বিশ্বজিত রায়

  ১৫ আগস্ট, ২০১৮

নিবন্ধ

মুজিব তুমি অবিনাশী

রক্তক্ষরণের মাস। ব্যথায় বিদীর্ণ হওয়ার মাস। আগস্ট মানে জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া কলঙ্কের চাপ; অসহনীয় বেদনা বিধুর বিপন্ন ভারী বোঝা। কলঙ্কিত এই আগস্টে রচিত হয়েছিল ইতিহাসের নির্মম নৃশংসতম কালো অধ্যায়। জাতির কিছু কুরুচিপূর্ণ ক্ষমতালিপ্সু নরপশু স্বাধীনতা ও স্বাধীন বাংলার স্থপতি, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে পৃথিবীর বুকে জন্ম দিয়েছিল দুঃসাহসিক এক দ্রোহ দৃষ্টান্ত। বাঙালি পরিচয়ভুক্ত বর্বর ঘাতকরা আমাদের কপালে লিখে দিয়ে গেল সর্বজন নিন্দিত কলঙ্কের চিরন্তন দুর্নাম। যে দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, বদনাম বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন। তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ ও একটি বীরত্বপূর্ণ জাতিকে তমসাচ্ছন্ন পথে পতিত করেছিল। জাতিকে করেছিল অভিভাবকশূন্য।

পঁচাত্তর পনেরো আগস্ট। শেষ শ্রাবণের কলঙ্কিত রাত সেটি। ঘুটঘুটে অন্ধকারের জাল ভেদ করে মানব পৃথিবীর বঙ্গীয় ব-দ্বীপে আছড়ে পড়েছিল জোছনা ঝলকানি অশনি আলোকরশ্মি। সেদিন নিস্তব্ধ রাতের নিঃসঙ্গ প্রকৃতি নিরুপায় নিয়তির কাছে হার মেনেছে। রাজধানী শহরের অলিগলিতে হেঁটে চলা বেওয়ারিশ কুকুরগুলো দিকভ্রান্ত পথিকের মতো এদিক-সেদিক ছুটে বেড়িয়েছে। বিপদ ভয়ংকর অপকর্ম আঁচ করতে পেরে মহাপ্রলয়ের অপূরণীয় যন্ত্রণায় কাতর কুকুররা তুলেছিল দুঃখখুই। নির্জন শহরের প্রাণিপতঙ্গ নিশাচররা অচেনা ভাষায় জানিয়েছে প্রতিবাদ। দুঃখ সইতে না পেরে আকাশের ছাইবর্ণা উড়ন্ত মেঘমালা বৃষ্টি হয়ে ঝড়েছে ব্যথিত বাংলার পথে পথে। শহরের যত্রতত্র ঘুরে ফেরা উন্মাদ আওলাকেশী ছিন্নবস্ত্রে আবৃত্ত ধুলাবালি বসনের পাগলিনী প্রাণটাও বকেছে অস্থির প্রলাপ। শুধু ব্যতিক্রম মনুষ্য পরিচয়ধারী ওই নরপশুর দল। তখন বন্দুক বুলেটে সজ্জিত বর্বর বাহিনী এগিয়ে চলেছে স্থপতি বাংলা বধের ঘৃণ্য মানসে। বাঙালি বাংলা তখন গভীর ঘুমে অচেতন।

বাংলার কি সর্বনাশ যে হতে যাচ্ছে কেমনে টের পাবে সদ্য স্বাধীনতায় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়া মুক্ত বাঙালি। তাদের ভরসাবিগ্রহ মুক্তির মহামানবকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার হীন-উদ্দেশ্যধারী বাঙালি কুলকলঙ্ক গোষ্ঠী ইতিহাসের মর্মন্তুদ অপকর্ম সাধনের জন্য সেই রাতের নির্জননিশি লগ্নটাকেই বেছে নিয়েছিল। ঘুমন্ত বাংলাদেশ তখন নিশিবসানের নিদ্রিত প্রতীক্ষায় নিঃশ্বাস ফেলছে। কেউ কি জানত তাদের ঘুমে রেখেই হত্যা করা হবে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। না, বঙ্গবন্ধুর প্রিয় বাঙালি কখনো আঁচ করতে পারেনি এমনটি। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট নীরবনিশির শেষলগ্নে বিদঘুটে বুলেট শব্দে প্রকম্পিত হয় ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরের আকাশ-বাতাস। জলপাইরঙা সেনা রাইফেলের বুলেটবারুদ ঝাঁজড়া করে দেয় রাজনীতি, শান্তি, স্বাধীনতা, মুক্তি ও মানবতার মহাকবি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসাসমৃদ্ধ বঙ্গবক্ষ। নিমিষেই নেতিয়ে পড়ে বাংলাদেশ। হু-হু করে কেঁদে উঠে মানবতা, স্তম্ভিত হয়ে পড়ে রাত সমাপন মুহূর্তের শীতল প্রকৃতি পরিবেশের অনুষঙ্গগুলো। সন্তানের প্রাণবধ বেহায়াপনা বেদনায় শোকের অতলে নিমজ্জিত নির্বাক বঙ্গমাতা বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। ততক্ষণে রক্তলাল ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িটি। রক্তবীভৎস হোলি খেলায় উন্মাতাল নিকৃষ্ট-বদরা বিকৃত উল্লাস আর অমার্জিত বাহানায় বেরিয়ে পড়ে রক্তমাখা বঙ্গবন্ধুর নিস্তেজ দেহ ফেলে।

বাঙালি বাংলাকে অভিভাবকশূন্য করে হন্তারক দল ফিরে গেছে তাদের আপন গন্তব্যে। প্রাণশূন্য বঙ্গবন্ধু তখনো পড়ে আছেন বত্রিশ নম্বরের রক্তাক্ত মেঝেতে। অবশেষে জাতির জনকের নিথর দেহটি কড়া পাহারায় নিয়ে যাওয়া হয় টুঙ্গিপাড়ার দুর্ভাগা পল্লীতে। শোকে স্তব্ধ আলো-বাতাসের নিঃশব্দ কান্নায় ভারী টুঙ্গিপাড়ার মৃত্তিকা ময়দানে নামানো হয় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর বিপন্ন দেহ। তখন অযতœ-অবহেলার চরম বাস্তবতা দেখে টুঙ্গিপাড়ার মাটি প্রকৃতি। বাংলার মাটি মানুষের কল্যাণে প্রাণ উৎসর্গকারী শুচিশুদ্ধ আত্মার দীর্ঘদেহী মানুষটির সঙ্গে বাঙালির নিম্নশ্রেণিভুক্ত ঘৃণ্য গোষ্ঠীর অসহনীয় আচরণে মানবতার দেবী মুখ লুকিয়ে লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করেন। পরাধীন বাংলা ও মুক্তিকামী বাঙালির জন্য নিজেকে আজন্ম সঁপে দেওয়ার অপরাধ এবং মুক্ত স্বাধীন ভূমের বিধ্বস্ত বাংলায় শান্তিসুখের চিরস্থায়ী কল্যাণ কামনান্তে ব্যতিব্যস্ততার অপরাধই হয়তো বঙ্গবন্ধুকে দস্যুপনার দুর্দান্ত প্রতিযোগিতায় প্রাণ বলিদান করতে হয়েছে।

অস্ত্র হাতের প্রাণহরণকারী মহড়া শেষে শবদেহ সৎকারে ধর্মীয় বিধানের পবিত্র ক্রিয়াদি সম্পন্নেও ছিল হায়েনা শক্তির অশুভ দাম্ভিকতা। মুর্দা মানুষটিকে কবরস্ত করার পূর্ব আত্মা শুচিতায় যা করার কথা ছিল, তার কিছুই করতে দেওয়া হয়নি। ভীতসন্ত্রস্ত টুঙ্গিপাড়ার স্থানীয় কয়েকজন ডেকে এনে লাশ দ্রুত মাটিচাপা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর বুলেট বিকৃত দেহ দেখে ভয়াতুর স্থানীয় দু-একজন মৃত মানুষটির সৎকারপূর্ব রীতি নিয়ম রক্ষার অনুরোধ জানালে তার অনুমতি মেলেনি বরং দ্রুত কাজ সম্পাদনের তাগিদ দেওয়া হয়। এভাবেই সম্পূর্ণ অবজ্ঞা-অবহেলার অযাচিত অপকর্মে চিরশায়িত হন স্বাধীন দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি বাংলাদেশের জন্য অজস্র অবদানের পাহাড়সম খ্যাতিচূূড়ায় আরোহিত মানুষটির কোনো দিকই টলাতে পারেনি অস্ত্র হাতে দানবীয় রূপধারণকারী খুনিবাজ পাষাণী হৃদয়। কত বড় অপরাধে অপরাধী হলে একজন মানুষকে এমন কঠিন পরিণতি বরণ করতে হয়। সেটা কেবল সৃষ্টিকর্তাই নির্ধারণ করতে পারবেন। জানি না কোন অপরাধে ইতিহাসের বর্বরোচিত কালো অধ্যায়ের জন্ম দিল বাঙালি বীভৎসবাদীরা।

বাঙালি এমনটি করতে পারে তা কখনো বিশ্বাসই করতেন না মানবতার বিস্ময় বঙ্গবন্ধু। তাঁর সাহস, প্রজ্ঞা, বীরত্বের কাছে চিরশত্রু পাক ভুট্টো-ইয়াহহিয়া ও বৈশ্বিক শক্তিধর ক্ষমতা মাথা নত করলেও কেবল বাঙালি ওই সারমেয় শাবকরাই বিশ্বাসঘাতকতার চূড়ান্ত নজির স্থাপন করল। হাজার বছরের শৃঙ্খল ভেঙে বঙ্গবন্ধু বাঙালির জন্য যে শাশ্বত মুক্তির ভিত রচনা করেছিলেন, সেই কৃতজ্ঞতাবোধকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুর সমগোত্রীয় জাতির অকৃতজ্ঞ অসুররা বিশ্বাস ভালোবাসার সুপরিপক্ব ভিতকেই নাড়িয়ে দেয়নি চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়েছে একটি জাতি তথা মানববিশ্বের মহামহিম বাংলা গড়ার অন্যতম কারিগর নিপুণ মানুষটিকে। যার কোমল মনের বিস্তৃত অঙ্গনে শুধু বাঙালির বসতই ছিল না, আপন অস্তিত্বে তিনি শোষিত বাংলার সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির স্বপ্নই সর্বদা লালন করে গেছেন। বাঙালির আস্থা, বিশ্বাস, ভরসার প্রতিদানও দিয়েছিলেন নিজেকে মৃত্যুর অগ্নিকু-লীতে ছুড়ে দিয়ে। মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় রেখে শত্রুপক্ষের প্রতি একটি অনুরোধের কাতর উক্তি তুলে ধরে মৃত্যুমুখী বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাকে মেরে ফেলে দাও বাধা নেই, তবে মৃত্যুর পর লাশটা আমার বাঙালির কাছে পৌঁছে দিও।’

একটি জাতিকে কতখানি ভালোবাসলে, কতটুকু বিশ্বাস করলে, কতটুকু আপন ভাবলে একজন নেতা এমন কথা বলতে পারেন। বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে বিশ্বাস করেছিলেন বলেই প্রাণবধের চতুর চক্রান্তবিষয়ক বিদেশি গোয়েন্দা তথ্য পেয়েও প্রাণপ্রিয় জাতিকে অবিশ্বাস করা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সম্ভব হয়নি। বিশ্বাস, ভালোবাসা ও প্রগাঢ় মমত্ববোধের আস্তাশীল অঙ্গনে আবদ্ধ বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপ্রধানের সরকারি বাসভবন ছেড়ে নিরাপত্তাহীন নিজস্ব বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এমন সাদামাটা জীবনযাপনে বিস্মিত ভিনদেশি সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, এখানে যে আপনার নিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছে। সরকারি বাসভবন ছেড়ে আপনি এখানে কেন? বাঙালিপ্রিয় বঙ্গবন্ধু দৃঢ়চিত্তে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি সাধারণ মানুষের নেতা, নিরাপদচৌকিতে থাকলে নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে সাধারণ মানুষ সহজে আমার কাছে ঘেঁষতে পারবে না। এমন পরিবেশই আমার উপযুক্ত স্থান।’

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close