মাহমুদুর রহমান খান

  ১৯ আগস্ট, ২০১৮

মতামত

কবি ও রাজনীতির কবি

কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেন সব বাঙালির হৃদয়ে চিরকালের জন্য একই সূত্রে গাথা দুটি নাম। একজন জাতীয় কবি এবং অপরজন জাতির পিতা। তাদের দুজনের চিন্তা, চেতনা, মতাদর্শ, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যেন প্রায় একই। দুজনই বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন। প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন অন্যায়, অত্যাচার, শাসন, শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে। তাদের মহৎ অবদানের জন্য বাঙালি জাতি আজও তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান তার বক্তব্যে বলেন, ‘বাঙালি মুসলমান সমাজের প্রায় হাজার বছরের ইতিহাসে দুজন মাত্র প্রতিভাবান বাঙালি জন্মগ্রহণ করেছেন। একজন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, অপরজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’

কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন ইংরেজ কর্তৃক শাসনকৃত বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য। তিনি ইংরেজ দমনের জন্য বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের মাধ্যমে বাঙালি জাতির যে গৌরব চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল, সেই গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য ইংরেজ হঠাও আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কলমযুদ্ধ চালিয়ে গেছেন সব সময়। যুদ্ধবিদ্যা শেখার জন্য সেনাবাহিনীতে পর্যন্ত যোগদান করেছেন। দেশের মানুষকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। মুক্তি আস্বাদনের পথ বাতলে দিয়েছেন। সর্বদাই চেয়েছেন, ‘বাঙলা বাঙালির হোক! বাঙলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক।’

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘জয় বাংলা।’ ইংরেজরা এই উপমহাদেশ ত্যাগ করার পর পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার ফলে এ দেশের বাঙালি জাতি যেন তখনো মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করতে পারল না। পশ্চিম পাকিস্তানিরা এ দেশের মানুষের ওপর অত্যাচার চালানো শুরু করল। মাতৃভাষা বাংলা পর্যন্ত কেড়ে নিতে চাইল। বাঙালিদের ওপর অত্যাচার করা শুরু করল। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশাল বৈষম্য দেখা দিল। তবু বাঙালি যেন কখনো মাথা নোয়ানোর নয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনসহ বিভিন্ন বড় আন্দোলন গড়ে তুলল। তবু মুক্তি যেন মিলছিল না। সত্তরের নির্বাচনে গণ-মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জয়লাভ করার পরও তাকে সরকার গঠন করতে দেওয়া হলো না। বাংলার মানুষের ওপর নির্যাতন বন্ধ হলো না। এমনই এক সংকটময় সময়ে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু মুক্তির ডাক দিলেন। বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তার সেই মুক্তির ডাকের মাধ্যমেই শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর বাঙালি জাতি চিরতরে মুক্তি পায়। অর্জন করে স্বাধীনতা।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং বঙ্গবন্ধু দুজনই ছিলেন বাঙালি জাতিকে মুক্ত করার জন্য বদ্ধ পরিকর। জয় না পাওয়া পর্যন্ত তারা দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। তাই তো নজরুল তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘মহা বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হবো শান্ত,/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,/অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে নাÑ’

আর বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ্।’

চিরকাল তাঁরা দুজনে দুঃখী অত্যাচারিত, নির্যাতিত, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের পাশে ছিলেন। তাঁরা সর্বদাই নিপীড়িত, অত্যাচারিত, কুলি, মজুর, ভিখারি, কৃষক, অসহায় ও দুঃখী মানুষের জয়গান গেয়েছেন। তাদের মুক্তির গান গেয়েছেন। তাঁদের চোখে নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কারো কোনো ভেদাভেদ ছিল না। দুজনেই নারী-পুরুষের সাম্যে বিশ্বাস করতেন এবং ছিলেন অসাম্প্রদায়িক।

নজরুল নারী ও পুরুষের সমতা নিয়ে তাঁর লেখা ‘নারী’ কবিতায় বলেছেন, ‘সাম্যের গান গাইÑ/ আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!/ বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’

তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় তিনি অসাম্প্রদায়িকতার জয়গান গেয়েছেন। লিখেছেন, ‘গাহি সাম্যের গানÑ/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান/যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’

বঙ্গবন্ধু নিজেও নারী এবং পুরুষের মধ্যে সাম্যে বিশ্বাস করেন। তাই তিনি সংবিধানে নারী ও পুরুষকে দিয়েছেন সমান অধিকার। মুক্তিযুদ্ধে লাঞ্ছিত নারীদের দিয়েছেন বীরাঙ্গনার সম্মান। যেসব ধর্ষিতাদের তাদের বাবা-মা প্রত্যাখ্যান করেছিল, তাদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ধর্ষিতা মেয়েদের বাবার জায়গায় আমার নাম লিখে দাও। আর ঠিকানা দিয়ে দাও ধানমন্ডি ৩২ নম্বর।’

শত্রুতা এবং রাজনৈতিক কারণে কিংবা মিথ্যে মামলার শিকার হয়ে দুজনেই জীবদ্দশায় জেল খেটেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন দফায় তাঁর সংগ্রামী জীবনের প্রায় ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে কাটিয়েছেন। নজরুলও দুবার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জেলে গিয়ে সাজা ভোগ করেছেন।

দুজনের মধ্যে যেন ছিল আত্মার মিল। এ জন্যই নজরুলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অপার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। তাই তো বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীনের পর কবি নজরুলকে এ দেশে এনে নাগরিকত্ব দিয়েছেন। ‘কবি ভবন’ নামে নজরুলের জন্য তৈরি করেছেন সুবিশাল বাড়ি। প্রতিনিয়ত কবির খোঁজ খবর নিয়েছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কবির সুচিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রƒষা নিশ্চিত করেছেন। দিয়েছেন জাতীয় কবির খেতাব।

কবি নজরুল স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখেছেন এবং বাংলাকে মুক্ত করতে লড়াই করেছেন। বঙ্গবন্ধু পরে এ লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছেন। তারা দুজনই ছিলেন মানবতাবাদ, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের পক্ষে। কবি নজরুল বাঙালিদের সৈনিক বানাতে চেয়েছেন আর বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের পরিণত করেছেন মুক্তিযোদ্ধায়। নজরুলের লেখা রণসংগীত ও বিভিন্ন গান যুদ্ধের সময় বাঙালিদের প্রেরণা জুগিয়েছিল। তাদের মনে বিদ্রোহী মনোভাব জাগিয়ে তুলেছিল। আর বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ভাষণ ও নেতৃত্ব বাঙালিদের যুদ্ধ জিততে সহায়তা করেছিল। তাই নজরুল জাতীয় কবি হলেও বঙ্গবন্ধু হলেন রাজনীতির কবি।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close