রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৫ আগস্ট, ২০১৮

পর্যালোচনা

ট্রাম্পের ইউরোপ সফর

এই প্রথমবারের মতো ইউরোপ সফরে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্ট অবাঞ্ছিত ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখে পড়লেন। বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে দুই দিনের ন্যাটো সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলকে নামের প্রথম অংশ ‘অ্যাঙ্গেলা’ বলে কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করেন বলে অভিযোগ তোলা হয়। রাশিয়ার সঙ্গে জার্মানির সম্পর্ক নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন। এরপর সম্মেলনে ন্যাটো সদস্য দেশগুলোকে নিজেদের জিডিপির দুই শতাংশ সামরিক ব্যয় নিশ্চিত করিতে এবং চার শতাংশ পর্যন্ত এই খাতে ব্যয় বাড়াতে বলেন। এই চাপ সৃষ্টিতে অনেকে অসন্তুষ্ট হন। তার প্রমাণ হলো, এই সম্মেলনের অর্জনকে ট্রাম্প নিজের ব্যক্তিগত বিজয় হিসেবে উল্লেখ করলেও তা নাকচ করে দেয় ফ্রান্স ও ইতালি। এরপর চার দিনের সফরে যুক্তরাজ্যে পৌঁছানোর পর ট্রাম্প ব্রিটেনের রানি ও প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’র সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন বলে অভিযোগ ওঠে এবং এখানেও হাজার হাজার মানুষের প্রতিবাদের সম্মুখীন হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান দেশগুলোর মধ্যে এমন অনাকাক্সিক্ষত সম্পর্ক আর কখনো দেখা যায়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তগুলোকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে সেখানে কেবল মার্কিন স্বার্থরক্ষারই আলামত পাওয়া যায়। কিন্তু একেই মিত্র দেশগুলো স্বার্থপর আচরণ হিসেবে বিবেচনা করেছে। ট্রাম্প প্রশাসন নিজ দেশের অর্থনীতিকে চাঙা ও গতিশীল করতে বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধের অবতারণা করেছে। এ যুদ্ধ যেমন চীনের সঙ্গে চলছে, তেমনি ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গেও চলছে।

২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখলের পর ২৯ সদস্যের জোট ন্যাটো প্রতিরক্ষা বরাদ্দ কমানো স্থগিত রাখিয়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খরচ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এক দশকের মধ্যে মোট জিডিপির দুই শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করার কথাও বলা হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন এটাকে চার শতাংশে উন্নীত করার কথা বলছেন। উল্লেখ্য, ইউরোপকে পারমাণবিকসহ নানা সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। জার্মানিতে এখনো যুক্তরাষ্ট্রের ১০ হাজার সেনা অবস্থান করছে। রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পর বাল্টিক অঞ্চলে ও পোল্যান্ডে ন্যাটোকে হাজার হাজার সৈন্য সমাবেশ করতে হয়েছে। এই বিপুল ব্যয়ে মিত্রদেশগুলো কেন কাক্সিক্ষত হারে খরচ করবে না, একজন ব্যবসায়ী কাম প্রেসিডেন্টের এমন দাবিকে আসলে অগ্রাহ্য করার কোনো উপায় নেই। প্রকৃতপক্ষে ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি, তার বৈশ্বিক বাণিজ্য যুদ্ধ, অভিবাসনবিরোধী অবস্থান ও বিভিন্ন অনাকাক্সিক্ষত আচরণÑবিশ্বমন্দা উত্তর আমেরিকার অস্থিতিশীল অর্থনীতিরই বহিঃপ্রকাশ। আশার কথা, ট্রাম্পের রূঢ় কথায় কাজও হচ্ছে। ন্যাটো মহাসচিব ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের এক উপ-সম্পাদকীয়তে বলেছেন, সদস্যভুক্ত দেশগুলোর প্রতিরক্ষা বাজেট সম্মিলিতভাবে ৫ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, গ্রিসের পাশাপাশি এ বছর ইস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথিউনিয়া, পোল্যান্ড ও রুমানিয়াও এ বাজেট বৃদ্ধির তালিকায় রয়েছে। অতএব, ট্রাম্পের হুমকি-ধমকি বৃথা যাচ্ছে না বলেই প্রমাণ হয়। অন্যদিকে ট্রাম্প-পুতিন আলোচনায় যেসব চুক্তি নিয়ে দুই পক্ষ আদৌ কোনো সমঝোতায় উপনীত হবে কি না, সে প্রশ্ন থাকলই। রুশ-মার্কিন সম্পর্কের অবনতি কারো জন্যই কোনো ভালো খবর নয়। প্রেসিডেন্ট পুতিন ক্ষমতায় থাকবেন ২০২৪ সাল পর্যন্ত।

সুতরাং পুতিনকে আস্থায় নিয়েই বিশ্বে স্থিতিশীলতা আসবে। পারমাণবিক ঝুঁকি কমানো সম্ভব হবে। আস্থাহীনতার সম্পর্ক বৃদ্ধি পেলে তা বিশ্বে উত্তেজনা ছড়াবে মাত্র। স্নায়ুযুদ্ধ বিশ্বে কোনো মঙ্গল ডেকে আনেনি। সুতরাং নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হলে তা-ও কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ট্রাম্পকে নিয়ে। তিনি এক ধরনের আগ্রাসী নীতি নিয়ে চলতে পছন্দ করেন। ট্রাম্প-উন (উত্তর কোরিয়ার নেতা) শীর্ষ বৈঠক আয়োজনে চীনের একটি বড় ভূমিকা থাকলেও চীনের সঙ্গে এক ধরনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধে’ তিনি জড়িয়ে গেছেন। কানাডা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গেও তিনি একই ধরনের আচরণ করছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি খুব স্বাভাবিকভাবেই মস্কোকে কাছে পেতে চাইবেন। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ যদি তিনি না নেন, যদি মস্কোর সঙ্গে এক ধরনের সহাবস্থানে না যান (সিরিয়া, ইউক্রেন ও পারমাণবিক অস্ত্র প্রশ্নে), তাহলে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বাড়বেই। এর ফলে চীন-রাশিয়া ঐক্য আরো শক্তিশালী হবে এবং স্নায়ুযুদ্ধ-২-এর সম্ভাবনা আরো বাড়বে।

জার্মানি পুরোপুরি রাশিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। গত ১১ জুলাই ব্রাসেলসে ন্যাটোর মহাসচিব স্টোলটেনবার্গের সঙ্গে বৈঠকের সময় তিনি এই মন্তব্যটি করেন। শুধু জার্মানিই নয়, তিনি অন্য ইউরোপিয়ান দেশগুলোর বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনেন। তিনি অভিযোগে করেন, গ্যাস কেনা বাবদ জার্মানি প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি ডলার রাশিয়ার হাতে তুলে দিচ্ছে। এ বিষয়ে ন্যাটোর মনোযোগ দেওয়া উচিত। ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে ট্রাম্পের আরেকটি অভিযোগ হচ্ছেÑ ন্যাটোর সদস্যরা প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়বরাদ্দ বাড়াচ্ছে না। ট্রাম্পের অভিযোগ, জার্মানি জিডিপির ১ শতাংশের চেয়ে সামান্য বেশি অর্থ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করে ৪ দশমিক ২ শতাংশ। তবে ট্রাম্পের এ বক্তব্যের পেছনে কিছুটা বিভ্রান্তি রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে জার্মানি প্রতিরক্ষা খাতে তারচেয়ে বেশি অর্থ (জিডিপির দেড় শতাংশ) ব্যয় করে। আর যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করে সাড়ে ৩ শতাংশের মতো। এর আগে ন্যাটোর সদস্যরা একমত হয়েছিল, ২০২৪ সালের মধ্যে সবাই জিডিপির ২ শতাংশ ব্যয় করবে। এখন যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে জিডিপির ৪ ভাগ। সবচেয়ে মজার কথা, ন্যাটো সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলার পর তিনি ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন। ওই সম্মেলনে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়বরাদ্দ বাড়ানোর ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ করা না হলেও ট্রাম্প সম্মেলন শেষে স্বীকার করেছেন এই বরাদ্দ এখন বাড়বে! তিনি এ কথাও বলেছেন, ন্যাটো এখন দু-দিন আগের চেয়ে আরো শক্তিশালী।

এ থেকেই বোঝা যায়, ন্যাটো সম্পর্কে ট্রাম্পের এক ধরনের বিভ্রান্তি রয়েছে। তিনি মনে করছেন, ইউরোপিয়ান শক্তিগুলো হয়তো একসময় রাশিয়ার সঙ্গে এক ধরনের সখ্য গড়ে তুলতে পারে, যা কি না তার স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। শুধু প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়বরাদ্দ বাড়ানোই নয়, বরং ট্রাম্প প্রশাসন বাণিজ্য নিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে এক ধরনের বিবাদে জড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (২০১৬) রাশিয়ার পরোক্ষ হস্তক্ষেপ, সিরিয়ায় আসাদের পক্ষাবলম্বন ইত্যাদি কারণে দেশ দুটির মধ্যে বড় ধরনের আস্থাহীনতার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এরই মদ্যে যুক্তরাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ক্ষুদ্র আকারের পরমাণু বোমা তৈরি করার, যা কি না বিশ্বে পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে উসকে দেওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন ব্রিটেন প্রথমে ২৩ রুশ কূটনীতিককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছিল। অভিযোগ ছিল, ব্রিটেনে বসবাসরত একসময়ের রুশ গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য সার্গেই স্ক্রিপালকে হত্যার! স্ক্রিপাল ছিলেন ডবল এজেন্ট। তিনি রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করলেও একই সঙ্গে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাকেও তথ্য সরবরাহ করতেন। তাই স্ক্রিপালকে যখন নার্ভ গ্যাস প্রয়োগ করে হত্যা করার প্রচেষ্টা চালানো হয়, তখন অভিযোগ ওঠে রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে। ব্রিটেনের এই সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ। তারা সবাই মিলে ১৩৯ রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করে। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে রাশিয়া বহিষ্কার করে ১৫০ পশ্চিমা কূটনীতিককে, আর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনের কূটনীতিকরাও ছিলেন। এই বহিষ্কার ও পাল্টা বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে নতুন করে দুই দেশের মধ্যে (যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া) উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল।

একটা সময় ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ইউরোপে প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে দুই পরাশক্তির মধ্যে এক ধরনের ‘যুদ্ধের’ সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল। দীর্ঘ সময় ওই পরিস্থিতি বহাল ছিল, যা ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে স্নায়ুযুদ্ধ হিসেবে। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধকালীন দীর্ঘ সময়ে একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যেখানে দুই পরাশক্তির কাছে যে পারমাণবিক অস্ত্র ছিল, তা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এ ক্ষেত্রে আরো কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ১২২ দেশ পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল। রাশিয়া এখন পূর্ব ইউক্রেনে তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করছে এবং উইক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট পেট্রো প্রোসেনকাকে উৎখাতের উদ্যোগ নিতে পারে। একই সঙ্গে চীন-রাশিয়া সহযোগিতা আরো বৃদ্ধি ট্রাম্পের জন্য চিন্তার কারণ। সার্গেই স্ক্রিপালের হত্যার ঘটনায় পশ্চিমাবিশ্ব যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, চীন তার সমালোচনা করেছিল। চীন কোনো মার্কিন কূটনীতিককে বহিষ্কার করেনি সত্য; কিন্তু নৈতিকভাবে রাশিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই সফরকে উদ্দেশ্য করে বিক্ষোভ প্রদর্শনের নানা ধরনের পরিকল্পনা থাকলেও, তার কড়া নিরাপত্তা বলয়ের মধ্য দিয়ে লন্ডন থেকে চেকার্স, চেকার্স থেকে উইন্ডসর আর উইন্ডসর থেকে স্কটল্যান্ডের যাত্রায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে তার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে বিক্ষোভ কার্যক্রম আড়াল করলেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের রজনৈতিক মতাদর্শের পার্থক্য আলোচনায় আসছে এ সফরের আগে।

লেখক : কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist