? এতগুলো প্রশ্নের উত্তর একটাইÑ শহরটি ‘ঢাকা’। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ঢাকার জনসংখ্যা বাড়তে শুরু করে সুবেদার ইসলাম খান ঢাকাকে ১৬১০ সালে প্রাদেশিক রাজধানী ঘোষণার পর। মোগল আমলে ঢাকার জনসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৯ লাখ। আবার ব্রিটিশ আমলে ঢাকা রাজধানীর মর্যাদা হারানোর ফলে জনসংখ্যা ও নগরের এলাকা দুটোই কমে যায়। ১৮০১ সালে ঢাকা নগরীর জনসংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র দুই লাখ। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ঢাকাকে যখন পূর্ববাংলা ও আসাম নামের নতুন একটি প্রদেশের রাজধানী করা হয়, তখন থেকে এর জনসংখ্যা আবার বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। পাকিস্তান আমলেও ঢাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকে। তবে ঢাকায় ব্যাপকহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ১৯৭০ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৮ লাখ। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৮৪ লাখ। সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ঢাকা নগরীর জনসংখ্যা এক কোটি ৩০ লাখ। জাতিসংঘের ‘ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার জনসংখ্যা এক কোটি ৭০ লাখ। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকার জনসংখ্যা ৩ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। বর্তমানে ঢাকা বিশে^র ১১তম জনবহুল স্থান বা মেগাসিটি। মাত্র ৩২৫ বর্গকিলোমিটারের এই শহরে জনঘনত্ব পৃথিবীর আর কোনো শহরের জনঘনত্বের কাছাকাছিও নয়। ঢাকা শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে প্রায় ৪৫ হাজার লোক। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯০ শতাংশ ওয়ার্ডেই ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত মানুষ বাস করে। প্রতিদিনই অনিয়ন্ত্রিতহারে জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। ঢাকায় প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ জন। অতিরিক্ত মানুষের চাপে যানজট এবং নাগরিক পরিসেবার অবনতিসহ জীবনযাত্রার মান ক্রমেই নিচে নামছে; যার ফলে ক্রমেই বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে এই শহর। নগরের সার্বিক সুবিধা ও স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করার পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা এই শহরে নেই বললেই চলে। অপরিকল্পিত নগরায়ণই যেন ঢাকার প্রধান বৈশিষ্ট্য! যতই দিন যাচ্ছে ঢাকার জীবন ব্যবস্থা ততই আরো সমস্যাপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো ঢাকা শহরে অধিক জনসংখ্যার কারণ কী? দেশের সেরা স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয় ঢাকায়। সরকারি সব মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, বিভাগের প্রধান কার্যালয়, এমনকি বেসরকারি বড় বড় কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের প্রধান অফিস এই ছোট্ট শহরে। ব্যাংক-বীমাসহ সবধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঢাকায়। বিদেশি সব দূতাবাস এখানে। প্রধান প্রধান ও বিশেষায়িত সব হাসপাতালের অবস্থান এখানে। ঢাকা শহরের মধ্যে এবং এর আশেপাশে গড়ে ওঠেছে বিভিন্ন শিল্পকারখানা; যা শহরটাকে একটা বাণিজ্যিক রূপ দিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বা অফিসের কাজকর্ম বাদেও শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্যান্য প্রয়োজনে প্রতিদিনই বিপুলসংখ্যক মানুষ ঢাকায় আসতে বাধ্য হচ্ছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য চরম ভারসাম্যহীন অবস্থা বিরাজ করছে। দেশের সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৪৮টি বিশ^বিদ্যালয়ের প্রায় ১০০টিই এই ঢাকা শহরে অবস্থিত। নামকরা ডাক্তাররা সব ঢাকায়, রোগ নির্ণয়ের বড় বড় যন্ত্রপাতি সব ঢাকায়। গ্রামীণ অর্থনীতিতে বলতে গেলে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান তেমন কিছুই হচ্ছে না। ফলে গ্রাম থেকে মানুষ কাজের খোঁজে কিংবা বাড়তি রোজগারের আশায় ঢাকায় আসতে বাধ্য হচ্ছে। দেশের উচ্চবিত্ত বা ধনীদের ৭৫ শতাংশই ঢাকায় বসবাস করেন। কর্মহীন মানুষ প্রতিদিন এই শহরে আসছে। ফলে বাড়ছে বস্তিবাসীর সংখ্যা। ঢাকার জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশই বস্তিবাসী। দিনে দিনে বস্তিবাসী ও বস্তির সংখ্যা বাড়ছে। কাজের জন্য, শিক্ষার জন্য, বাণিজ্যের জন্য, চিকিৎসার জন্যসহ নানা প্রয়োজনে মানুষ ঢাকায় আসছে। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ঢাকাকেন্দ্রিক। আমাদের সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঢাকাকেন্দ্রিক। মোদ্দাকথা, নীতিনির্ধারকদের দূরদর্শিতার অভাব আর আমলাতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার কারণে বাংলাদেশের সবকিছুই যেন ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে গড়ে উঠেছে। দ্বিতীয় কোনো শহর ঢাকার সমকক্ষ হয়ে গড়ে উঠতে পারেনি। ফলে ঢাকামুখী জনসংখ্যার চাপ কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। গৃহীত কোনো নগর পরিকল্পনাই ঢাকার জন্য ভালো ফল বয়ে আনছে না। যানজট রোধ, গণপরিবহন সেবা, জলাবদ্ধতা রোধসহ নাগরিক পরিসেবার সব ক্ষেত্রে অনেক ভালো ভালো উদ্যোগ ব্যাহত হচ্ছে। ঢাকা শহরের ক্ষেত্রে অধিক জনসংখ্যা যেন অধিক গুরুত্বের লক্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে! কিন্তু সমস্ত রক্ত যদি মুখেই জমা হয়, তখন সেটা মারাত্মক রোগের লক্ষণ বলে ধরা যেতে পারে, বিশেষ করে ঢাকা শহরের জন্য। ঢাকা শহরকে এখন রোগে ধরেছে! ঢাকা (দেশ) আর বাংলাদেশ যেন দুই দেশ হয়ে গেছে। ঢাকায় যেন সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু, পুরো দেশ যেন ঢাকার ওপর নির্ভরশীল। জার্মান ভূগোলবিদ খ্রিস্টলার ১৯৩৩ সালে ‘কেন্দ্রীয় অবস্থান তত্ত্ব’ সম্পর্কে সবচেয়ে কার্যকর মতবাদ দেন। সেখানে একটি নগর তার চারপাশের এলাকার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে নগরের বা এলাকার সঙ্গে অন্যান্য এলাকার সুষম বণ্টনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু রাজধানী ঢাকা জনসংখ্যা ও বসবাসের দিক দিয়ে সম্পূর্ণ তার বিপরীত শহর। ঢাকা শহরের সঙ্গে অন্যান্য শহরের বৈষম্য ও ব্যবধান বিস্তর। প্রতিবছর ঢাকার জসসংখ্যা ৩ থেকে ৪ শতাংশ হারে বাড়ছে। দেশের মোট আয়তনের ১ শতাংশ ঢাকা মহানগর হলেও সেখানে বাস করে দেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশেরও বেশি মানুষ। ঢাকায় জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে সব খরচই ঊর্ধ্বমুখী। প্রতিদিন ঢাকা শহরে ৪ থেকে ৫ লাখ মানুষ কাজ করতে আসে আবার দিন শেষে চলেও যায়। যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের’ (ইআইইউ) বাসযোগ্যতার বিচারে প্রত্যেক বছর যে তালিকা প্রকাশ করা হয় সেটিতে ঢাকা প্রত্যেকবার সবচেয়ে খারাপ শহরের তালিকায় অবস্থান করে। পৃথিবীর নিকৃষ্টতম শহরের তালিকায় ঢাকার স্থান স্থায়ী হতে চলেছে! দিনে দিনে যানজট, জলাবদ্ধতা, দূষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মান খারাপ হচ্ছে। সুষম ও বাসযোগ্য আবাসন ব্যবস্থার অভাবে নগরবাসীকে প্রতিনিয়ত ভুগতে হচ্ছে।

তাই ঢাকাকে বাঁচানোর পাশাপাশি আধুনিক ও বাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে তুলতে সবার আগে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ঢাকামুখী মানুষের চাপ কমাতে হবে। ঢাকা শহরের সঙ্গে অন্যান্য বিভাগীয় শহরের বৈষম্য ও ব্যবধান দূর করতে হবে। ঢাকা শহরের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে জরুরি হলো সৃষ্ট সমস্যাবলির সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া। ঢাকাকে কীভাবে আরো বাসযোগ্য করা যায়, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা কীভাবে আরো বাড়ানো যায়, জনঘনত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতে সৃষ্ট সমস্যাবলি কীভাবে সমাধান করা যায়Ñ সেদিকে নজর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। নগরের সুষম বিকাশ ও বিকেন্দ্রীকরণের দিকে জোর দিতে হবে সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। উপজেলা শহরগুলোতে কর্মসংস্থান, আবাসন, শিল্পায়ন ও মৌলিক পরিসেবার ওপর জোর দিতে হবে। জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতে শিক্ষা ও চিকিৎসার আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ঢাকার আশেপাশের শহরগুলোতেও ঢাকা শহরের মতো সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে ঢাকার আশেপাশে থেকে ও অন্যান্য শহর থেকে মানুষ আর ঢাকামুখী হবে না। বিশে^র বিভিন্ন দেশে আইন করে এলাকাভিত্তিক জনসংখ্যার ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এসবের তেমন কোনো উদ্যোগই নেই। তাই ঢাকা শহরের টেকসই উন্নয়নের জন্য এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব নির্ণয় করে তা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকা শহরে একেক ওয়ার্ডে বসতির একেক চিত্র। একটি আধুনিক ও বাসযোগ্য শহর গড়তে হলে শহরটির ভৌত অবকাঠামো হতে হবে পরিকল্পনামাফিক ও সুশৃঙ্খল। সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে, রাজউকের ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায়’ (ড্যাপ) ঢাকা মহানগরের এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণ এবং ভবনের উচ্চতা নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটা বাস্তবায়ন করা গেলে ভবিষ্যতে শহরটির জন্য ভালোই হবে বলে মনে করি।

লেখক : কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close