অধ্যাপক ড. সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার

  ০৬ আগস্ট, ২০১৮

বিশ্লেষণ

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুভাবনা : একটা দ্বান্দিক প্রেক্ষাপট

মানবজীবনের অত্যন্ত মৌলিক তথা গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয় হলো মৃত্যু। মানুষ বাদে অন্য কোনো প্রাণী মৃত্যু নিয়ে ভেবেছে, এমন নজীর নেই। মৃত্যুকে ঘিরে গড়ে উঠেছে সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম এমনকি বিজ্ঞানও। মৃত্যু স্থান-কাল ভেদে সব মানুষকে ভাবায় এবং সত্যিকারার্থে পৃথিবীতে এমন মানুষ পাওয়া ভার, যারা মৃত্যু নিয়ে ভাবেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) কাব্যিক এমনকি দার্শনিক ঢঙে সমগ্র জীবনব্যাপী মানবজীবনের নানাদিক নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছেন এবং সাহিত্যের নানা আঙ্গিকে তা প্রকাশও করছেন। তবে মজার ব্যাপার হলো, তার এই মৃত্যুচিন্তা নানা রকম দ্বান্দ্বিকতায় পরিপূর্ণ। বলতে গেলে অনেকটা মিশ্র।

প্রথমেই বলে রাখা ভালো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন উপনিষদিক ভাবনার একান্ত বরপুত্র। দ্বিধাহীনভাবে বলা যায় তার সব চিন্তার মাঝে লুকিয়ে আছে উপনিষদিক দর্শনের মর্মবাণীÑ ‘ইশা বাস্য মিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগতাং জগত’ (এই গতিশীল বিশ্বে যাহা কিছু চলমান বস্তু আছে তাহা ঈশ্বরের বাসের নিমিত্ত মনে করিবে)। কবিতা, গদ্য, প্রবন্ধ এবং গানের ভেতর প্রকাশিত হয়েছে এই দর্শনের অন্তর্গূঢ় রহস্য। অর্থাৎ চিন্তার সব অংশের মাঝে তিনি ছিলেন ঋজু; যার মর্মার্থ গিয়ে পৌঁছেছে বেদান্তের মর্মমূলে। মৃত্যুকে তিনি আলিঙ্গন করেছেন একান্তে, গ্রহণ করেছেন বন্ধুরূপে, ভেবেছেন একান্ত সখা ও প্রেমিক হিসেবে। আবার কোনো সময় মৃত্যুকে বলেছেন অতি নিচ, অনুদার, সর্বগ্রাসী এবং স্বার্থপর। তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো তঁর জীবনশেষের উপলব্ধি; যা দার্শনিক সংশয়ী চিন্তায় পরিপূর্ণ। অনেকটা অস্পষ্ট, দ্বিধাযুক্ত এবং পরিশ্রান্ত পথিকের ন্যায় বেশখানিকটা উদাসী।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যমানস অতি শৈশব থেকে প্রলম্বিত হয়েছে জীবনের নানাভাগে এবং সেটা কৈশোর, যৌবন ও বার্ধক্যের বিভিন্ন খাঁজে আটকে গেছে কিছুকাল। তারপর আবার সেখান থেকে উদ্গত হয়েছে নতুন চিন্তার বীজ। পৌঁছেছে সীমা থেকে অসীমে, ভূমি থেকে ভূমায় আর কাব্য থেকে দর্শনে। এক নিরন্তর পরিক্রমায় নব উচ্ছ্বাসের যাত্রী রবীন্দ্রনাথ তাই একজন সুদূরের পিয়াসী। তবে এক এবং অদ্বিতীয় সত্তার প্রতি একান্ত নিবদনে তিনি সমর্পণ করেছেন সকল ভাবনাকে, সকল রসের ধারাকে। ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে আবু সয়ীদ আইয়ুব লিখছেন, ‘প্রাচীন পারস্যমতে এ জগৎ শুভাশুভ শক্তিদ্বয়ের দ্বন্দ্বক্ষেত্র। মানুষকে তারা আহ্বান করেছিলেন শুভ দেবতার পক্ষে এই সৃষ্টিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, ব্রহ্মের কঠোর তপস্যা এই বিশ্ব ব্রহ্মা-কে জড় থেকে প্রাণ ও মনের দিকে অশুভ থেকে শুভের দিকে, অপূর্ণ থেকে পূর্ণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে’ (পৃ. ২৭)।

‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলি’তে তিনি মৃত্যুকে বলছেন, ‘মরণ রে/ শ্যাম তোঁহারই নাম। চির বিসরল যব নিরদয় মাধব/ তুঁহু ন ভইবি মোয় বাম/ আকুল রাধা-রিঝ অতি জরজর,/ ঝরই নয়ন-দউ অনুক্ষণ ঝরঝর/ তুঁহু মম মাধব, তুঁহু মম দোসর,/ তুঁহু মম তাপ ঘুচাও।/ মরণ তু আও রে আও।’ মরণ শ্যামের মতো উদার, প্রেমিকের মতো বন্ধু যিনি বিরহাতুর রাধার পথ প্রদর্শক এবং ক্ষুব্ধ, ঝঞ্ঝাপূর্ণ বিজন পথে অভিসারের প্রেমিকাকে প্রণয়ক্ষণের সাহস সঞ্চারক। তাইতো ভানুসিংহ বলছেন, ‘ছিয়ে ছিয়ে রাধা,/ চঞ্চল হৃদয় তোহারি/ মাধব পহু মম, পিয় মরণ সে। অব তুঁহু দেখ বিচারি।’ মৃত্যুর আগে ভাবতে হবে জন্ম নিয়ে। কেননা জন্ম আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে মৃত্যুর স্বাদ নিতে, জীবনের সকল পর্বের প্রসাদ গ্রহণ করার এক অনবদ্য ও বিরল সুযোগ করে দিতে আর ভাবনার বিস্তার ঘটিয়ে বস্তুনিচয়ের ওপর নানা রঙের চিন্তার জাল ফেলাতে।

তবে মৃত্যুকে সবথেকে বেশি বন্ধুরূপে আলিঙ্গন করেছেন ‘মৃত্যঞ্জয়’ কবিতায়। তিনি মৃত্যুভয় কাটিয়ে উঠেছেন, তাকে দূর থেকে যতটা নিষ্ঠুর ও নির্দয় মনে হয়েছে, কাছে আসার পর সে অহেতুক ভয় ভেঙে গেছে। আসলে মৃত্যু কিছুতেই ‘আমার’ থেকে বড় নয়, ‘আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়’ এই উপলব্ধি কবিকে সান্ত¡না দিয়েছে। আমরা প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মুখোমুখি, প্রত্যহ ভয়ের শাসনে কুঞ্চিত, শুধু আমিই নয়, পৃথিবী তার শাসনের বিভীষিকায় কম্পিত, কিন্তু বজ্রপাতের সময় যতটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে তারপর সবকিছু হয়ে উঠে শান্ত নিমিষে। তিনি লিখছেন, ‘এইমাত্র আর-কিছু নয়, ভেঙে গেলো ভয়/ যখন উদ্যত ছিল তোমার অশনি/ তোমারে আমার চেয়ে বড় বলে নিয়েছিনু গণি/ ‘আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়’ এই শেষ কথা বলে/যাব আমি চলে।’ ‘মৃত্যুর পরে’ কবিতায় কবি মৃত্যুকে সকল শান্তির আশ্রয় হিসেবে মনে করেছেন। মৃত্যু যেন সব পরিণতির এক অসীম আনন্দলোক। জীবনের সকল ভ্রান্তির অবসান, সকল তর্কের শেষ, সকল কামনার পূর্ণ তৃপ্তি। ‘সব তর্ক হোক শেষ/ সব রাগ সব দ্বেষ,/ সকল বালাই/ বলো শান্তি, বলো শান্তি,/ দেহ-সাথে সব ক্লান্তি/ পুড়ে হোক ছাই।’

তবে পত্রপুট কাব্যের ‘পৃথিবী’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ নির্মোহ পরিব্রাজকের ন্যায় সবচেয়ে রোমাঞ্চকর এক চিত্র এঁকেছেন মানবজীবনের। এটি ১৯৩৫ সালে লেখা। কাজেই পরিণত কবি সারা জীবনের যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন তার এক অনিন্দ্যসুন্দর চিত্র এঁকেছেন দক্ষ কালির আঁচড়ে। তাই এই কবিতাটা হয়ে উঠেছে এক মহাকাব্য। পৃথিবী ও আমি এর মাঝে যে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, মিলন, প্রেম, বিরহ, কর্তব্য, স্বপ্ন, কর্মধারা, ও পরিণতি নিয়ে এক নতুন ছবি এঁকেছেন তিনি। এ যেন চিত্রপটে আঁকা এক দক্ষ শিল্পীর ক্যানভাস। যেখানে ফুটে উঠেছে পৃথিবী নামক এক গ্রহের মহাপরিক্রমা। পৃথিবী যেন এক রহস্যে আবৃত মহাস্থান যার প্রকৃতি নারী-পুরুষের মিশ্রণ। ডান হাত তার পূর্ণ সুধায়, বাম হাত ধ্বংসের। পৃথিবী কবিতায় রবীন্দ্রনাথ নিজেকে স্থান দিয়েছেন অজস্র ধূলিকণার মতো একটা ছোট্ট বিন্দুবৎ জায়গায়। প্রণতি জানিয়েছেন তার নির্মম পদপ্রান্তে। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, এখানে কবি মৃত্যু, জন্ম, বেড়ে ওঠা, পরিণতি ইত্যাদির থেকে অনেক দূরে। অনেকটা বস্তুবাদীর মতো নিরুত্তাপ, অনেকটা নির্মোহ পথিকের ন্যায় আশাহীন। মৃত্যু যেন তাকে স্পর্শ করতে পারেনি কারণ এটা স্বাভাবিক। এটা অন্যান্য জড়ের মতো সফল পরিণতিতে এর সমাপ্তি।

অন্যদিকে স্পষ্ট রবীন্দ্রনাথ যেন আস্তে আস্তে অস্পষ্টতার কুয়াসায় নিজেকে ঢেকে ফেলেছেন জীবন সয়াহ্নে। কঠোর বাধ যেন ধীরে ধীরে শিথিল হতে শুরু করেছে কাল পরিক্রমায়। বিশ্বাসের ইস্পাতসম দেয়াল ক্রমে ক্রমে ক্ষয়ে গেছে সংশয়ের তীব্র আঘাতে। ‘শেষলেখা’তে তাই তাকে চিনতে একটু হোঁচট খেতে হয়। প্রথম কবিতায় তিনি বলছেন- ‘প্রথম দিনের সূর্য/ প্রশ্ন করেছিল/ সত্তার নতুন আবির্ভাবে-/ কে তুমি।/ মেলেনি উত্তর।/ বৎসর বৎসর চলে গেল,/ দিবসের শেষ সূর্য/ শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম সাগরতীরে/ নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়/ কে তুমি।/ পেল না উত্তর’। ‘প্রথম দিনের সূর্যকে যদি আমরা জ্ঞানের আলো হিসেবে তুলনা করি তাহলে স্বভবত প্রশ্ন আসে, পরম সত্তা কে? সেটাই ছিল মানুষের আদি জিজ্ঞাসা, মূল প্রশ্ন। কিন্তু হতাশার কথা হলো, অনন্তকাল পর সেই প্রশ্ন আবার দেখা দিল, কে তুমি? উত্তর না মেলাটাই স্বাভাবিক। কারণ এ প্রশ্নের হয়তো উত্তর হয় না। উত্তর নেই। এখানে বিরাট একটা দার্শনিক প্রশ্ন এসে দাঁড়িয়েছে, সত্তা ও আবির্ভাবের চির দ্বন্দ্ব। আবু সয়ীদ আইয়ুব লিখছেন, ‘তবে কি প্রশ্ন করা হলো নতুন আবির্ভাবকেই- ‘আবির্ভাব’ অর্থ আবির্ভাব কালে নয়, আবির্ভাবকে? সত্তা এবং আবির্ভাব, এই দ্বৈতের কথা তোলা হয়েছে তাহলে।’ খুব সম্ভবত কবি একটা দ্বন্দ্বের ভেতর নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন। তিনি জীবনকে পবিত্র বললেও তার স্বরূপকে বলেছেন অভাব্য। কোনো অজ্ঞেয় রহস্য হতে এর আগমন তার কূলকিনারা পাওয়া মোটেও সহজ নয়। এ যেন কিছুতেই না মেলা এক প্রশ্ন। ১৯৪১ সালের ৩০ শে জুলাই তিনি সর্বশেষ লেখাতে সেই অজানিত প্রশ্নকেই রেখে গেলেন মানুষের চিন্তার দুয়ারে। তিনি বললেন, ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে/ হে ছলনাময়ী’। সৃষ্টির এই পথ ভীষণ অজানা, কেননা এক বিরাট দার্শনিক প্রশ্নের মুখোমুখি জগতের প্রতিটা মানুষ, আসলে জীবনের অর্থ কী? কী আছে পথের শেষে। এর শেষ কোথায়? ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথকে এ জন্যই পৃথিবীর অন্যতম এক দার্শনিক হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে বলা সংগত হবে যে, সংশয় জ্ঞানের পরিবর্ধক। সংশয়ী মানুষই জ্ঞানের ধারক। রবীন্দ্রনাথ বুঝি শেষবেলায় সেটাই গ্রহণ করলেন।

লেখক : চেয়ারপারসন, দর্শন বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist