সাধন সরকার

  ০৫ আগস্ট, ২০১৮

মতামত

বেপরোয়া চালক

রাজধানীসহ সারা দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো যেন মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীতে দুটি চলন্ত বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতার শিকার হয়ে দুটি সম্ভাবনাময় ও স্বপ্নের জীবন শেষ হয়ে গেছে। এভাবে প্রতিদিনই মানুষ সড়ক দুর্ঘটনার বলি হচ্ছে। তথ্য মতে, সড়কে দুর্ঘটনা ও বিশৃঙ্খলায় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৬ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটছে। যানবাহন চলাচলে ন্যূনতম শৃঙ্খলা থাকলে কোনো সভ্য দেশের পরিবহন খাতে এই বিশৃঙ্খল অবস্থা হতে পারে না! ঢাকা মহানগরীতে চলাচলকারী বাসগুলোর মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বহুদিন ধরে চলে আসছে। রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে চালকদের বেপরোয়া যানবাহন চালানো। এ ছাড়া চালকদের নিয়ম-কানুন মানাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনীহা, গাফিলতি ও অন্যায় করে চালকদের পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি। রাজধানীর গণপরিবহনে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যা অগণিত। এদের বিরুদ্ধে কেন নিয়মিত অভিযান চালানো হয় না? দুর্ঘটনায় আহত যাত্রীকে নদীতে ফেলে দেওয়ার প্রাণনাশের সংস্কৃতিও এ দেশে চালু হয়ে গেছে! আর কত প্রাণ সড়ক দুর্ঘটনার বলি হলে সড়কে প্রাণহানির অবসান হবে? স্টিয়ারিং হাতে চালকদের বেপরোয়া মনোভাব কবে বন্ধ হবে? সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ হোক তা কারোরই কাম্য নয়। কিন্তু সেই অবরোধের পেছনে সঠিক কারণটি দূর করতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এ খাতটিকে যতটা জনগুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে দেখা হয়, আমাদের দেশে সেভাবে দেখা হয় না। বিশেষ করে ড্রাইভিং লাইসেন্স ও চালকের আইন মানার বিষয়টি এখনো অবহেলায় রয়ে গেছে। ‘বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির’ তথ্য মতে, ২০১৭ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৭ হাজার ৩৯৭ জন। হাজার হাজার লোক প্রতি বছরই সড়ক দুর্ঘটনায় বলি হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বেশির ভাগ দুর্ঘটনার মধ্যে রয়েছে পথচারীকে চাপা দেওয়া, মুখোমুখি সংঘর্ষ ইত্যাদি। বুয়েটের এক জরিপ বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশেরই কারণ চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও গতি। সড়ক দুর্ঘটনার এ দুরবস্থা সাময়িক নয়, বছরের পর বছর ধরে মৃত্যুর এ মিছিল চলতেই আছে। এ ছাড়া মহাসড়কের বেহাল অবস্থার দরুনও কেবল দুর্ভোগ বাড়ছে না, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন মৃত্যুর কারণে ক্ষতিটা হচ্ছে মূলত সার্বিক অর্থনীতিরই। তথ্য মতে, সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষতির পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২ শতাংশের সমান। জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুসারে, ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি অর্ধেকে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে সরকার।

কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, কোনো খাতে অনিয়ম ও অন্যায় যদি নিয়ম হয়ে যায়, সে খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা কি সম্ভব? প্রশ্ন হলো, সড়ক পরিবহনের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হবে কেন? রুট পারমিট থেকে শুরু করে ড্রাইভিং লাইসেন্স পর্যন্ত সব ধরনের লেনদেন-বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। সবার আগে ভাবতে হবে, এ খাতটাকে শৃঙ্খলা ও নিয়ম-কানুনের মধ্যে আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ সবাই আন্তরিক কিনা! কেননা এ খাতে যারা জড়িত, তারা বাইরের কেউ হর্তাকর্তা নয়, সরকারের আশপাশেরই সংগঠন সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তি। সরকার অনেক ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। পরিবহন খাতেও সঠিক তদারকি, মনোযোগ ও আন্তরিকতা দেখালে এ খাতটি সঠিক পথে ফিরে আসবে। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছেন। পরিবহন কর্তাব্যক্তিসহ সংশ্লিষ্ট চালকরা এই নির্দেশনা মেনে চলতে আগ্রহী নয় কেন? বেপরোয়াভাবে যান চালানো এবং একটানা দীর্ঘসময় সময় চালানো দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়। প্রধানমন্ত্রী এটার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। রাজধানী ঢাকায় বাস চালাতে চালকদের সর্বোচ্চ সতর্কতা ও ধৈর্য কাম্য। কেননা রাজধানীর বেশির ভাগ রাস্তা বেশ ছোট এবং যানজটে দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকতে হয়। এখানে হঠাৎ বেপরোয়া মনোভাব দেখানো জীবন নিয়ে খেলা করার সামিল। সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি যেহেতু জাতীয় বিষয়, সেহেতু ট্রাফিক নিয়মকানুন এবং সরকারের কিছু নির্দেশনা মানতে পরিবহন মালিক ও চালকদের বাধ্য করতে হবে। সরকারিভাবেও চালকদের দু-এক দিনের ছোট প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। সরকারের পক্ষে সম্ভব না হলে সংশ্লিষ্ট পরিবহন কোম্পানির মাধ্যমেও এটা করা যেতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ ও একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ এ খাতটির সংস্কার এখন সময়ের দাবি। সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম টেনে ধরতে কিছু বিষয়ে নজর দিতে হবেÑ১. চালকদের বেপরোয়া মনোভাব ও গতি রুখতে তাদের সচেতনতা ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে। ২. চালকদের যথাযথ ট্রেনিংয়ের পর ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান করতে হবে। ৩. সড়কে পুলিশ ও মোবাইল কোর্টকে আরো সক্রিয় করতে হবে। ৪. বিভিন্ন কোম্পানি না রেখে একটি রুট একটি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। ৫. এ খাতে সব ধরনের চাঁদা বাণিজ্য বন্ধসহ সংশ্লিষ্ট সবাই ও জনসাধারণকে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে। মনে রাখা দরকার, একটি সড়ক দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। এ খাতটিকে মানবিক উন্নয়নের ধারায় ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষসহ সরকারকে এখনই কার্যকর সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist