সাধন সরকার

  ১০ আগস্ট, ২০১৮

মতামত

পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ^

দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক যুদ্ধের ভয়াবহতা সারা পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। দীর্ঘ ৭ দশক পরে এসেও এখনো বোমা ও অস্ত্রের হুমকি বিশ^বাসীকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। এই দুই শহরে বোমা ও তেজস্ক্রিয়ায় ৩ লাখের অধিক মানুষ মারা যায়। এদের বেশির ভাগই ছিল বেসামরিক নাগরিক। বিভিন্ন ধরনের ক্ষতির শিকার হয় লক্ষ লক্ষ মানুষ। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা শহরে নিউক্লিয় বোমা ‘লিটল বয়’ এবং এর তিন দিন পর ৯ আগস্ট নাগাসাকি শহরের ওপর আরেকটি নিউক্লিয় বোমা ‘ফ্যাটম্যানের’ বিস্ফোরণ ঘটায়। হিরোশিমাতে বোমায় প্রায় ৯০ ভাগ বাড়িঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গেই সেখানকার ২০ ভাগ অর্থাৎ ৭০ হাজার মানুষ মারা যায়। ওই বছরের ডিসেম্বরের দিকে তেজস্ক্রিয়ায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখ ৪০ হাজার জন। ১৯৫০ সালনাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখে। বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে লক্ষাধিক মানুষ। আরেক শহর নাগাসাকিতে ফ্যাটম্যানের আঘাতে প্রাণ হারায় ৭০ হাজার মানুষ। পরে আরো ১০ হাজার লোক মারা যায়। পারমাণবিক রেডিয়েশন যত কম মাত্রার হোক না কেন এর ক্ষতিকর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। জাপানকে আজ সেই ভয়াবহ দুঃসহ স্মৃতি তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। আসলে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণের পেছনে এই পারমাণবিক বোমা বর্ষণের দরকার ছিল কি না, তা নিয়ে বিশ^ এখনো দ্বিধাবিভক্ত। তবে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, এর ফলে জাপান নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়েছে। এই ক্ষতি জাপানকে মারাত্মকভাবে ভুগিয়েছে, এখনো ভোগাচ্ছে।

পারমাণবিক বোমা ও অস্ত্র শুধু ধ্বংসই ডেকে আনে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত সেই সব পারমাণবিক বোমা ও অস্ত্রধর দেশকে যারা এখনো বিশ^কে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রের ভয় দেখায়। সত্যি কথা বলতে আমরা এমন একটা বিশে^ বাস করছি যেখানে পারমাণবিক অস্ত্রের ঝুঁকি আগের থেকে অনেক বেশি। এই পৃথিবীর বুকে মানুষ এবং সব ধরনের প্রাণীর জন্যই পারমাণবিক অস্ত্র একটি হুমকি বটে। দূরপ্রাচ্যের দেশ উত্তর কোরিয়ার পরমাণবিক পরীক্ষা চালানোসহ আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের (আইসিবিএম) সফল উৎক্ষেপণের ফলে বিশ^ সম্প্রদায় আগের চেয়ে বেশি শঙ্কিত। কোরীয় উপদ্বীপে এ নিয়ে মাঝে মাঝে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয়। উত্তর কোরিয়ার পাশর্^বর্তী দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে এ নিয়ে প্রায় সময় উত্তেজনা বিরাজ করে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের মধ্যে এক দফায় শান্তিপূর্ণ আলোচনা হয়েছে, যা বিশ^কে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। যদিও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়েও শক্তিধর দেশগুলোর একের পর এক আলোচনা ভেস্তে যাচ্ছে। বিশে^র শান্তির জন্য ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য শক্তিধর দেশগুলোর আলোচনা ফলপ্রসূ হওয়া একান্ত জরুরি। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, পরমাণু কর্মসূচি থেকে ইরান ও উত্তর কোরিয়াকে সরিয়ে আনার সুযোগটা আসলে চলে গেছে! কিন্তু কেন এসব ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি? কী উদ্দেশ্যে এত সব পাল্টা হুমকি আর উত্তেজনার বারুদ ছড়ানো হচ্ছে? একবিংশ শতাব্দীতে এসে আজ পারমাণবিক বোমা, অস্ত্র কিংবা ক্ষেপণাস্ত্রের প্রয়োজন কতটা?

প্রত্যেক দেশেরই এখন শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা। কোনো দেশেরই যুদ্ধ ডেকে এনে বেসামরিক লোকজনের ও যানমালের অপরিসীম ধ্বংসযজ্ঞ বয়ে আনা ঠিক হবে কি? কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। প্রকৃতপক্ষে এতসব হুমকি-পাল্টা হুমকি কোরীয় উপদ্বীপকে মাঝে মাঝেই অশান্ত করে তুলছে। যা যুদ্ধের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। কোরীয় উপদ্বীপকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করতে ও শান্ত অবস্থা ফিরিয়ে আনতে উভয় পক্ষকে এ মুহূর্তে শান্তিপূর্ণ উপায়ে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। শুধু জোর করে অর্থনৈতিক চাপ কিংবা হুমকি-পাল্টা হুমকি দিয়ে কাজ হবে বলে মনে হয় না! তবে আশার কথা, দেরিতে হলেও বিশ^ পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণে সম্মত হয়েছে। ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণে আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়। এরই সূত্র ধরে পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করার দীর্ঘ সাত দশক পরে এসে গত ৭ জুলাই ২০১৭ জাতিসংঘের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য দেশ Treaty on the prohibition of NUclear weapons বা ‘পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তি’ স্বাক্ষরের বিষয়ে সম্মত হয়। হতাশার কথা হলো, বিশে^র ৯টি পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ দেশ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন, চীন, ফ্রান্স, ভারত, পাকিস্তান, ইসরায়েল ও উত্তর কোরিয়া কোনো ধরনের আলোচনা ও ভোটাভুটিতে অংশগ্রহণ করেনি। এদের মধ্যে কয়েকটি দেশ এ চুক্তিতে স্বাক্ষরের পরিবর্তে কয়েক দশকের পুরনো Treaty on the Non- proliferation of NUclear weapons (NPT) বা ‘পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে’ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকার কথা জানিয়েছে। পরমাণু অস্ত্রসমৃদ্ধ এসব দেশের এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত বিশ^কে আরো অনিরাপদ ও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিবে। বিশে^র মানুষ শান্তি চায়, যুদ্ধ চায় না। ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ থেকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে ‘পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তি’ স্বাক্ষরের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ জাতিসংঘের সদর দফতরে এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। বিশ^ আশা করে সব দেশ এক ছাদের নিচে এসে বিশ^কে নিরাপদ ও অধিকতর বাসযোগ্য করার জন্য শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণে কাজ করবে। ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের চেয়ে বিশে^ শান্তি এখন বেশি জরুরি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close