রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১১ আগস্ট, ২০১৮

মতামত

গণতন্ত্রের ভরা মৌসুম

বর্তমান নিয়ে ভাবনা এবং যন্ত্রণা নতুন নয়। আবার সুখের চিন্তাও এর সঙ্গে সংযুক্ত। এসব এ জন্য যে, ভবিষ্যৎকে কল্পনা করা যায়, নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। অথচ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে জীবন স্বস্তিময় হওয়ার সম্ভাবনায় সন্দেহ থেকে যায়। ফলে বর্তমান ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায় মানুষ সদাসন্ত্রস্ত ও ব্যস্ত। এ জন্যই হয়তোবা বোদ্ধাজনরা অতীতকে নিয়েও ভাবতে বলেছেন। প্রতীথযশা এক দার্শনিক এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, অতীতকে যারা ভুলে যায় অথবা প্রয়োজনেও স্মরণ করে না, অতীত তাদের কাছে বারবার ফিরে আসে। অর্থাৎ এ সময়ের সব সুখ আর যন্ত্রণা নতুন আবরণে আরো আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। এ ঘটনাগুলোর পুনঃপ্রকাশ ঘটছে বিশ্বব্যাপী। ধনী এবং উন্নত দেশ বলে পরিচিত বিশ্বের জনপদের এ অবস্থা থেকে অবশ্য অনুন্নত ও অধিকৃত দেশগুলোর অবস্থার প্রকাশ ভিন্ন হলেও তারা ফল ভোগ করছে একই রকমের। গণতন্ত্র আজ কোথায় কী আবস্থায় আছে তা নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। ক্ষমতাসীন সরকার তার শাসনকে নিষ্কণ্টক ও নির্ঝঞ্ঝাট করার লক্ষ্যে গণতন্ত্রের অনেক মূল্যবোধকেই যে অবজ্ঞা-উপেক্ষা করছে, তা অস্বীকার করা যাবে না।

বলা নিষ্প্রয়োজন, গণতন্ত্রের এই দুর্বল উপস্থিতির কারণে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি গভীর সংকটে নিপতিত হয়েছে। এ সংকট দেশ ও জাতিকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা নিয়ে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। গত ৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার থিয়েটারে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই সাবেক ছাত্র, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলেছেন, অতীতে বাংলাদেশ যত ধরনের রাজনৈতিক সংকট বা অনিশ্চয়তার মোকাবিলা করেছে, এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে তার আপাত সাদৃশ্য থাকলেও এবারের সংকট অতীতের যেকোনো সময়ের চেযে ভিন্ন এবং আরো গভীর। এখন রাজনীতিতে যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, তা আসলে ‘হাইব্রিড রেজিম’ বা দো-আঁশলা ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় দৃশ্যত গণতন্ত্রের কিছু কিছু উপাদান থাকলেও সেগুলো প্রধানত শক্তি প্রয়োগের ওপর নির্ভর করে। ফলে রাষ্ট্রের নিপীড়ক যন্ত্রগুলো আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে এবং তাদের এক ধরনের দায়মুক্তি দেয়। আমাদের দেশে গণতন্ত্র আছে কী নেই, এ এক অমীমাংসিত বিতর্ক। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে প্রসঙ্গটি সামনে চলে আসে। সাধারণত যারা অর্থাৎ যে দল রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকেন, তারা বলেন, দেশে গণতন্ত্রের ভরা মৌসুম চলছে, আর যারা ক্ষমতার বাইরে থাকেন, তাদের ভাষায়, দেশের গণতন্ত্র চৈতালীখরায় আক্রান্ত। তবে, বাস্তবতা হলো, যে গণতন্ত্রের জন্য এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে, বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, জীবন দিয়েছে, কাক্সিক্ষত সে গণতন্ত্রের দেখা আজও মেলেনি। অবশ্য মাঝেমধ্যে গণতন্ত্রের সূর্য যে বাংলাদেশের আকাশে মুখ দেখায়নি তা কিন্তু নয়। তবে, তা ক্ষণিকের জন্য। অনাকাক্সিক্ষত কালো মেঘ এসে গণতন্ত্রের সে সূর্যকে ঢেকে দিয়েছে। এ যেন সেই রবীন্দ্রসংগীতের মতোÑ ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই নাÑকেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে তোমারে দেখিতে দেয় না...’। দেশবাসী কারো বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্যের মাপকাঠিতে গণতন্ত্রের উপস্থিতি-অনুপস্থিতি বিচার করতে চায় না। বিদ্যমান পরিবেশ-পরিস্থিতি থেকেই তারা বুঝে নিতে আগ্রহী গণতন্ত্রের অবস্থা কেমন। দেশে যদি পূর্ণমাত্রায় গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজমান থাকে, তাহলে মির্জা আলমগীর সাহেবরা তার স্বরে চিৎকার করলেও কেউ সে কথায় কর্ণপাত করবে না।

যদি গণতন্ত্র না থাকে বা জনগণ সে অধিকার নির্বিঘেœ ভোগ করতে না পারে, তাহলে ওবায়দুল কাদের সাহেবরা হাজারো কণ্ঠে ‘গণতন্ত্র আছে, গণতন্ত্র আছে’ বলে গলা ফাটালেও কেউ তা বিশ্বাস করবে না। সুতরাং বিএনপি মহাসচিব ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যকে দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখাই বোধকরি শ্রেয়। যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ বিতর্কের পুনরুত্থান, বিষয়টি আমরা সে প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করি। সংবিধান তার ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৩৯ অনুচ্ছেদের দ্বারা নাগরিকদের চলাফেরা, সমাবেশ, সংগঠন এবং চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে। ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার নাগরিকের থাকিবে।’ সুতরাং এটা পরিষ্কার, সংবিধানের কোথাও লেখা নেই যে, কোনো বৈধ সংগঠনের ঘরে-বাইরে সভা-সমাবেশ বা মিছিল-শোভাযাত্রা করার আগে পুলিশের অনুমতি নিতে হবে। অবশ্য বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে বিশেষ কোনো এলাকায় সভা-সমাবেশ-মিছিল নিষিদ্ধ করার এখতিয়ার পুলিশের আছে। যেমন সংসদ অধিবেশন চলাকালীন জাতীয় সংসদ ভবনসংলগ্ন নির্দিষ্ট চৌহদ্দির মধ্যে সভা-সমাবেশ-মিছিল নিষিদ্ধ থাকে।

আবার কোনো অনাকাক্সিক্ষত বা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এড়াতে কিংবা শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার্থে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার এখতিয়ার পুলিশের আছে। এ জন্য নির্দিষ্ট আইন রয়েছে এবং সে আইন প্রয়োগ করার বিধিবদ্ধ নিয়মও আছে। তবে, বেশির ভাগ সময় সে আইনের অপপ্রয়োগ হতে দেখা যায়। আর ইদানীং তা একটু বেশি পরিমাণেই হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সভা-সমাবেশ করার আগে পুলিশের অনুমতি নেওয়ার যে রেওয়াজ বর্তমানে চালু রয়েছে, তা আমাদের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ, সংবিধান নাগরিকদের যে অধিকার দিয়েছে, যুক্তিসংগত কোনো কারণ ছাড়াই পুলিশ তা ভোগ করতে বাধার সৃষ্টি করছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, রাজনৈতিক দলগুলো ‘একান্ত বাধ্যগত ছাত্রে’র মতো সভা-সমাবেশ করার আগে পুলিশের অনুমতি প্রার্থনা করে চলেছে। এ রেওয়াজটি যে আমাদের সংবিধান পরিপন্থি এ কথাটি যেন তারা বিস্মৃত হয়েছে। নিয়মানুযায়ী সভা-সমাবেশ করার আগে পুলিশকে অবহিত করতে হবে, যাতে তারা শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা বা উদ্ভূত কোনো অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পূর্বাহ্নেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পারে। সে অবহিত করার নিয়ম এখন অনুমতি নেওয়ার রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলো, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এটাকে এক রকম নীরবেই মেনে চলেছে। কেউ কেউ মনে করেন, ক্ষমতায় গেলে বিরোধী দলও এটাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে, এ আশাতেই একটি সংবিধানবিরোধী অনিয়মকে মেনে চলেছে।

এ অবস্থার উদ্ভব হয়েছে গণতন্ত্রের দুর্বল অবস্থার কারণেই। গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশ না ঘটায় তা মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, রাজনৈতিক দলগুলো ততটুকু গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, যতটুকু তাদের ক্ষমতায় যেতে ও টিকে থাকতে প্রয়োজন। এরা ক্ষমতার বাইরে থাকতে গণতন্ত্রের জন্য যতটা দরদ দেখায়, রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেলে সেই গণতন্ত্রকেই পদদলিত করতে দ্বিধা করে না। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পথ কখনোই কুসুমাতীর্ণ ছিল না। সাতচল্লিশ বছরের পথ চলায় তাকে বারবার হোচট খেতে হয়েছে, মুখ থুবড়ে পড়তে হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অদূরদর্শিতাই এর প্রধান কারণ। এত ঘাত-প্রতিঘাতের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আজও দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। ফলে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা আজও অপূর্ণই রয়ে গেছে। আর সে জন্যই ক্ষমতার বাইরে থাকা দলকে ‘গণতন্ত্র নাই’ বলে চিৎকার করতে হয়, ক্ষমতাসীন দলকে বলতে শোনা যায় গণতন্ত্র আছে। মার্টিনেজ তার এক বইয়ে লিখেছেন, এসব সত্য সামনে এলে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য বিশাল প্রচারণার জন্ম দেওয়া হয়। তখন সত্যটা হারিয়ে গিয়ে মিথ্যাটাই প্রবল হয়ে ওঠে। যেমন একটি প্রচারণা হচ্ছেÑসব যুদ্ধ-সঙ্ঘাত মুসলমানরাই সৃষ্টি করছে। অথচ তারাই এ যুদ্ধ আর সঙ্ঘাতের প্রধান শিকার। তিনি প্রশ্ন করেছেন, কেন তেলসমৃদ্ধ ও মুসলিমপ্রধান মধ্যপ্রাচ্যে সঙ্ঘাত এবং যুদ্ধ চলছে? কারা এতে লাভবান হচ্ছে? পশ্চিমা সামরিক শক্তি কেন এই যুদ্ধ চালু রেখেছে? এসব যুদ্ধের জন্য দেশগুলোর শাসকরা জনগণকে অত্যাচার করছে আর গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে বলে দাবি করে পশ্চিমা যুদ্ধবাজরা আক্রমণ চালায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে।

মার্টিনেজ জিজ্ঞেস করেছিলেন, সেখানে কি গণতন্ত্র এসেছে? জনগণ কি স্বস্তিতে জীবনযাপন করতে পারছে? অথচ তাদের সম্পদ তেলের ওপর থেকে তাদের সব অধিকার হারিয়ে গেছে এবং স্বাধীনতা বলতে তাদের কিছুই নেই। এক প্রতিবেদনে এসেছে, লিবিয়াকে যখন উন্নয়নের নিক্তিতে ইউরোপের পঞ্চম রাষ্ট্র বলে বিশ্বমাধ্যমে বর্ণনা দেওয়া হচ্ছিল, তখনই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে সে দেশে পশ্চিমা আক্রমণ শুরু হয়। এখন লিবিয়ার করুণ অবস্থা সবার জানা। তাদের তেলসম্পদসহ অন্যান্য সম্পদ পশ্চিমাদের দখলে। এ অবস্থাগুলো স্মরণ করলে তাই চোরাবালির কথাই মনে আসে। সমুদ্রপাড় বা বিস্তীর্ণ বালিভূমির মাঝে চোরাবালির অবস্থান। এমন সুন্দর মুক্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় মানুষ আনন্দ করবে বা ঘুরবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর মধ্যে এই চোরাবালির অবস্থান তার মনে আসবে না, এটাও স্বাভাবিক। অথচ এর অবস্থান বাস্তব এবং সেখানে মানুষ পড়ছে, আহত-নিহত হচ্ছে। আজকের দুনিয়াটার অবস্থাও এমনিই হয়ে পড়েছে। এর থাবা থেকে বাঁচতে হবে। তার জন্য বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন এবং তৃতীয় বিশ্বের জন্য প্রয়োজনটা আরো অনেক বেশি।

লেখক : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close