এস এম মুকুল

  ১২ আগস্ট, ২০১৮

সমাচার

আশার আলোয় বাংলাদেশ

শেরপুর এলাকার বাসিন্দা শাহাদাৎ চৌধুরী আঙুলের বিজ্ঞানী হিসেবে খুব নামডাক। ইতোমধ্যেই তিনি মোবাইল ফোনে গাড়ির নিরাপত্তা, মোবাইল ফোনের ওয়াটার প্রুফ কেসিং, মোবাইল ফোনের ক্ষতিকর রেডিয়েশন নিরাপত্তা, আজীবন বাল্ব, হাইটেক আইপিএস, মোবাইল ফোন ব্যাটারির লং সিস্টেমসহ নানান প্রযুক্তিভিত্তিক জিনিস আবিষ্কার করে খ্যাত হয়েছেন। তার আলোচিত আবিষ্কার মাসিক মাত্র ২০০ টাকায় রান্নার জন্য সাশ্রয়ী রিচার্জেবল চুলা। তার আবিষ্কৃত চুলায় তিন টাকার জ্বালানি খরচ করে এক ঘণ্টা রান্না করা সম্ভব। চুলা জ্বালাতে সময় লাগে দুই মিনিট। কালি ও ধোঁয়াহীন এই চুলায় আগুন হবে গ্যাসের চুলার চেয়েও তীব্র। চুলাটি বিদ্যুতের সাহায্যে ছয় থেকে আট ঘণ্টা রিচার্জ করলে ১২ থেকে ৩০ দিন দৈনিক তিন থেকে চার ঘণ্টা রান্নার কাজ চালানো যাবে। সে হিসেবে এই চুলায় মাসে এক টাকার বিদ্যুৎ খরচ হয়। এই চুলাতে কাঠকয়লা, পীট কয়লা ও বিভিন্ন উপাদান দিয়ে এক ধরনের জ্বালানি উৎপন্ন করা হয়েছে। শাহাদাতের মতে, চুলাতে জ্বালানি হিসেবে কাঠকয়লা ও ইটভাটার পরিত্যক্ত কয়লা সরাসরি ব্যবহার করা যাবে। এ চুলায় হিট চেম্বার এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে উৎপাদিত তাপ বাইরে বের না হয়। মজবুত অবকাঠামোর জন্য চুলার স্থানান্তরে ভাঙার সম্ভাবনা কম। পাঁচ-সাত সদস্যের পরিবারে রান্নার জন্য রিচার্জেবল এই ইলেকট্রনিক চুলার দাম ১ হাজার ৫০০ টাকা মাত্র। পল্লীবিদ্যুৎ এখন দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় গ্রামে গ্রামে পৌঁছে গেছে। তাই এ চুলার ব্যবহার ছড়িয়ে দেওয়া অনেক সহজ এবং প্রয়োজনীয়ও বটে।

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এ দৈশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যপীড়িত। অভাবের কারণে এ দেশের অনেক পরিবারের সদস্য কাক্সিক্ষত শিক্ষাপর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। এমন দেশে স্বল্পশিক্ষিত নাগরিকদের সাশ্রয়ী এসব উদ্ভাবনসমৃদ্ধ সম্ভাবনার হাতছানি দেয়। দেশের মানুষের মেধাকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে স্বনির্ভরতার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো খুব সম্ভব। আমাদের এই আশাজাগানিয়া সম্ভাবনাময় উদ্ভাবকদের মেধাকে কাজে লাগানোর কথা সরকারকে ভাবতে হবে। ফলে গড়ে উঠবে প্রযুক্তির কারখানা। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রা।

রাজশাহীর নাটোরে খোলাবাড়িয়া একটি গ্রামের নাম। গ্রাম তো গ্রামই। গ্রামের নাম তো নামই। নামের কোনো পরিবর্তন হয় না বলেই জেনে এসেছি। কিন্তু এবারের গল্পে ঘটেছে তার ব্যতিক্রম। গ্রামের এক বৃক্ষপ্রেমিক আফাজ পাগলা বাড়ির পাশে ৫টি ঘৃতকুমারীর গাছ রোপণ করে। এই ঘৃতকুমারীর গাছই বদলে দিয়েছে গ্রামটির নাম। বদলে দিয়েছে গ্রামের আর্থিক অবস্থা। খোলাবাড়িয়া এখন ঔষধি গ্রাম নামেই অধিক পরিচিত। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে সেই আফাজ পাগলার ঘৃতকুমারীর চারা রোপণ বদলে দিয়েছে গ্রামবাসীর দৃষ্টিভঙ্গি। ঔষধিগুণসম্পন্ন গাছের বদৌলতে বদলে গেছে পুরো গ্রামবাসীর জীবনযাত্রা। বদলে গেছে তাদের চিন্তা-চেতনা এবং কর্ম। গ্রামের ১ হাজার ৬০০ পরিবার এখন ঔষধি গাছের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করেন। গ্রামের চারপাশে বিঘার পর বিঘা জমিতে ঘৃতকুমারীর চাষাবাদ। যাদের জমিজমা নেই তারাও বাড়ির আঙিনায় যেখানে সুযোগ আছে সেখানেই চাষ করছেন ঘৃতকুমারীর। এই গ্রামে মোট ২৫ হেক্টর জমিতে ঔষধি গাছের চাষাবাদ হয়। আশ্চর্য এই ঔষধি গ্রামের রাস্তার মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠেছে ভেষজ উদ্ভিদ বিক্রির দোকান। শুধু নামে ঔষধি গ্রাম নয়, গ্রামের মানুষের জীবন-জীবিকার একমাত্র মাধ্যম এখন ভেষজ চাষাবাদ। বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য সেখানে গড়ে উঠেছে ‘ভেষজ বহুমুখী সমবায় সমিতি’। সমিতির মাধ্যমে ক্রেতা-বিক্রেতা আর উৎপাদনকারীর সমন্বয়ে জমে উঠেছে ভেষজ বিপ্লব। আফাজ পাগলার ভেষজ প্রেমের অনুসারী হয়ে গ্রামের সবাই এখন ভেষজচাষি। গ্রামের নারীরা এ কাজে অনেক এগিয়ে। ঔষধি গাছের চাষাবাদের জন্য এ গ্রামের নারীদের বলা হয় ‘বনজরানী’। এই গ্রামের মাটিরও নাম দেওয়া হয়েছে ভেষজ মাটি। আফাজ পাগলের ১৭ কাঠার চাষের জমিতে ৪৫০ প্রজাতির ভেষজ নার্সারি গড়ে তোলা হয়েছে। গ্রামে এ রকম আরো আছে আটটি নার্সারি। এসব নার্সারিতে আছেÑ বাসক, সাদা তুলসী, উলট কম্বল, চিরতা, নিম, কৃষ্ণতুলসী, রামতুলসী, ক্যাকটাস, সর্পগন্ধা, মিশ্রিদানা, হরীতকী, লজ্জাবতীসহ হরেক রকমের ঔষধি গাছ। গ্রামটিতে ৫০০ কৃষক সব সময় ভেষজ চাষাবাদ করেন। কৃষকদের স্বার্থে সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘ভেষজ গাছ-গাছড়া উৎপাদন সমবায় সমিতি’। জানা গেছে, দেশে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ঔষধি কাঁচামালের স্থানীয় বাজার রয়েছে। এ ঔষধি গ্রামই এ চাহিদার অধিকাংশের জোগান দেয়। স্কয়ার ও এসবি ল্যাবরেটরিজের মতো প্রতিষ্ঠান এখান থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে। ঔষধি গ্রামের এই ভেষজ চাষাবাদ এখন ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিবেশী গ্রামগুলোয়ও। এ যেন এক ভেষজ বিপ্লব কাহিনি। এই যে ভেষজ বিপ্লব তার পেছনে নেপথ্য নায়ক একজনই। আফাজ পাগল। গ্রামজুড়ে এখন পাগল আর পাগল। যে যত বেশি পাগল, সে তত বড় কবিরাজ। সব কবিরাজের গুরু আফাজ পাগল। তিনিই-ই পথ দেখিয়েছেন মানুষদের। উৎসাহ দিয়েছেন, বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েছেন এমনকি সহযোগিতাও করেছেন ভেষজ চাষাবাদে। এখন সবাই একই পথের পথিক। বাংলাদেশে বোধকরি এমন গ্রাম খুঁজে পাওয়া কঠিন, যেখানে সব মানুষ একই পেশায় নিয়োজিত। ভেষজ গাছ-গাছড়ার চাষাবাদে আফাজ পাগলের এই দৃষ্টান্ত সবার জন্য অনুসরণীয় হোক।

ঔষধি গ্রামের পর শুনুন এক মুড়ি গ্রামের গল্প। কুড় কুড়ে, মুড় মুড়ে মুড়ি ভাজা বাঙালির প্রাচীন মুখরোচক খাবার। মুড়ি ভাজাকে উপজীব্য করে জীবিকা নির্বাহ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ। এদের মধ্যে নারীরাই উল্লেখযোগ্য। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে মুড়ি ভাজা পেশাদার বিচ্ছিন্নভাবে পাওয়া যায়। কিন্তু গ্রামের অধিকাংশ মানুষই এ পেশার ওপর নির্ভরশীল এমন গ্রাম খুঁজে পাওয়া কঠিন। একটি নয় দুটি নয় ঝালকাঠির দপদপিয়া ইউনিয়নের রাজাখালী, দপদপিয়া, তিমিরকাঠি, ভরতকাঠি ও জুরাকাঠি এই পাঁচটি গ্রামের অধিকাংশ মানুষ মুড়ি তৈরির ওপর জীবিকা নির্বাহ করে। এই গ্রামগুলোয় রাত-দিন চলে মুড়ি তৈরির ব্যস্ততা। এই দপদপিয়ায় নাকি বছরে প্রায় দুই কোটি টাকার মুড়ি উৎপাদন হয়। এখানে দুই পদ্ধতিতে মুড়ি ভাজা হয়। যারা একটু সচ্ছল, তারা নিজেরা বাজার থেকে ধান কিনে আনেন। তারপর বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত করে চাল তৈরি করে মুড়ি ভেজে নিজেরাই বাজারজাত করেন। আবার যারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল, তারা আড়তদারদের কাছ থেকে বিনামূল্যে চাল আনেন। এই চালে মুড়ি ভেজে আড়তে সরবরাহ করে। এতে তাদের লাভ কম হয়। তথ্যে জানা গেছে, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ দৈনিক দুই মণ মুড়ি ভাজতে পারে। এই গ্রামগুলোয় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পালাক্রমে মুড়ি ভাজেন। মুড়ি তৈরিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে অনেক পরিবার দেখেছে সচ্ছলতার মুখ। তাই মুড়ি ভাজা এখন গ্রামে একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে। একই স্থানে সমজাতীয় পেশা জনপ্রিয় হলে সে পেশাকে কেন্দ্র করেই শিল্পের জন্ম হয়। আমাদের জীবন-জীবিকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এসব শিল্প দেশজ স্বনির্ভরতার প্রতীক। তবে এ শিল্পেরও অনেক সমস্যা আছে। মেশিনের মাধ্যমে সার মিশ্রিত মুড়ি অপেক্ষাকৃত কম খরচে তৈরি করে কম মূল্যে বাজারজাত করার কারণে এই গ্রামবাসীর রোজগারের পথের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব মুড়ি সহজ উপায়ে সার মিশিয়ে তৈরি হয়। স্বাস্থ্যের জন্য এগুলো খুবই ক্ষতিকর। সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে এই মুড়ি গ্রামকে বাণিজ্যিক মুড়ি উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কথা ভাবা যেতে পারে। আমরা প্রত্যাশা করব, মুড়ি গ্রামগুলোকে বাণিজ্যিকীকরণ করে আরো অধিক উৎপাদন এবং এ পেশায় ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসবেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close