রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৭ আগস্ট, ২০১৮

আন্তর্জাতিক

অভূতপূর্ব সন্ধিক্ষণে পৃথিবী

রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুটি দেশ। দেশ দুটির মধ্যে আস্থার সম্পর্ক থাকা দরকার। ইতিহাস বলে অতীতে যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি স্থিতিশীল বিশ্ব উপহার দেওয়ার জন্য বারবার বৈঠক করেছে। পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা কমিয়ে আনার জন্য একাধিক চুক্তির স্বাক্ষর করেছে দেশ দুটি। দুই দেশের মধ্যে ১৯৪৩ সালের বৈঠকটি ছিল প্রথম। ওই বছরের নভেম্বরে ইরানের তেহরানে বৈঠক করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট, সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্ট্যালিন ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী চার্চিল। ওই বৈঠকে হিটলারের বিরুদ্ধে মিত্র জোটের প্রতিনিধিরা একত্র হয়েছিলেন। এরপর ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্রিমিয়ার ইয়াল্টায় আবার তারা একত্র হয়েছিলেন। এবার রুজভেল্টের বদলে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড

স্টেটিনিয়াস। ওই বৈঠকে মুক্ত ইউরোপ ঘোষণায় তারা স্বাক্ষর করেছিলেন। ১৯৪৫ সালের ২ আগস্ট তৃতীয়

বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট

হ্যারি ট্রুম্যান, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি ও সোভিয়েত নেতা স্ট্যালিনের মধ্যে। কিন্তু ওই ‘সমঝোতা’ টিকে থাকেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপকে কেন্দ্র করে দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এক ধরনের প্রভাববলয় বিস্তারের রাজনীতিতে লিপ্ত হয়। একদিকে পশ্চিম ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বাজার অর্থনীতিনির্ভর গণতন্ত্র বিকশিত হয়, অন্যদিকে পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতন্ত্রের বিকাশ ঘটে। দীর্ঘ ৪৬ বছর এ ‘প্রতিযোগিতা’ বজায় ছিল।

এ ক্ষেত্রে গরবাচেভ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে ক্ষমতায় এসে ১৯৮৮ সালে ওয়ারশ সামরিক জোট ভেঙে দিয়েছিলেন। এক সময় সমাজতন্ত্রের প্রসার তথা রক্ষার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে ওয়ারশ সামরিক জোট গঠিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯১১ সালের ডিসেম্বরে সমাজতন্ত্রের পতন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলেও ন্যাটোর কাঠামো ভেঙে দেওয়া হয়নি। বরং পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ এখন ন্যাটোর সদস্য ও ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ ঘটেছে। ফলে আস্থার সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল সেখান থেকেই। গত ১৬ জুলাই ট্রাম্প প্রথমবারের মতো পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ বৈঠকটি সারা বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের অ্যাপ্রোচে ভুল ছিল। ট্রাম্প ভুলে গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডিপ স্টেট’ কত শক্তিশালী। এই ‘ডিপ স্টেট’ মূলত সাংবিধানিক শক্তির বাইরে গিয়ে (কংগ্রেস, প্রেসিডেন্সি) আলাদাভাবে প্রশাসনে প্রভাব খাটায়। তারা সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক সময় প্রেসিডেন্ট তাদের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেন না। দেখা গেল, ট্রাম্প যখন পুতিনের পক্ষাবলম্বন করে হেলসিঙ্কিতে বক্তব্য রাখলেন, তখন ‘ডিপ স্টেট’ তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিল। গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তো রিপোর্ট ছিলই, নির্বাচনে একটা হস্তক্ষেপ ছিল! ওই সময় মার্কিনি পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে সংবাদও ছাপা হয়। ওই সময়ও ট্রাম্প এই অভিযোগ নাকচ করেছিলেন। ওই সময় এমন সংবাদও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, পুতিন চাচ্ছেন ট্রাম্প ক্ষমতায় আসুক। এর পেছনে যুক্তি ছিল, রাশিয়ায় ট্রাম্পের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। ব্যবসায়ী মানুষ ট্রাম্প। তিনি জানেন কীভাবে নিজের স্বার্থ আদায় করে নিতে হয়। পৃথিবী অভূতপূর্ব এক সন্ধিক্ষণ অতিক্রম করছে।

মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত অবস্থার কোনো অবসান ঘটেনি, বরং ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের বর্বর আক্রমণ অবস্থা আরো নাজুক করে তুলেছে। সিরিয়াকেন্দ্রিক সহিংসতা কিছুটা কমে এলেও মূল সমস্যাগুলো অব্যাহত রয়েছে। আর এটা তো স্বতঃসিদ্ধ যে, মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা শুধু ভূখ-গত সমস্যা নয়, এ সমস্যা বিশ্ব পরাশক্তিগুলোর মধ্যে নানা মনস্তাত্ত্বিক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। আমরা দেখছি, মধ্যপ্রাচ্য, সিরিয়াকে কেন্দ্র করে বিশ্বের দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, আর এ ঘটনার রেশ তাদের মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়া ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে। আন্তর্জাতিক অনেক বিশ্লেষক একে শীতলযুদ্ধ ফিরে আসার আলামত লক্ষ করছেন। এ অবস্থায় সব অনিশ্চয়তা আর বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কিতে ১৬ জুলাই মুখোমুখি বৈঠকে বসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। তাদের আলোচ্যসূচি ছিল, পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, রাশিয়ার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, ইউক্রেন আর সিরিয়ার যুদ্ধের বিষয়। ট্রাম্প-পুতিন

বৈঠক উত্তেজনাময় বিশ্ব পরিস্থিতি মোকাবিলায় সম্ভাবনা তৈরি করলেও বাস্তবে তা হয়েছে বলে দাবি করা যাবে

না। এ বৈঠকটিকে রাশিয়ার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ও রাশিয়ান মিডিয়া তাদের বিজয় হিসেবে দেখছে। যুক্তরাষ্ট্রের

ঊর্ধ্বতন প্রশাসন কর্মকর্তারা ট্রাম্পের এ বৈঠককে আমেরিকার জন্য অর্থহীন অভিহিত করেছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার নিজ দেশে কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছেন। বৈঠকটি ট্রাম্প সফল হিসেবে গণ্য করলেও দেশের মধ্যে চরম বিরোধিতার সম্মুখীন হন।

ফলে বৈঠক নিয়ে বেশ কয়েকবার সুর পাল্টিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কখনো নিজের বক্তব্যের পক্ষে আবার কখনো বিপক্ষে। একবার মার্কিন নির্বাচনে হস্তক্ষেপ নিয়ে মার্কিন গোয়েন্দাদের বক্তব্যের সমর্থনে কথা বলেছেন। আবার কখনো পুতিনের বক্তব্যের সমর্থনে। কথা ঘুরানো ট্রাম্পের স্বভাবজাত, এটা সবার জানা। উল্লেখ্য, তথাকথিত স্নায়ুযুদ্ধের সময়কালে যুক্তরাষ্ট্র এবং তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন কখনো যুদ্ধে জড়ায়নি, বর্তমান অবস্থায়ও সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে বলে মনে হয় না। কিন্তু বর্তমান রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিন আবার রাশিয়াকে সেই ক্ষমতায় ফিরিয়ে নিতে চান আর ট্রাম্প চান আমেরিকাকে এক নম্বরে অধিষ্ঠিত রাখতে, এ অবস্থায় যে উগ্রজাতীয়তাবাদের সূচনা ঘটেছে, তার প্রতিক্রিয়া হয়েছে সুদূরপ্রসারী। শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বীকার করেছেন, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপ হয়েছিল। তার এই বক্তব্য হেলসিঙ্কিতে দেওয়া তার বক্তব্যের ঠিক উল্টো। ১৬ জুলাই হেলসিঙ্কিতে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে যে ঐতিহাসিক বৈঠকটি তিনি করেন, তারপর পুতিনের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (২০১৬) রাশিয়ার হস্তক্ষেপের কোনো কারণ তিনি দেখেন না। অর্থাৎ সরাসরি নাকচ করে দেওয়া। এমনকি পুতিনও সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, তার দেশ মার্কিন নির্বাচনে কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু ট্রাম্প যখন পুতিনের সুরে কথা বললেন, তখন একটা বড় বিতর্কের জন্ম দেয় যুক্তরাষ্ট্রে। খোদ রিপাবলিকান শিবিরেও তার ওই বক্তব্যের সমালোচনা করা হয়। শুধু তা-ই নয়, এফবিআইও ১২ জন রুশ গোয়েন্দাকে চিহ্নিত করেছে, যারা ওই নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেছিল।

এ অবস্থায় চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ পৃথিবীকে করেছে আরো অস্থিতিশীল। সময়টাকে বিশ্বায়নের যুগ বলা হলেও বাস্তবিকে উগ্রজাতীয়তা বাদ ও আঞ্চলিক শক্তির আস্ফালন অতিমাত্রায় লক্ষ করা গেছে। ঐতিহাসিক সূত্র ধরে তুরস্ক অটোমান সা¤্রাজ্যের স্বপ্ন দেখছে, রাশিয়া জার কিংবা সোভিয়েত ক্ষমতা ফিরে পেতে চায়, আমেরিকা নিজেকে ঐশ্বর্য ও ক্ষমতার দম্ভে উচ্চে রাখতে চায়। এ অবস্থায় চীন গড়ে তুলেছে বিশাল অর্থনৈতিক সা¤্রাজ্য। আর পৃথিবীতে বেড়েই চলছে কর্তৃত্ববাদী শাসন। তবে আশার কথা, শান্তিময় বিশ্ব প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা নিয়ে এগোতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের বীজমন্ত্র গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সাম্য ও স্বাধিকারের যে ধারণা আমরা রোপণ করেছিলাম, তাই হবে আমাদের অগ্রগতির শক্তি।

লেখক : আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist