শতদল বড়ুয়া

  ০৬ আগস্ট, ২০১৮

নিবন্ধ

আণবিক বোমায় বিধ্বস্ত মানবতা

সভ্যতার ক্রমবিকাশে মানুষ বাঁচার জন্য নানা কৌশল উদ্ভাবন করছে। একে অন্যকে ঘায়েল করার জন্য, শত্রুর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য এবং রাষ্ট্র তথা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার খাতিরেও প্রয়োজনীয় নানা জিনিসপত্র আবিষ্কার অব্যাহত রয়েছে। যুদ্ধের নেশাটা প্রাচীনকালের মতো বর্তমানেও সচল রয়েছে। বর্তমানের যুদ্ধ বিরাট, ব্যাপক এবং খুবই জটিল। প্রাচীনকালে যুদ্ধাস্ত্র ছিল তীর, ধনুক, বর্শা ইত্যাদি। বর্তমানে যুদ্ধাস্ত্র পারমাণবিক বোমা, হাইড্রোজেন বোমাসহ উন্নত প্রযুক্তির নাম না জানা মরণাস্ত্র।

প্রায় ৭৩ বছর আগে এশিয়ার উন্নত দেশ জাপানে যুক্তরাষ্ট্র এক চরম মানবতাবিরোধী বর্বর হত্যাকা- ঘটিয়ে বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দিয়েছিল। ৬ আগস্ট, ১৯৪৫ রোজকার মতো জাপানিরা দিনের কর্মকা-ে যোগ দেওয়ার জন্য ছুটছে আপন গতিতে। জীবিকার তাগিদে ছুটে চলা পথে মানুষদের তাড়া করবে মৃত্যুদূত, এ কথা কেউই জানত না। জানার কথাও নয়। প্রাণ চাঞ্চল্যের শহর ‘হিরোশিমা’ ও ‘নাগাসাকি’। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালোনা গাই বি-২৯ বোমারু বিমান থেকে হিরোশিমা শহরে আণবিক বোমা (অ্যাটম বোমা) ফেলা হয়। একই মাসের ৯ আগস্ট মার্কিন যুদ্ধবিমান থেকে নাগাসাকিতে ফ্যাটম্যান নামে আরেকটি আণবিক বোমা ফেলা হয়। দ্বিতীয় বোমাটি ফেলার নির্দিষ্ট টার্গেট ছিল জাপানের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় দ্বীপ কিয়ুসুর কোকুরা অস্ত্রাগার। বৈরী আবহাওয়ার কারণে বৈমানিক ভুলবশত বোমাটি নাগাসাকি শহরে ফেলা হয়।

হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে দুই দিনের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে যে বর্বর নারকীয়তার জন্ম দেয়, তার অনলে তৎক্ষণাৎ মৃত্যুর মিছিলে সামিল হয়েছিল প্রায় ১,৪০,০০০ হাজার লোক। আহতের সংখ্যা! সে-তো আরো পীড়াদায়ক। তখন দুই শহরের আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হয়েছিল বাঁচার আর্তনাদ। লাখ লাখ আহতদের বাঁচানোর জন্য বিশ্ববাসী এগিয়ে যাওয়ার তথা দুঃখ প্রকাশ করারও ভাষা হারিয়ে ফেলেছিল। মানবসভ্যতা যেন হোঁচট খেয়ে থমকে দাঁড়ায় এখানে। এ বর্বর হত্যাকা-ের পেছনের ঘটনা হলো ১৯৩৯ সাল। পৃথিবীতে তখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়নি। তবে তৎকালীন জার্মানির এডলফ হিটলারের গলাবাজিতে সারা বিশ্বের মানুষ আশঙ্কা করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। পশ্চিমা বিশ্ব হিটলারের আণবিক বোমাপ্রাপ্তির একচেটিয়া অধিকারী হয়ে সারা বিশ্বের কর্তৃত্ব গ্রহণ করার গোপন খবরে তটস্থ হয়ে পড়ে। ঠিক এমন সময় যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থী হিসেবে বসবাসকারী, হাংগেরিতে জন্মগ্রহণকারী বিজ্ঞানী ড. লিও জিলার্ড সর্বপ্রথম আণবিক বোমা তৈরির জন্য একটি প্রস্তাব দেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টকে।

১৯৪০ সালের ৭ মার্চ আইনস্টাইন তার এক চিঠিতে আণবিক বোমা তৈরির জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেন। এ প্রক্রিয়ার মধ্যে ঘটল আরেক অঘটন ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর। জাপান সরকার যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবার বিমান এবং নৌঘাঁটিতে সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে সবকিছু তছনছ করে দেয়। চোখের পলকে সেখানে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। এবার যুক্তরাষ্ট্র জাপানের ওপর আঘাত হানার পরিকল্পনা আঁটল। সুদে-আসলে বদলা নেওয়ার জন্য কৌশল অবলম্বন করতে থাকল। যুক্তরাষ্ট্র আগের দুই বৈজ্ঞানিকের আণবিক বোমা বানানোর প্রস্তাব বিবেচনায় এনে চূড়ান্তভাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪৫ সালের ৮ মে। জার্মানির আত্মসমর্পণের পর ইউরোপের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটলেও অপর অক্ষশক্তি জাপান তখনো মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। এতে তখন এটাই প্রতীয়মান হয়, যুক্তরাষ্ট্র যে আণবিক বোমা তৈরি করেছে, তার লক্ষ্যবস্তু জাপান।

জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকি শহরে বোমা হামলা ছিল কোনো যুদ্ধে আণবিক বোমা হামলার প্রথম ঘটনা। ৬ ও ৯ আগস্টের এ হামলা এতই মানবতাবিরোধী, যার ক্ষয়ক্ষতি এখনো বহমান। জাপানের ঐতিহাসিক এই দুই শহরের মানুষ শিখেছে নতুনভাবে বাঁচার। অসহায় মানুষের কান্না এবং আহাজারি বিশ্বের মানুষকে শিখিয়েছে যুদ্ধ এবং আধুনিক ধরনের অস্ত্রকে ঘৃণা করতে। হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত বোমার সংক্ষিপ্ত বিবরণ : বোমার নাম ‘লিটল বয়’, নিক্ষেপের সময় ৬ আগস্ট, ১৯৪৫, সময় ৮টা ১৫ মিনিট (জাপানের সময় অনুযায়ী), বোমা বহনকারী বিমানের নাম বি-২৯, যুদ্ধবিমান। নিহত ৬৬ হাজার (তাৎক্ষণিক), বোমার শক্তি ১৫.০২ কিলোটন টিএনটির সমান, আহত ৭০ হাজার (তাৎক্ষণিক), ক্ষতিগ্রস্ত চতুর্পাশ্ব বোমা নিক্ষেপের কেন্দ্র থেকে চারদিকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ পর্যন্ত। মোট আহত ১ লাখ ৩৬ হাজার। হিরোশিমায় হিসাব মতে ১৯৪৫ সালের শেষ নাগাদ মৃতের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজারের মতো।

নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার ক্ষয়ক্ষতি নিম্নরূপ : বোমার নাম ফ্যাটম্যান, নিহতের সংখ্যা ৭৩ হাজার ৮৮৪ জন (তাৎক্ষণিক), আহত ৭৪ হাজার ৭৯৩ জন (তাৎক্ষণিক), বোমা বহনকারী বিমানের নাম বি-২৯ যুদ্ধবিমান, বোমা নিক্ষেপের সময় ৯ আগস্ট, ১৯৪৫ সাল, স্থানীয় সময় রাত ৩টা ৪৭ মিনিট, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ৬.৭ মিলিয়ন বর্গমিটার, ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি-সম্পূর্ণ ধ্বংস ১১ হাজার ৫৭৪টি, ধ্বংসপ্রাপ্ত ১ হাজার ৩২৬টি, মারাত্মক ভস্মীভূত ৫ হাজার ৫০৯টি, মোট ১৮ হাজার ৪০৯টি। মারাত্মক এ বোমার বিষক্রিয়ায় পরে শহরের ২ লাখ ৭০ হাজার জনসংখ্যার প্রায় দেড় লাখেরও বেশি লোক জনমের টিকিট কেটেছিল। পঙ্গুত্ববরণ করেছে অসংখ্য জনসাধারণ। বধ্যভূমিতে পরিণত হওয়া দুই শহরের অধিবাসীরা বেশুমার ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে আপ্রাণ চেষ্টা এখনো চালিয়ে যাচ্ছে।

হিরোশিমা নাগাসাকিতে এই বর্বর হামলার পর জাপানিদের মনোবল ভেঙে পড়ে। জাপানের সম্রাট হিরোহিতো আমেরিকার কাছে আত্মসমর্পণ করে ১৪ আগস্ট। এত বছর পরও জাপানিরা স্বজন হারানোর ব্যথা ভুলতে পারেনি। হিরোশিমা দিবস পালন উপলক্ষে তারা সমবেত হন দক্ষিণ-পশ্চিমের কান্ট্রি ক্লাব ড্রাইভের স্টারকার আর্টস পার্ক ও ৪৫ নম্বর স্ট্রিটে ৭ আগস্ট। প্রিয়জনের আত্মার পারলৌকিক সদগতি কামনায় আয়োজন করবে প্রার্থনা সভা। বিহারে গিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে নিহতদের স্মরণ করবে। গাইবে বেদনাতুর গান, করবেন কবিতা পাঠ। প্রতি বছর আগস্টের ৬ ও ৯ তারিখ আমাদের জানান দেয় পীড়াদায়ক ঘটনার। হিরোশিমা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে জাপানিরা নতুনভাবে শিক্ষা নেয়। তেজস্ক্রিয়তার কুফল জাপানিরা এখনো ভোগ করছে। শহর দুটি এখনো বহন করছে যুক্তরাষ্ট্রের পাপের বোঝা। বিশ্ববাসীর সঙ্গে আমরাও হিরোশিমা দিবস পালনকালে জাপানিদের সুখ-শান্তি এবং মৃতদের আত্মার সদগতি কামনা করছি।

একনজরে ঘটনাপঞ্জি : ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৮ : নাৎসি জার্মানির দুই বিজ্ঞানী অটো হার্ন এবং ফ্রিৎজ স্ট্রাসমান সফলভাবে অণু ভাঙার পর সে দেশে আণবিক অস্ত্র কর্মসূচি শুরু হয়। ২ আগস্ট, ১৯৩৯ : আলবার্ট আইনস্টাইন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টকে জার্মানের সম্ভাব্য পরমাণু বোমা হামলা সম্পর্কে সতর্ক করে দেন এবং আণবিক গবেষণায় জোর দেওয়ার দাবি জানান। জুন, ১৯৪২ : পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট ওপেন হেইমারের নেতৃত্বে ম্যানহাটান প্রকল্পে গোপন আণবিক অস্ত্র কর্মসূচি শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। ২ ডিসেম্বর, ১৯৪২ : এনরিকো ফেরমির নেতৃত্বে মার্কিন বিজ্ঞানীরা বিশ্বের প্রথম পরমাণু বোমা তৈরি করে। ১৬ জুলাই, ১৯৪৫ : যুক্তরাষ্ট্র নিউ ম্যাক্সিকোর আলামোগোরডো এলাকার কাছে পরমাণু পরীক্ষা চালায়। এটি ছিল বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা। ২৬ জুলাই, ১৯৪৫ : মিত্রশক্তি জাপানের প্রতি তাৎক্ষণিকভাবে এবং বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করার দাবি জানায়। প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্ট্যালিনের কাছে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আণবিক বোমা রয়েছে। ৬ আগস্ট, ১৯৪৫ : মার্কিন বোমারু বিমান বি-২৯ ইনোলা গেটি থেকে হিরোশিমায় আণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। ৯ আগস্ট, ১৯৪৫ : নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয়বারের মতো আণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। ১৫ আগস্ট, ১৯৪৫ : সম্রাট হিরোহিতো রেডিও ভাষণে জাপানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist