সাধন সরকার

  ১৫ আগস্ট, ২০১৮

মতামত

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০

বাংলাদেশ পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীবিধৌত পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ। ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নদ-নদী থাকা সত্ত্বেও টেকসই পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা এখনো গড়ে ওঠেনি। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদী রয়েছে। ভারত থেকে শুরু হয়ে নদীগুলো বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। নদীগুলো বর্ষাকালে প্রচুর পানি ও পলি নিয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে ধাবিত হয় এবং বহু চর জাগিয়ে তোলে। অন্যদিকে শুকনো মৌসুমে প্রয়োজনীয় পানির অভাবে বাংলাদেশ ভুগতে থাকে। ভারতীয় অংশে উজানে নদীগুলোর গতিরোধ করা হলে কিংবা পানি প্রত্যাহার করা হলে বাংলাদেশের নদীগুলোর পানিপ্রবাহ একেবারে কমে যায়। নদ-নদী শুকিয়ে যায়। বেশি বেশি করে পলি জমে ও চর জাগে। সেচব্যবস্থা ও ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। দেশের কোনো কোনো অংশে দেখা দেয় মরূকরণ। আবার বর্ষা মৌসুমে দেখা যায় ঠিক তার উল্টো চিত্র। বর্ষায় যত পানি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে যায়, তার ৯০ ভাগই আসে ভারতের উজান থেকে আসা ঢলের পানি। ফলে দেখা দেয় বন্যা ও জলাবদ্ধতা। বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর গভীরতা এমনিতেই কম থাকায় দীর্ঘসময় ধরে বন্যায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ধ্বংস হয় জীববৈচিত্র্য, নষ্ট হয়ে যায় বসতবাড়ি ও কোটি কোটি টাকার ফসল।

দীর্ঘদিন ধরে দুদেশের অভিন্ন নদীগুলোর ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা চললেও তা আলোর মুখ দেখেনি। ফলে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে বন্যার কারণে জানমালের ক্ষতিসহ ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। দীর্ঘসময় ধরে আলোচনার পরও তিস্তা চুক্তি এখনো অন্ধকারে। শুকনো মৌসুমে তিস্তায় পানি না থাকায় প্রতি বছর উত্তরাঞ্চলে সেচকাজে ও ফসল উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। তাই টেকসই পানি ব্যবস্থাপনার ওপর বাংলাদেশের উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎনির্ভর করছে। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ হিসেবে পরিচিত। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন এ দেশের নিত্যসঙ্গী। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে ভুগছে দেশ। দক্ষিণাঞ্চলে দেখা দিচ্ছে লবণাক্ততা, প্রকট আকার ধারণ করছে মিঠাপানির সংকট। যতই দিন যাচ্ছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা করে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এখন বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এ বাস্তবতায় বন্যা ও জলাবদ্ধতাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে কৃষি, টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা, পানি ব্যবস্থাপনার মতো জনগুরুত্বপূর্ণ ও একটি দেশের টিকে থাকা বিবেচনায় নিয়ে সমন্বিত, পরিকল্পিত ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা এখন সময়ের দাবি। সরকার টেকসই পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে শতবর্ষব্যাপী ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বা ‘ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ গ্রহণ করেছে। যদিও এই পরিকল্পনাটি ছিল অনেক আগের। সম্প্রতি এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে প্লাবিত হচ্ছে দেশের ব্যাপক অঞ্চল, আবার গ্রীষ্মকালে দেখা দিচ্ছে খরা। এ অবস্থা অনেক বছর ধরে বাংলাদেশের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ এই ক্ষয়ক্ষতিকে আরো ত্বরান্বিত করছে। উভয়মুখী সংকটে পড়ে বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ সংকট ও সমস্যা থেকে পরিত্রাণের অন্যতম পথ ও পন্থা হতে পারে ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ বাস্তবায়ন।

বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পানি ব্যবহারে অধিকতর দক্ষতা আনয়ন, সমন্বিত ও টেকসই নদী ব্যবস্থাপনা, জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, ভূমি ও পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য এই পরিকল্পনা ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে প্রায় ৮০ ভাগের বেশি পানি নষ্ট হয় অন্যত্র চলে যাওয়ার কারণে। নদ-নদীর নাব্য না থাকায় পানি ধরে রাখা সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে সমাধান মিলবে এই বৃহৎ পরিকল্পনায়। দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে ‘মধ্যম আয়ের দেশে’ উপনীত হচ্ছে যাচ্ছে। সুতরাং উন্নয়নকে সামনে রেখে টেকসই পানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ লক্ষ্যে ‘সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়’ ব-দ্বীপ পরিকল্পনাটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভাটির দেশ বলে কি ক্ষয়ক্ষতি বাংলাদেশের অনিবার্য বাস্তবতা? বাংলাদেশ আর কতকাল উজানের ঢলের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে? আর কতকাল শুকনো মৌসুমে নদ-নদীর ন্যায্য হিস্যা চেয়ে অন্য দেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে? সময় এসেছে অন্যতম এই বৃহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে টেকসই পানিসম্পদসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সমস্যা সমাধান করে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার। তবে পরিবর্তনশীল বাংলাদেশে ব-দ্বীপ প্রকৃতি ব্যাপকভাবে বিশ্লেষণ করে সম্পূর্ণ দেশীয় পরিবেশ-প্রতিবেশ বিবেচনায় নিয়ে এ বৃহৎ পরিকল্পনাটি বাস্তবসম্মত ও সমন্বিত করা প্রয়োজন। নেদারল্যান্ডসের কারিগরি সহায়তার পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের অর্থ সহায়তা থাকলেও মনে রাখতে হবে এটি বাংলাদেশের সম্পূর্ণ নিজস্ব মহাপরিকল্পনা। তাই এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের যুক্ত রাখা উচিত। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি দেশের নদ-নদীগুলো যেন ক্ষতি ও ধ্বংসের সম্মুখীন না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, এ পরিকল্পনাটি জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। তাই পরিকল্পনাটি সমন্বিত, সুপরিকল্পিত, সর্বজনীন ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে এগিয়ে যেতে থাকলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর পাশাপাশি বন্যা মোকাবিলা ও শুকনো মৌসুমে প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা মিটিয়ে স্বনির্ভর ও উন্নত বাংলাদেশ গঠনে ব্যাপক সহায়ক হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

ংধফড়হংধৎশবৎ২০০৫@মসধরষ.পড়স

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close