আবু তাহের

  ১৬ আগস্ট, ২০১৮

বিশ্লেষণ

দেশ এগিয়েছে, আমরাও...

দেশ এগিয়েছে। সমান তালে আমরাও এগিয়েছি ঢের। আর তাই বিশ্বে নারী ধূমপায়ীর মধ্যে আমাদের অবস্থান ষষ্ঠ। যেখানে বিশ্বে ধূমপায়ীর সংখ্যা কমছে আর সেখানে আমাদের দেশে পুরুষের পাশাপাশি নারী ধূমপায়ী সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। নারী ধূমপায়ীদের সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের ২২টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য। বিশ্বে ধূমপায়ীদের সংখ্যা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ক্রোয়েশিয়া। ২২টি দেশকে নিয়ে করা এই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশের নারীরা সবচেয়ে বেশি ধূমপান করেন। ক্রোয়েশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথের গবেষণা তথ্য থেকে এটি জানা গেছে। নারী ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরই আছে ক্রোয়েশিয়া। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ধূমপায়ীদের সংখ্যা কমলেও আমাদের দেশে তা বেড়েই চলেছে।

ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, এ কথা নতুন করে বলার নেই। কিন্তু বর্তমানে এর ব্যবহার এত বেশিমাত্রায় বেড়ে গেছে, অধূমপায়ীদের জন্য প্রায়ই তা মারাত্মক কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ধূমপায়ীদের সংখ্যা লাগামহীন দিন দিন বেড়েই চলছে। এ জন্য পারিবারিক অনুশাসনকে প্রথমেই দায়ী করা যেতে পারে। পরিবারের শাসনব্যবস্থার শিথিলতার কারণে বর্তমানে খুব অল্প বয়সের ছেলেরা ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া মেয়ারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চারুকলায় তো মাদকের মেলা বসায় নিত্যদিন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর ৫৭ হাজার মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত রোগে মারা যাচ্ছে, তিন লাখ ৮২ হাজার জন কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে। ধূমপানজনিত প্রধান আটটি রোগের চিকিৎসা বাবদ বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। জার্মানির ক্যানসার গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ধূমপান করার কারণেই বছরে ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়। আর বছরে ৩৩০০ জন মারা যায় ধূমপায়ীদের কাছাকাছি থেকে সিগারেটের ধোঁয়া গ্রহণ করার কারণে। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, ধূমপায়ী নারীর বন্ধ্যা হওয়ার আশঙ্কা ৬০ শতাংশেরও বেশি। তামাকের সঙ্গে গর্ভপাতের গভীর সম্পর্ক রয়েছে এবং ভ্রƒণের স্বাস্থ্য সমস্যারও সৃষ্টি করে ধূমপান। এটি নিউরাল টিউব ডিফেক্টের ঝুঁকি কিছুটা বাড়ায়। ফুসফুসে ক্যানসারেরও অন্যতম কারণ এই ধূমপান। দ্য টোব্যাকো এটলাসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ পুরুষ ও ৫ দশমিক ৭ শতাংশ নারী তামাক ব্যবহারের কারণে মারা যায়। যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের প্রবণতা নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। আর দেশে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪ কোটি ১৩ লাখ, যার ২৩ শতাংশ (২ কোটি ১৯ লাখ) ধূমপায়ী এবং ২৭ দশমিক ২ শতাংশ (২ কোটি ৫৯ লাখ) ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করে।

বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের তামাকজাত পণ্য ব্যবহারকারী শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটি। সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্যতম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপের তামাকের ব্যবসা কিনে নিয়েছে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষস্থানীয় তামাক কোম্পানি জাপান টোব্যাকো ইনকরপোরেটেড (জেটিআই)। প্রায় ১২ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকায় আকিজ গ্রুপের তামাকের ব্যবসা কিনে নিল তারা। বাংলাদেশের সিগারেট বাজার বিশ্বের মধ্যে অষ্টম, যার পাঁচভাগের একভাগ আকিজ টোব্যাকোর দখলে রয়েছে। বাংলাদেশে সিগারেটের বাজারে ৯০ শতাংশে তামাক উৎপাদনে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আকিজের উপস্থিতি রয়েছে। বাংলাদেশে সিগারেটের বাজারের বার্ষিক উৎপাদন ৮ হাজার ৬০০ কোটি ইউনিটের বেশি, যা প্রতি বছর ২ শতাংশ হারে বাড়ছে। বাজার দিন দিন বাড়ছে। ভয়ংকর এই তথ্য আমাদের কতটুকু বেদনা দেয় জানি না। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সে রকম কোনো আভাস দেয় না। কিন্তু জাপানি কোম্পানি কেন আমাদের দেশে বিনিয়োগ করল তা হয়তো একবারও ভেবে দেখিনি। জাপানি এই সিগারেট কোম্পানির বিনিয়োগ হবে এ যাবৎকালের মধ্যে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে একক বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগ। অনেকে হয়তো অবাক হতে পারেন। কিন্তু দেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, সিগারেটের যে বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

সিগারেট খাতে মুনাফার এমন সুযোগ এবং সম্ভাবনা পৃথিবীর খুব কম দেশে আছে। ধূমপান নিরুৎসাহিত করার ব্যাপারে সরকারের কোনো উৎসাহ পরিলক্ষিত হয় না। আমাদের দেশের সিগারেটেরে দাম অনেক কম ভিয়েতনাম কিংবা ফিলিপাইনের তুলনায়। রাজস্ব আয় কমার আশঙ্কায় সিগারেট খাতে কর-কাঠামোতে বড় পরিবর্তন আনতে পারেনি কোনো সরকার। সরকারের রাজস্ব আয় কমবেশি ১৫ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের একক বৃহত্তম খাত এটি। ক্রমবর্ধমান কড়াকড়ি এবং স্বাস্থ্যসচেতনতার কারণে পশ্চিমাবিশ্বে সিগারেটের ব্যবসার নিম্নগতি। সে কারণে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এখন টার্গেট করছে আমাদের দেশকে। সরকার এ ব্যাপারে আইন করলেও এর প্রয়োগের ব্যাপারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর উদাসীনতার কারণে অধূমপায়ীদের ক্ষতির সীমা নেই। ২০০৫ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন, ব্যবহার, ক্রয়-বিক্রয় ও বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আইন প্রণীত হয়। এই আইনে গুল, জর্দা, খৈনি ও সাদাপাতার মতো ধোঁয়ামুক্ত চোষণ ও চিবানোর মাধ্যমে গ্রহণ করাকেও ধূমপানের অন্তর্ভুক্ত করা হলেও এ বিষয়ে ধূমপায়ীদের ধারণা দেওয়া সম্ভব হয়নি। কিছু দুর্বলতার কারণে আইনটি ততটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। তাই ২০১৩ সালের মে মাসে আইনটি সংশোধিত আকারে পাস হয়। সর্বশেষ সংশোধিত আইনের আলোকে তামাক নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০১৫ আইনটি পাস হয়। সংশোধিত আইন ২০১৩ ও বিধিমালা ২০১৫-তে নারী-শিশুসহ সব অধূমপায়ীকে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার থেকে রক্ষায় কঠোর বিধান রাখা হয়েছে। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার রোধে করা আইনে প্রকাশ্যে ধূমপানের জরিমানা ধরা হয়েছিল ৫০ টাকা। আইনে বিভিন্ন ধারার উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগ নেই। পাবলিক প্লেসে সবচেয়ে বেশি এই আইন লঙ্ঘন হচ্ছে। আর এর শিকার হচ্ছে অধূমপায়ীরা। বিশেষ করে শিশু আর মহিলারা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকরাই পাবলিক প্লেসে দেদার ধূমপান করছে। এ ব্যাপারে গণসচেতনার জন্য সরকারি কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায় না। যার ফলে তামাক বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানদের বিক্রয় সাফল্য দিনকে দিন বেড়েই চলছে। কিন্তু বহির্বিশ্বে এ ব্যাপারে কঠোর আইনের প্রয়োগ রয়েছে। ধূমপান নিয়ন্ত্রণে নতুন প্রস্তাব পাস হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে। প্রস্তাব অনুযায়ী, ধূমপানজনিত রোগের একটি গ্রাফিকস ছবি থাকবে ৬৫ ভাগ সিগারেটের প্যাকেটে। এর ফলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়বে। প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ করা, তামাক খামারগুলোর ওপর সীমাবদ্ধতা, বিজ্ঞাপনের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে গত একদশকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোয় ধূমপায়ীর সংখ্যা ৪০ ভাগ কমে এসেছে।

অস্ট্রেলিয়ায় সিগারেটের প্যাকেট দেখলেই আপনি চমকে উঠবেন। ঝাঁজরা হওয়া ফুসফুস, ঘোলাটে চোখ, প্রি-মেচিউর শিশু বা অকাল প্রসূত শিশুর গ্রাফিকস ছবি দেওয়া আছে এসব প্যাকেটে, যা আপনাকে ধূমপান থেকে বিরত রাখার জন্য যথেষ্ট। তরুণদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। আর এ কারণেই অস্ট্রেলিয়ায় ধূমপায়ীদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্যাকেটে এসব ভয়াবহ ছবি দেওয়ার ফলও পেয়েছে তারা হাতেনাতে। ধূমপায়ীর সংখ্যা কমে গেছে ১৫ ভাগ।

কয়েক বছর আগে ভুটান সরকার তার ‘ধূমপান নিয়ন্ত্রণ আইন’ কঠোরভাবে প্রয়োগ করা শুরু করেছে। এই আইন ১ জুন, ২০০৯ সাল চালু হয়। এই আইন অনুসারে আইন ভঙ্গকারী যেকোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে চতুর্থ মাত্রার অভিযোগ আনা যেতে পারে, যার ফলে তার ৫ থেকে ৯ বছরের জেল হতে পারে। ২০০৫ সালে, ভুটানের সংসদ সদস্যরা সব ধরনের তামাকজাত পণ্যের বিক্রি নিষিদ্ধ করেছিল। এর ফলে ভুটান বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্রে পরিণত হয়, যারা অন্যদের সবার আগে ধূমপান নিষিদ্ধ করে। এতে দৃশ্যত আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যম ভুটানি কর্মকর্তাদের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায় এবং তাদের প্রতি প্রীত হয়। এমনকি সে সময় কর্মকর্তারা বৈধভাবে কেনা তামাকের মজুদ পুড়িয়ে দেয়, যার মূল্য ছিল কয়েক মিলিয়ন নগুলট্রম (ভুটানি মুদ্রা)।

এ ছাড়া তামাক চাষ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা আমাদের আতঙ্কের বিষয়। প্রথমে মানিকগঞ্জ থেকে শুরু হয়েছিল। এখন রংপুর, পার্বত্য অঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলায় তামাকের চাষ হচ্ছে। ভবিষ্যতে চাষিরাই এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ, দু-একবার তামাকের চাষ করলে সে জমির উর্বরতা শক্তি অনেক কমে যায়। ফলে চাষিরা অন্য ফসল উৎপাদনে আর লাভবান হবেন না। তামাকের ফলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে। কৃষিজমির ক্ষতি হচ্ছে। পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। সারা বিশ্বেই কমবেশি ধূমপানের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ থাকলেও আমাদের দেশে এর কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় না। যার ফলে হাজার হাজার লোক এই বিষপান করে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ছে আর তার সঙ্গে অধূমপায়ীদেরও দিয়ে যাচ্ছে বিবর্ণ সকাল।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close