ড. ফোরকান আলী

  ২১ আগস্ট, ২০১৮

মতামত

ঈদুল আজহার ত্যাগ ও শিক্ষা

পবিত্র ঈদুল আজহা মুসলমানদের দ্বিতীয় ধর্মীয় উৎসব। ঈদ বা আনন্দ উদযাপনের দিন। ত্যাগ ও মহিমার দিন। ত্যাগ এই অর্থে, এই দিনে সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে কোরবানি করার ইতিহাস রচিত হয়েছে। মিল্লাতে আবা ইব্রাহিম বা মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) প্রথম এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসুল। ইমানের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি খলিলুল্লাহ বা আল্লাহর দোস্ত উপাধি লাভ করেন। তিনি তার মূর্তিশিল্পী ও মূর্তিপূজারি পিতার মতো চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, তারা, নক্ষত্র ইত্যাদি নহে, বরং আসলামতু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন ঘোষণার দীপ্ত আবেগে এক আল্লাহর রাহে নিজেকে নিয়োজিত করেন। মহান আল্লাহ একদিন ইব্রাহিম (আ.)-কে স্বপ্নাদেশে তার প্রিয় ছেলে হজরত ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করতে বললেন। দীর্ঘ অপেক্ষার পর আল্লাহর মেহেরবানিতে তিনি ৮৬ বছর বয়সে একমাত্র ছেলেসন্তান লাভ করেছিলেন। কিন্তু ইমানের এ পরীক্ষায়ও তিনি উত্তীর্ণ হন। মিনায় হজরত ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করতে গিয়ে স্নেহাধিক ছেলে কিংবা প্রাণাধিক স্ত্রী মা হাজেরা (রা.) ধৈর্য ধারণ করেন। তাঁরা আল্লাহর নির্দেশ জেনে বরং নিজেকে আত্মোৎসর্গ করতে পেরে খুশি হয়েছিলেন। এটিই কোরবানি ঈদের শিক্ষা। এখানে ত্যাগটাই বড় কথা। অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টিকল্পে নিজের জান ও মালকে কোরবানি করতে সদাপ্রস্তুত থাকতে হবে।

জিলহজ মাসের ১০ তারিখ এলে মুমিনের হৃদয়ে জেগে ওঠে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সেই সুমহান ত্যাগের স্মৃতি। প্রভু প্রেমে আপ্লুত হয়ে স্বীয় প্রাণ-প্রতিম ছেলে ইসমাইলকে কোরবানি করার যে কঠিন পরীক্ষায় তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তা এক বিরল ঘটনা। আল্লাহ তাঁর খলিলের সেই অকৃত্রিম ত্যাগকে অবিস্মৃত স্মৃতি হিসেবে ধরে রেখেছেন। ইসলামের অনুসারীরা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে অনুসরণ করে কিয়ামত পর্যন্ত কোরবানি করতে থাকবে। ‘ঈদুল আজহা’ শব্দদ্বয় আরবি। ‘ঈদ’ অর্থ-খুশি; আর ‘আজহা’ অর্থ-কোরবানি বা আত্মোৎসর্গ। তাই ‘ঈদুল আজহা’ অর্থ হলোÑআত্মোৎসর্গের খুশি, স্বভাবত, প্রশ্ন আসতে পারে, কোরবানির মধ্যে আবার খুশি কিসের? তাহলে এবার বুঝতে হবে, মূলত মুসলমানদের ঈদের খুশি সাধারণ অর্থে নয়; বরং এ খুশি হচ্ছে উৎসর্গ ও ত্যাগের মাধ্যমে ধর্মীয় কর্তব্য পালনের খুশি। ঈদুল আজহার সঙ্গে কোরবানি সম্পৃক্ত বিধায় এটাকে কোরবানির ঈদ বলা হয়। ‘কোরবানি’ শব্দটা ‘কুরবানুন’ শব্দ থেকে উদ্ভূত। ‘কুরবানুন’ অর্থ হলোÑনৈকট্য; এ ক্ষেত্রে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের উদ্দেশ্যে আত্মোৎসর্গ করাই কোরবানি। শরিয়তের পরিভাষায় কোরবানি বলা হয়Ñআল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টির জন্য জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত নির্দিষ্ট কিছু পশু কোরবানি করা প্রতিটি সংগতিসম্পন্ন মুসলমান, যার নিত্যপ্রয়োজনীয় জীবনধারণের সামগ্রী ছাড়া নেসাব পরিমাণ সম্পদ অর্থাৎ সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা এর যেকোনো একটির সমমূল্যের সম্পদ রয়েছে, তার জন্য কোরবানি করা ওয়াজিব।

কোরবানি ইসলামের অভিনব কোনো বিধান নয়। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শরিয়তের আগেও এ প্রচলন ছিল। আল কোরআনে ইরশাদ হচ্ছেÑ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির একটি নিয়ম নির্দিষ্ট করেছি, যাতে তারা আল্লাহর দেওয়া চতুষ্পদ জন্তু জবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সুরা হজ, আয়াত : ৩৪)। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়Ñহজরত আদম (আ.) থেকে হজরত মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সব নবী-রাসুল ও তাঁদের অনুসারীরা কোরবানি করেছেন। তবে একেক উম্মতের কোরবানির পদ্ধতি ছিল একেক রকম। ইতিহাসে প্রথম কোরবানি সংঘটিত হয় হজরত আদম (আ.)-এর পুত্রদ্বয় হাবিল-কাবিলের মাধ্যমে। আল্লাহ তাদের কোরবানির কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘(হে নবী!) আর আপনি তাদের আদমের পুত্রদ্বয়ের (হাবিল-কাবিলের) ঘটনা সঠিকভাবে শুনিয়ে দিন। যখন উভয়েই এক-একটি কোরবানি উপস্থিত করল এবং এদের মধ্যে একজনের (হাবিলের) কোরবানি কবুল হয় আর অপরজনের কবুল হয়নি। সেই অপরজন বলতে আরম্ভ করল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। উত্তরে সে বলল, আল্লাহ ধর্মভীরুদের কোরবানি কবুল করে থাকেন।’ (সুরা মায়েদাহ, আয়াত : ২৭)।

হজরত নূহ (আ.)-এর যুগেও কোরবানির প্রথা চালু ছিল। এ প্রসঙ্গে মিসরের প্রখ্যাত আলেম ও ইতিহাসবিদ মুহাম্মদ ফরিদ ওয়াজদী বলেন, হজরত নূহ (আ.) জন্তু জবেহ করার জন্য পৃথক একটি কোরবানিগাহ নির্মাণ করেছিলেন। তাফসিরে হক্কানির ভাষ্যানুযায়ী হজরত নূর (আ.) ও হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর শরিয়তেও দ্বীনের বিধানরূপে কোরবানি স্বীকৃত ছিল। বর্তমান বাইবেলেও বহু স্থানে কোরবানির উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন ভারতবর্ষে নরবলির কুপ্রথা বিদ্যমান ছিল। কোরবানির মধ্যে ইহলৌকিক-পারলৌকিক উভয় কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আল্লাহ আল-কোরআনে বলেন, ‘আর (কোরবানির) উটগুলোকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন করেছি। এতে তোমাদের বহু কল্যাণ নিহিত আছে।’ (সুরা হজ, আয়াত : ৩৬)। কোরবানির সঙ্গে জড়িত রয়েছে আমাদের সমাজের স্বার্থ। তাই আমাদের ভেবে দেখতে হবে, আমরা তা সঠিকভাবে পালন করছি কিনা। আমরা কোরবানির গোশত সঠিক নিয়মে গরিব আত্মীয়-স্বজন বা গরিব-দুঃখীকে বিতরণ করছি কিনা। প্রকৃতপক্ষে কোরবানি প্রতি বছর আমাদের পশু হনন করতে আসে না, বরং পশু কোরবানির মাধ্যমে পশু-প্রবৃত্তিকে বিসর্জন দিয়ে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার কোরবানি যে একটি উত্তম ব্যবস্থা, সে সূক্ষ্ম কথাটি স্মরণ করিয়ে দিতে ঈদুল আজহা আসে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করাই বান্দার মূল লক্ষ্য। এ প্রত্যয়ের ওপরই হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল কঠিন থেকে কঠিনতর পরীক্ষায় নিজেকে সমর্পণ করা। একইভাবে যুগে যুগে নবী-রাসুলগণ এই প্রত্যয়, এই ইমানি শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন। পরে তাঁদের অনুসারীরাও তাঁদের অনুসৃত পথে চলেছেন। তাই আজ আমরা আমাদের শুধু কোরবানির প্রতীক হিসেবে পশু কোরবানির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। বরং তাঁদের মতো প্রভুপ্রেমে জাগরিত হয়ে জানমাল নিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসতে হবে। মানবকল্যাণের জন্য সবাইকে উৎসর্গিত হতে হবে। পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে পশু শক্তিকেও কোরবানি করে দিতে হবে। ইসলামের সঠিক দীক্ষা নিয়ে সুন্দর সচেতন সমাজ, পাপমুক্ত পরিবেশ, হিংসামুক্ত রাজনীতি, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, সন্ত্রাসমুক্ত দেশ, প্রেম ও ভালোবাসা বিজড়িত বিশ্ব গড়ে তুলতে হবে। ত্যাগ-উৎসর্গের মাধ্যমে অসহায় নিরণœ-আশ্রয়হীন মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। তবেই ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় জীবনে নেমে আসবে অনাবিল শান্তি, আর আদায় হবে কোরবানির সার্থকতা।

পরিশেষে, কোরবানির কিছু মাসআলা উল্লেখ করতে চাই। আশা করি পাঠকরা এতে উপকৃত হবেন। কেউ কেউ মনে করেন, যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়, তারা কোরবানি করতে পারবে না। এ ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক। বরং তারা কোরবানি করলে অধিক সওয়াব পাবেন। নিজের পক্ষ থেকে কোরবানি করা ওয়াজিব। সন্তানের পক্ষ থেকে পিতার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব নয়। তবে পিতা যদি নিজের মাল থেকে নাবালেগ ছেলের পক্ষ হয়ে কোরবানি করেন, তাহলে নফল হিসেবে গণ্য হবে। মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কোরবানি করা যায়। আর এতে তিনি অধিক সওয়াবের অধিকারী হবেন। যদি কোনো ব্যক্তির দশজন ছেলে থাকে আর সবাই একান্নভুক্ত হয়, তাহলে শুধু পিতার ওপর একটি কোরবানি ওয়াজিব হবে। তবে ছেলেরা যদি ব্যক্তিগতভাবে নিসাবের মালিক হয়, তাহলে পিতার কোরবানি তাদের জন্য যথেষ্ট নয়, পৃথকভাবে তাদেরও কোরবানি করতে হবে। অনুরূপভাবে স্ত্রী নিজে ‘মালেকে নেসাব’ হলে তাকেও আলাদাভাবে কোরবানি করতে হবে। কোনো কোনো স্থানে প্রচলন রয়েছে, এক বছর নিজের নামে, এক বছর ছেলের নামে এবং এক বছর নিজ স্ত্রীর নামে কোরবানি করে, অর্থাৎ প্রতি বছর নাম পরিবর্তন করতে থাকেন। এটা ঠিক নয়। বরং যার ওপর কোরবানি ওয়াজিব, কেবল তার নামেই কোরবানি করতে হবে। কোরবানির পশুতে কাউকে শরিক করার ইচ্ছে থাকলে খরিদ করার আগেই ঠিক করে নেবে। কারণ একা কোরবানির নিয়তে পশু খরিদ করার পর অন্য কাউকে শরিক করা মাকরুহ। তবে এমন ব্যক্তি যার ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়, সে একার নিয়তে খরিদ করার পর অন্যকে শরিক নিতে পারবে না। কোরবানির গোশত নিজে খাবে, বন্ধু-বান্ধব এবং ধনী আত্মীয়-স্বজনকেও দেবে। এমনকি অমুসলিম প্রতিবেশীকেও দিতে পারবে। তবে মৃতের অছিয়তকৃত কোরবানি হলে সে গোশত কেবল গরিবদের মধ্যে সদকা করতে হবে। কোরবানির গোশত, চামড়া ও তার মূল্য দ্বারা কসাই এবং জবেহকারীকে পারিশ্রমিক দেওয়া বৈধ নয়। পৃথকভাবে তাদের মজুরি দিতে হবে। চামড়ার বিক্রয়লব্ধ সমুদয় অর্থ গরিবকে সদকা করা ওয়াজিব। হালাল প্রাণীর আটটি অংশ ছাড়া অন্য সবকিছু খাওয়া বৈধ। নিষিদ্ধ আটটি অংশ হলোÑউভয় লিঙ্গ, মূত্রথলি, পিঠের হাড়ের মধ্যকার সাদা রগ, চামড়ার নিচের টিউমারের মতো উঁচু গোশত, অ-কোষ, পিত্ত ও প্রবাহিত রক্ত। কোরবানির তাৎপর্য বুঝে আল্লাহ সবাইকে কোরবানি করার ও তার শিক্ষা গ্রহণের তাওফিক দান করুন। আমিন!

লেখক : গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close