ড. ফোরকান আলী

  ১৯ আগস্ট, ২০১৮

বিশ্লেষণ

আত্মঘাতী আচরণ আমাদের

আমরা এখনো সমানে ধ্বংস করে চলেছি আমাদের বনসম্পদ, বৃক্ষসম্পদ। অথচ এই বৃক্ষকুলই আমাদের বন্ধুর মতো ছায়া দেয়। পরিবেশকে দেয় ভারসাম্য। শৈশবে পিতামহীকে ঘিরে হারিকেনের টিমটিমে আলোয় তার বৈচিত্র্যভরা স্মৃতিচারণা শুনতাম। প্রয়াত স্কুলশিক্ষকের কথা বিশেষ করে উঠে আসত পিতামহীর বর্ণিল বর্ণনায়। গ্রামের স্কুলশিক্ষক হলেও অনেক প্রসার ছিল তার, দূরদূরান্তে তাকে যেতে হতো শিক্ষার্থীদের দেখতে। এ কাজটি তিনি করতেন হেঁটে হেঁটে। স্কুলশিক্ষকের স্মৃতি ঝাপসা ভাসে মনে- দীর্ঘদেহী হালকা গড়নের শ্মশ্রƒমণ্ডিত মানুষটিকে না জানি কি দারুণ লাগত! কিন্তু তার মেঠোপথে হাঁটার কথা আমার মনে পড়ে না। একটু বয়স বাড়লে গ্রামীণ অভিজাতদের হাঁটতে আর দেখা যায় না। এ ছাড়া মাঝেমধ্যে ঘোড়ার গাড়িতে মাস্টার মশাই চড়তেন। সারা দেশে শুধু অভিজাত নয়, সবার অপরিহার্য ঘোড়ার গাড়িতে কে না চড়েছে! তাও এখন দৃষ্টিসীমার বাইরে উধাও। তাহলে!

তাহলে এখন আমাদের সন্তানরা ঘোড়ার কথা জানবে জীবনানন্দের কবিতায়। সেই যে ‘মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে’Ñতাও যদি তারা কবিতা অনুরাগী হয়! নৈসর্গিক পরিবর্তন এবং গতিবেগের প্রতিযোগিতায় এক জীবনকালের মধ্যেই সেখান থেকে বিদায় নিয়েছে ঘোড়া। শৈশবের স্বপ্নলোকের ঘোড়া এবং জ্যোৎস্নার প্রান্তরের মতো তাদের চারণক্ষেত্রগুলোও আমাদের জীবন থেকে অন্তর্হিত হয়েছে। অধুনা যন্ত্রযান বিস্তার লাভ করার আগে চলত নদীনালায় নৌকা এবং ভুড়ভুড়ে ধুলোর মেঠোপথে গরু বা ঘোড়ার গাড়ি। শহরের রাস্তায় যুগল ঘোড়ায় টানা গাড়িগুলো ছিল রীতিমতো রাজসিক ব্যাপার। আমাদের শৌখিন পূর্বপুরুষরা ঘোড়ায় চড়ে কুটুমবাড়িতে যেতেন। শক্ত হাতে লাগাম টেনে বাগ মানাতেন দুর্বিনীত এই পশুকে। চৌকষ পুরুষদের এও ছিল এক প্রকারের শৌর্য। আশ্চর্য হয়ে ভাবি কী ক্ষিপ্রগতিতে আমাদের জীবন থেকে এসব হারিয়ে গেল। আমাদের সন্তানরা এরপর ঘোড়া দেখবে প্রদর্শনীতে। ওদের কথা পড়বে বইয়ের পাতায়। অথবা রূপকথার ‘আর আসে না রাজার কুমার’ পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় উড়ে। হয়তো এর সবকিছুই বাস্তবে ছিল না, কিন্তু একটি রহস্যময়তার ‘স্বপ্নলোক’ সৃষ্টিতেই বা দোষ কি!

এই উপক্রমণিকা সত্ত্বেও কিন্তু কোনো প্রাণিবিশেষের স্তুতিবাদ এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য, একটি সচেতনতা সৃষ্টি যে, দ্রুত আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এমন অসংখ্য প্রজাতি। যেগুলো এত দিন আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করেছে। আমাদের জীবনকে ভরিয়ে রেখেছে বৈচিত্র্যেÑতা প্রাণিজগতের হোক বা উদ্ভিদ জগতের। কত কি যে আমরা ইতোমধ্যেই হারিয়েছি। তা বুঝি যখন মনে হয় যেন কতকাল ধরে দেখিনি নির্জন পুকুর পাড়ে কোনো বাঁশের ডগায় নিমগ্ন মাছরাঙা পাখি। বাঁশঝাড়ের আলো-আঁধারিতে ডাহুকের বিচরণ অথবা যেন কত দিন শুনিনি গভীর রাতে হুতুম পেঁচার ডাক বা অলস দুপুরে অদূরেই কোথাও কাঠঠোকরার অবিরাম ঠোকরের শব্দ। আরো স্তব্ধ হয়ে গেছে শেয়ালের ডাক, যা শুনে রাতের প্রহর গুনত আমার পূর্বপুরুষরা। অসংখ্য শিশুর মনোরঞ্জন করত শেয়াল-প-িতের উপাখ্যান। তাদের কল্পনার অনেকটা জুড়ে আছে এই প্রাণীটি। কিন্তু আমাদের আগামী প্রজন্ম কি প্রাণীটিকে আদৌ কি বাস্তবে দেখবে?

মাত্র তিন যুগ আগে এই রাজধানীতে বসে শেয়ালের ডাক শোনা যেত। তারও আগে ষাটের দশকে নির্মীয়মাণ গুলশান, বনানী ও মহাখালী এলাকায় নির্দ্বিধায় এরা বিচরণ করত। এখন প্রত্যন্ত পাড়াগাঁয়েও এদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেননা এদের আর কোনো আবাসন অবশিষ্ট নেইÑনেই কোনো খাদ্য খোরাক। তাই এরা প্রায় চোখের সামনে বিলুপ্ত হয়ে গেল। ভাগ্যিস এরা মানুষের কোনো খাদ্য নয়। নইলে অনেক আগেই এদের বিলুপ্তি ঘটত। প্রাণিজগতের বিচিত্র সব প্রজাতির সঙ্গে সহাবস্থানের ভেতর দিয়ে আমাদের জীবনের পরিপূর্ণতা। কেননা প্রকৃতির রাজ্যে এরা শুধু আমাদের প্রতিবেশী নয়। আমাদের স্বজন ও বন্ধুও বটে। আমাদের জীবন থেকে এদের বিতাড়ন করে আমরা কি আর কখনো সেই পরিপূর্ণতার স্বাদ পাব! নিরাপদ আশ্রয়ের অভাবে এবং ক্রমবর্ধমান প্রতিকূলতার মুখে এরা লোকালয় থেকে দূরে চলে গেছে। সেখানেও আমাদের বৈরিতা, হিংসা ও লোভ থেকে এরা অব্যাহতি পায়নি।

দ্রুত নগরায়ণ ও আধুনিকায়নের সঙ্গে সঙ্গে গাছগাছালি, ঝোপঝাড়, একটু নির্জনতার মতো প্রাণিকুলের স্বাভাবিক আবাস হিসেবে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকেনি। পশ্চাৎপসরণের পথেও প্রাণিকুল শিকার হয়েছে আমাদের লোভ, স্বার্থপরতা ও লালসার। ওদের জন্য নিভৃত নিবাস বলে এখন আর কিছু বাকি নেই। প্রকৃতির অকৃপণ, অবারিত অবদান বৃক্ষকুল ও প্রাণিকুলের নিধনযজ্ঞ, যদি এমনইভাবে অব্যাহত থাকে। সত্বরই দেখব, আমরা শুধু ইট, পাটকেল, কংক্রিট এবং লোহালক্কড় পরিবৃত্ত হয়ে বেঁচে আছি। দেখব, আমরা প্রকৃতির মমতার আবরণ থেকে নগ্ন, নিরাপত্তাহীন। এমনভাবে বেঁচে থাকার দুর্ভোগ আমরা ইতোমধ্যেই পোহাতে শুরু করেছি। এই সেদিনও, আমাদের বনাঞ্চল ছিল দেশের আয়তনের বিশ শতাংশের অধিক। আজকে তা নেমে এসেছে নয় শতাংশে। বেসরকারি সূত্র অনুযায়ী তা আরো কমÑমাত্র সাত শতাংশ। তাহলে বুঝতে হবে, কী দ্রুততার সঙ্গে এবং কী নির্মমভাবে আমরা অরণ্য নিধন করে চলেছি। এর ফলে আমাদের পরিবেশ সংকট ইতোমধ্যেই প্রকট রূপ ধারণ করেছে। ঐতিহ্যগতভাবে রিমঝিম বৃষ্টির এই বাংলাদেশেও আমরা এখন খরা ও পানি সংকটের শিকার। সংকুচিত হয়েছে বৃষ্টির মৌসুম এবং প্রলম্বিত হয়েছে খরার সময়কাল।

বনাঞ্চল সংকোচনের ফলে বিলুপ্তির মুখোমুখি হয়েছে অনেক প্রাণী ও গাছগাছালি। যাদের লালন করে বনাঞ্চল। বৃক্ষনিধনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক পাখপাখালি হারিয়েছে তাদের আশ্রয়স্থল। বন ও বৃক্ষনিধনের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতি অনুভূত আমাদের দ্রুত অবনতিশীল পরিবেশের ওপর। বৃক্ষনিধনের পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি সত্যিই বিপুল। ব্যাপক হারে বৃক্ষের গোড়া থেকে উৎক্ষিপ্ত পলকা মাটি ভরিয়ে দিচ্ছে আমাদের নদীবক্ষ। পলিতে ভরে যাচ্ছে আমাদের অসংখ্য বিল, হাওর ও জলাভূমি। প্রবহমান পানির জন্য নদীবক্ষের ধারণক্ষমতা কমে যাওয়ায় হচ্ছে উপর্যুপরি বন্যা ও নদীভাঙন। উপকূল এলাকায় বৃক্ষনিধন বৃদ্ধি পাওয়ায় জলোচ্ছ্বাস বা সাইক্লোনের তীব্রতা বাড়ছে। সর্বোপরি একটি বৃক্ষ বিবর্জিত বাংলাদেশ বায়ুম-লের উষ্ণতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। সেই উষ্ণতার কারণে সমুদ্র স্ফীতির সবচেয়ে বড় শিকার হবে বাংলাদেশ নামের বিশ্বের সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপটি, যা নাকি সমুদ্রবক্ষের প্রায় সমান্তরাল। তবু আমাদের মধ্যে নেই কোনো উৎকণ্ঠা, কোনো উদ্বেগ। এখনো আমরা সমানে ধ্বংস করে চলেছি আমাদের বনসম্পদ, বৃক্ষসম্পদ। অথচ এই বৃক্ষকুলই আমাদের বন্ধুর মতো ছায়া দেয়, পরিবেশকে দেয় ভারসাম্য।

এই নিধনযজ্ঞের পুরোভাগে রয়েছে আমাদের ‘বনখেকো’ বন কর্মকর্তারা। জনসংখ্যার চাপে এবং নতুন বসতি স্থাপনের প্রয়োজনে হয়তোবা কিছু বনসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু বনাঞ্চলের লুটপাটÑতা পার্বত্য চট্টগ্রামেই হোক, সুন্দরবনেই হোকÑকর্তৃপক্ষের যোগসাজশ ছাড়া কখনোই সম্ভব নয়। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি পরিবেশগত ধ্বংসলীলা থেকে বাঁচাতে দেশব্যাপী দুর্বার পরিবেশ আন্দোলন প্রয়োজন। এই আন্দোলনের আওতায় শুধু বৃক্ষসম্পদই আসবে নাÑআরো আসতে হবে আমাদের নদী-খাল-বিলের সংরক্ষণ। কেননা এসব কিছু মিলিয়েই আমাদের পরিবেশ। পরিবেশের সংরক্ষণ নিশ্চিত করবে আমাদের প্রাণিসম্পদের সংরক্ষণ। কেননা এতে করেই ওরা ফিরে পাবে ওদের নিভৃত নিবাস। বিরল প্রাণীদের সংরক্ষণের জন্য সরকারি একটি অধ্যাদেশ থাকা সত্ত্বেও কেউ তার পরোয়া করে না। তাই এদের সংরক্ষণও পরিবেশ আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব। কী দৃষ্টিতে আমরা এই অবলা প্রাণীদের দেখব? প্রকৃতির রাজ্যে তাদেরও যে একটা অধিকার, তা শনাক্ত করার মধ্যে বহুলাংশে নিহিত আছে তাদের নিরাপত্তা।

লেখক : গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close