অলোক আচার্য্য

  ০৫ আগস্ট, ২০১৮

নিবন্ধ

চেতনার ঐক্যের নাম বন্ধু

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, গোলাপ যেমন একটি বিশেষ জাতের ফুল, বন্ধু তেমন একটি বিশেষ জাতের মানুষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়াও পৃথিবীর খ্যাতিমান লেখক, কবি, গবেষক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী বন্ধু, বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়ে নানা উক্তি করে গেছেন। বন্ধু নিয়ে তৈরি হয়েছে গান, কবিতা বা সিনেমা। বাস্তব জীবনেও প্রকৃত বন্ধুত্বের বা বন্ধুত্বের সুযোগে ক্ষতি করার বহু উদাহরণ রয়েছে। আমাদের প্রত্যহ চলার পথে যে সব থেকে বেশি সময় সঙ্গ দেয়, সেই বন্ধু। তাই খাঁটি বন্ধু প্রতিটি মানুষের জীবনেই আবশ্যক। মহান দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন, দুর্ভাগ্যবান তারাই যাদের প্রকৃত বন্ধু নেই। আবার তিনিই বলেছেন, বন্ধু হলো এক আত্মার দুটি শরীর অথবা প্রত্যেক নতুন জিনিসকেই উৎকৃষ্ট মনে হয় কিন্তু বন্ধুত্ব যতই পুরাতন হয়, ততই উৎকৃষ্ট হয়। এসব মন্তব্যের অর্থ হলো বন্ধুত্ব নামক সম্পর্কটি চির নতুন, চির উদ্দীপনায় ভরা, চির সুখময়। তবে তা যদি প্রকৃত হয়। কারণ আজকাল সবকিছুর মধ্যেই যে হারে ভেজাল ঢুকে গেছে, বন্ধুত্ব নামক এই সম্পর্কটিও গুটিকয়েক কুবন্ধুর কারণে কুলষিত হচ্ছে। মা, বাবা, ভাই, বোন, সবাই থাকার পরও জীবনে একজন বন্ধুর খুবই দরকার। অন্য সবার কাছে যা ব্যক্ত করা যায় না, তা বন্ধুর কাছে অনায়াসেই বলা যায়। যদি সে বন্ধুই হয়, তবে সে পরম আত্মীয় থেকেও আত্মীয়। তবে আজ বন্ধু চেনাটাই সবচেয়ে দুরূহ কাজ। কে বন্ধু আর কে পরিচিত, তা নিয়েই জীবনের অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। হয়তো বছরের পর বছর একসঙ্গে থেকেও বন্ধু ভেবেও শেষটা আর বন্ধু হওয়া হয়ে ওঠে না। তাই এক কথায় বলা যায়, চেতনার ঐক্যের নাম বন্ধু।

ছোটবেলা থেকেই আমরা দুই বন্ধু ও ভাল্লুকের গল্পটা জানি। যেখানে এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে রেখেই নিজে বাঁচার তাগিদে গাছে উঠে পড়ে। যদিও অন্য বন্ধু তাৎক্ষণিক বুদ্ধির জোরে বেঁচে যায়। কিন্তু এই গল্পটার মোরাল হলো বিপদের সময় যে বন্ধু তোমাকে ত্যাগ করে, সে প্রকৃত বন্ধু নয়। তার সঙ্গ পরিত্যাগ করাই উত্তম। বন্ধুত্বের বিশ্বস্ততার উদাহরণ নিয়ে অনেক গল্পও রয়েছে। যেখানে বন্ধু চরমতম বিপদের সময়েও বন্ধুকে পরিত্যাগ করেনি। এ রকম একটি গল্প হলোÑ প্রতিপক্ষের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধের সময় এপাশে এক সৈনিক বন্ধু একা যুদ্ধ করতে করতে গুলি খেয়েছে। তার থেকে একটু দূরে থাকা অপর বন্ধুটি সেই বন্ধুকে সাহায্য করার জন্য যাওয়ার অনুমতি চাইল। কমান্ডার তাকে সেখানে যাওয়ার বিপদ সম্পর্কে সাবধান করলে বন্ধুটি এসব চিন্তা না করেই বিপদের মুখে গুলি লাগা বন্ধুটির কাছে যায়। পরে বন্ধুর লাশ নিয়ে ফিরে আসে। তা দেখে কমান্ডার বলে, তোমার বন্ধু তো মারা গেছে আর তুমিও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কী লাভ পেলে?’ জবাবে বন্ধুটি বলল, আমি আমার বন্ধুর শেষ কথাটি শুনতে পেরেছি। কী ছিল সেই শেষ কথাটি? জানতে চাইল কমান্ডার। ও আমাকে দেখে বলেছিল, আমি জানতাম তুমি আমার কাছে আসবে। তবে আমাদের সমাজে বিপদের সময় গাছে উঠে যাওয়া বন্ধু বা গাছে তুলে মই টান দেওয়া বন্ধু ক্রমেই বেড়ে চলেছে। কথায় কথায় আমরা বলি সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎসঙ্গে সর্বনাশ। বন্ধু শব্দটি খুব ছোট কিন্তু এর অর্থের ব্যাপকতা সীমাহীন। কোনো সুনির্দিষ্ট গ-িতে বন্ধুত্বের সম্পর্ককে আবদ্ধ করে রাখা যায় না। সে চেষ্টা করা কেবল অর্থহীন শক্তির অপচয় মাত্র। বন্ধু মানে একে অপরের সুহৃদ। দুটি হৃদয় যখন সব সংকীর্ণতা, সব হিংসা, কপোটতা, সব ক্রোধ মুক্ত হয়ে একত্র হয়, পাশে থাকে, পরামর্শ দেয় সেই বন্ধু। সেই হাত প্রকৃত বন্ধুত্বের হাত, যা সারাজীবন বাড়িয়েই থাকে।

বন্ধুত্ব বা বন্ধু নিয়ে এত কথা লিখতাম না। কিন্তু আগস্ট মাসের প্রথম রোববার বন্ধু দিবস হিসেবে সারা বিশ্ব পালন করে থাকে। এই দিনে বন্ধুরা একে অপরকে উপহার দেয়, সবাই মিলে পার করে কিছুটা বাড়তি সময়। কবে কোথায় প্রথম এর সূচনা হয়েছিল তা নিয়ে একাধিক মত প্রচলিত আছে। তবে বেশ কিছু ইতিহাস থেকে ধারণা করা হয়, ঊনবিংশ শতাব্দীর ত্রিশ থেকে চল্লিশ দশকের মধ্যবর্তী সময়ে বন্ধু দিবস পালন করার রীতি আরম্ভ হয়। প্রথম দিকে কিছু কার্ড তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধু দিবসের পালন শুরু করে। বন্ধুরা একে অপরকে কার্ড ও অন্যান্য গিফট উপহার দিয়ে এ দিনটি পালন করত। ধারণা করা হয়, ১৯৩৫ সালের দিকে আমেরিকাতে প্রথম বন্ধু দিবস পালন শুর হয়। পরে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তা ছড়িয়ে যায়। আবার একই সঙ্গে প্যারাগুয়ের নামও শোনা যায়। ১৯৫৮ সালে সর্বপ্রথম ৩০ জুলাই বন্ধুত্ব দিবস পালনের প্রস্তাব করা হয়। তবে ২৭ এপ্রিল ২০১১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৩০ জুলাই অফিসিয়ালি আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস ঘোষণা করে। কিন্তু ভারতসহ অনেক দেশই আগস্ট মাসের প্রথম রোববার বন্ধু দিবস পালন করে আসছে।

আত্মার সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে হয় আত্মীয় আর বন্ধু। বন্ধুর অবস্থান তো আত্মা, অস্থিমজ্জায় মিশে একাকার হয়ে থাকা। তবে কিনা আজকাল বন্ধুর অভাব নেই। ফেসবুক, গুগুল প্লাস, স্কাইপে এ রকম অনেক ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের কি আর অভাব আছে। এসব বন্ধুর কোনটা যে আসল আর কোনটা নকল তাও কি ধরার ক্ষমতা আছে। শুধু প্রোফাইলে ভারী ভারী সব পদবী দিলেই তা আসল ভেবে বন্ধু বানিয়ে নেই। যাচাই করার এত সময়ও নেই, সুযোগও নেই। তাই বন্ধুর বেশে প্রতারণার হারও ক্রমেই বাড়ছে। বন্ধুর ওপর বিশ্বাসে চিড় ধরছে। এত এত বন্ধুর ভিড়ে আসল বন্ধুটিকে চিনে নেওয়ার কাজটি একটু কঠিনই বটে। বন্ধু দিবস শুধু একটি দিনে বন্ধুকে পেট পুরে খাইয়ে বা দামি উপহার দিয়ে একদিনেই শেষ হওয়ার মতো কোনো সম্পর্ক নয় বরং বছরের প্রতিটি দিন একে অপরের পাশে থাকার নামই বন্ধুত্ব। এখন প্রশ্ন, কে বন্ধু হতে পারে? এরা কি পরিবারের বাইরের হতে হবে? আসলে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। যে কেউ তোমার বন্ধু হতে পারে। সে তোমার মা-বাবাও। আর সত্যি কথা বলতে, মা-বাবাই তো সন্তানের সব থেকে কাছের, সব থেকে প্রিয় এবং উৎকৃষ্ট বন্ধু।

ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের চারদিকে আজ অশান্তির অনল। এই অনলে পুড়ে দগ্ধ হচ্ছে আমাদের সবাই। চারদিকে হানাহানি, অবিশ্বাস, প্রতিশোধের নেশা, একে অপরকে আক্রমণ করার মনোভাব এসব বিরাজ করছে। শান্তির জন্য সবাই কেমন মরিয়া হয়ে ছুটছে। প্রত্যেকেই সুখের খোঁজ পেতে পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চষে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সুখ পাচ্ছে কি? সংকীর্ণতায় আবদ্ধ হয়ে সুখ খোঁজার বৃথা এই চেষ্টা। তবু আমরা ছুটছি। থেমে থাকারও তো কোনো উপায় নেই। এত কিছুর মধ্যে সন্তানকে মানুষ করার বিষয়টি যেন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে মা-বাবার জন্য। নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করেও যেন মানুষ হওয়ার বিষয়টি অসম্পূর্ণই থেকে যাচ্ছে। প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। ভালো ফলাফল যেন অনেক সময় পরিহাস করছে। তা ছাড়া ব্যস্ততায় ঘেরা জীবনে মা-বাবার সঙ্গে সন্তানদের দূরত্ব বেড়েই চলেছে। প্রয়োজনের তাগিদে দুজনেই যখন চাকরিরত সন্তান, তখন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। আগেই বলেছি, মা-বাবাই সন্তানের সব থেকে কাছের বন্ধু। সন্তানের মনের কথা তাদের জানতেই হবে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হচ্ছে। শিশুকাল থেকেই মা সন্তানের সব থেকে কাছে থাকে। সন্তান কেন কাঁদে তা জানার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে, আবার হাসলে ঠিক তার কারণ খুঁজে বের করে। ঠিক এমনিভাবেই বড় হলেও সন্তান কী চায় সেই মনের কথা একজন ভালো বন্ধু হয়েই বুঝতে হবে। ধমকের স্বরে দূরে সরিয়ে রাখলে সেই দূরত্ব বাড়তে বাড়তে এত দূরত্ব তৈরি হবে যে, কাছে আনাটা কষ্টকর হয়ে উঠবে। বন্ধু হওয়ারও যোগ্যতা থাকা দরকার। এই যোগ্যতা কোনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া সার্টিফিকেটের যোগ্যতা নয়। এই যোগ্যতা কাছে আসার যোগ্যতা, অন্যকে বোঝার যোগ্যতা, ভালোবাসার যোগ্যতা এবং সর্বোপরি বন্ধুর জন্য ত্যাগ স্বীকার করার যোগ্যতা। আমাদের কজনেরই বা আজ সে যোগ্যতা রয়েছে। আমরা তো কেবল স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত থাকি। স্বার্থ ফুরালে চম্পট দেই। বন্ধুত্বের সুযোগে আঘাত করি। কিন্তু এ সমাজকে বাঁচাতে আজ নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের খুব দরকার। সেই বিখ্যাত গানের মতো শেষ বয়সে মনে পড়ে ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, কোথায় হারিয়ে গেছে সোনালি বিকেলগুলো সেই।’ বন্ধুদের সঙ্গে কিশোর, যৌবনে কাটিয়ে আসা সেই দিনগুলোই একসময় বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। আর মনে মনে বলি, ‘ভালো থেকো বন্ধু।’

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist