আবু তাহের

  ০৩ আগস্ট, ২০১৮

মতামত

বিদেশ সফরে আমলা গামলা

দেশ-বিদেশে ঘুরতে কার না ভালো লাগে। আগের জামানায় উচ্চবিত্ত পরিবারের লোকজন বিলেত যেত। পয়সা খরচ করে ব্যারিস্টারি পাস করত। এটার অবশ্য একটা ভালো দিক ছিল, লেখাপড়া শিখে বড় হওয়া। তারপর দেশে ফিরে মানুষের সেবা করা। এখন অবশ্য যুগ বদলেছে, মানুষেরও পয়সা হয়েছে ঢের। সুযোগ পেলেই বিদেশ ঘুরতে ভোলে না। আর যদি সে ঘোরাঘুরিতে নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করতে না হয় তবে তো সোনায় সোহাগা।

এখন চলছে হজের মৌসুম। আর এই মৌসুমে সৌদি আরবে অবস্থানকালীন বাংলাদেশি হজযাত্রীদের চিকিৎসাসেবা দিতে গঠিত হজ চিকিৎসক দলকে সহায়তা করতে হজ সহায়ক দল গঠন করেছে সরকার। সেখানে মন্ত্রী-সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও সহকারী সচিবসহ বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের রাখা হয়েছে। চিকিৎসাসেবা দিতে মন্ত্রী-সচিবের লোক! বিগত সময়ে দেখা গেছে, হজ মৌসুমে বাংলাদেশি হজব্রত পালনকারীদের চিকিৎসাসেবা দিতে বাংলাদেশ থেকে ডাক্তার, নার্স, ফার্মাসিস্ট ও প্যারামেডিক্সের সমন্বয়ে গঠিত হজ চিকিৎসক দল নামে একটি দল সৌদি আরবে পাঠানো হয়। সেই হিসাবে এবারও ২৩৭ সদস্যের হজ চিকিৎসক দল পাঠানো হয়েছে। হজ চিকিৎসক দলকে সহায়তা করতে ১২১ সদস্যের হজ সহায়ক দল গঠন করা হয়েছে। এ দলের সদস্যরা মেডিকেল ক্লিনিকে রোগীদের সৃষ্ট ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার, রোগীদের চিকিৎসা ও ওষুধ গ্রহণে সহযোগিতা, ক্লিনিক পরিচ্ছন্ন রাখা এবং চিকিৎসক দলের নেতার নির্দেশে অন্য দায়িত্ব পালন করবেন।

কিন্তু এবার মনে হয় সে ভাগ্য আর হবে না তাদের। চলতি বছর যে হজ সহায়ক দল গঠন করা হয়েছে তাতে সহকারী সচিব, মন্ত্রী-সচিবের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব, ইফার ডিজির পিএস, পুলিশেরএসআই, বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, মন্ত্রী-সচিবের গানম্যান ও গাড়িচালকসহ প্রভাবশালী কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দ্বারা কতটুকু সহায়তা হবে চিকিৎসক দলের। কারণ, এসব পদস্থ কর্মকর্তা সেখানে গিয়ে তারা হজ সহায়ক দলের সদস্য হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করবেন। দ্বিতীয়ত যে কাজের তালিকা তাদের হাতে রয়েছে সে কাজগুলো তাদের পদমর্যদা অনুযায়ী খাপ খায় না। আসলে কি রোগীর সেবা নাকি এর আড়ালে তারা মূলত সরকারি টাকায় হজ পালনের জন্য সৌদি আরব যাবেন। হজ সহায়ক দলের সদস্য হিসেবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হলে তারা সেখানে গিয়ে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেন এই স্বাভাবিক। কিন্তু পদস্থ কর্মকর্তারা সহায়ক দলের সদস্য হয়ে গেলেও সেখানে তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, প্রশ্ন থেকে যায়।

বিদেশ ভ্রমণের এই খবর নতুন নয়। এর পূর্বেও কিছু লোক প্রধানমন্ত্রীকে ডিঙিয়ে কিছু করার চিন্তুা করেছিল। বছর খানেক আগে অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প আমার নিজস্ব আইডিয়া ছিল। প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন করে যখন আমার কাছে দেখাতে আসে, তখন দেখি সেখানে বিদেশ সফরের ব্যবস্থা রাখা আছে। আমি সেই বিদেশ সফর ও বরাদ্দকৃত টাকা কেটে দিলাম। পরে দেখি প্রকল্পটি আর একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য ওঠে না।’ সভায় এক হাজার ৮১৭ কোটি টাকার ছয়টি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কেন প্রকল্পটি আসে না খবর নিয়ে জানতে পারলাম, প্রকল্পে বিদেশ সফর না থাকার কারণে অনুমোদনের জন্য আনা হচ্ছে না। পুনরায় বিদেশ সফরের ব্যবস্থা রাখার নির্দেশ দেওয়ার পর প্রকল্পটি একনেক সভায় আনা হয়।’ তিনি বলেন, ‘বিদেশ সফর না থাকলে আমার প্রকল্প পর্যন্ত অনুমোদন হয় না।’ বিষয়টি আসলেই অবাক করার মত। অহেতুক বিদেশ সফর করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়গুলো অনুমোদিত হয় না। এমন কি প্রধানমন্ত্রীর বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিজেও অতিষ্ঠ। যথেষ্ট আক্ষেপ ও বিরক্তি নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘বিদেশে যেতে আমার কাছে যে হারে তদবির আসে, দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ কাজের ফাইল অনুমোদনের জন্য সে রকম তদবির আসে না। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক।’

রাষ্ট্রের এই বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় করে বিদেশ ভ্রমন কতটুকু সুফল বয়ে আনে? বাস্তবতার নিরিখে ফলাফল প্রায়ই শূন্য। যেমন রেলওয়ের সংস্কার প্রকল্পের কাজ। এই সংস্কারের নামে অভিজ্ঞতা অর্জনে ছিল বিদেশ সফর। অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন ও মালয়েশিয়ার সফর হয়ে গেছে। রেলকে ঘিরে এই বিদেশ সফর আসলেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন ও মালয়েশিয়ার রেল ব্যবস্থাপনার সাথে বাংলাদেশ রেলওয়ের কোন সামঞ্জস্য নেই। ইতিমধ্যে এই সফরগুলোতে কোটি টাকার উপর ব্যয় হয়ে গেছে। কর্মকর্তাদের এই মানসিক চিন্তাধারা আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার পরিবর্তে কতটুকু পিছিয়ে দিচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর যতই দিন যাচ্ছে এই প্রতিযোগিতা যেন বেড়েই চলছে। দেশটাকে যেন হরিলুটের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যে যার মত করে খুবলে খাচ্ছে। দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের এমন মানসিকতা দেশের অবনতি ছাড়া আর কিছুই নয়।

একনেক ওই সভায় বিদেশ সফরের বিষয়টি উত্থাপন করেন একজন জ্যেষ্ঠ সচিব। ৫০ জেলায় ১৫ হাজার কৃষককে ফসল সংগ্রহ পরবর্তী সময়ে কম সুদে ঋণ দেওয়ার একটি প্রকল্প সভায় উত্থাপন করা হলে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘এ ধরনের একটি মহৎ ও ভালো প্রকল্পেও বিদেশ সফরের জন্য ৪২ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। ১৪ জন কর্মকর্তা বিদেশে যাবেন।’ অবাক করা বিষয় হলো এই প্রকল্পেও বিদেশ সফর হয়! কারণ হিসাবে জ্যেষ্ঠ সচিব বলেন, বাংলাদেশকে বলা হয় ক্ষুদ্র ঋণের বিশ্ববিদ্যালয়। ক্ষুদ্র ঋণের জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা বিশ্বজুড়ে। বিশ্বের জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা এ দেশে আসেন ক্ষুদ্র ঋণের পদ্ধতি দেখার জন্য। অথচ, দেশ থেকে কর্মকর্তারা বিদেশে যেতে চাচ্ছেন!

গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, কর্মকর্তারা সরকারি অর্থায়নের প্রকল্পের সূত্রে বিদেশ যেতে বেশি আগ্রহী। কিন্তু উন্নয়ন সহযোগী কোনো দেশ বা সংস্থা যদি কোনো কর্মকর্তাকে বিদেশে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়, তখন তারা যেতে আগ্রহী হন না।’ কারণ হিসেবে, সরকারি টাকায় বিদেশ গেলে খরচ কমিয়ে কিছু টাকা বাঁচানো যায়। কিন্তু উন্নয়ন সহযোগী দেশ বা সংস্থা নিয়ে গেলে তারাই সব ব্যবস্থা করে। সেখান থেকে টাকা বাঁচানোর সুযোগ থাকে না।

রাষ্ট্রের এই হর্তকর্তারা দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে জানা নেই। এর পূর্বে বিশ্বব্যাংকের ঋণের টাকায় নির্বাচন কমিশনে বিদেশ ভ্রমণের হিড়িক পড়েছিল। তারা একে একে অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও সুইজারল্যান্ড সফর করেছিলেন। পরিচয়পত্র তৈরির জন্য টেকনিক্যাল কর্মকর্তার তুলনায় কমিশন সদস্য এবং সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা কেন প্রয়োজন ছিল তা বোধগম্য নয়। এরকম অনেক উদাহরণ পেশ করা যাবে। কিন্তু আমাদের চিন্তাভাবনা দৌড় কোন পর্যন্ত? প্রায়ই প্রত্যেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় ব্যক্তিস্বার্থ সবার আগে দেখা হয়। একনেক সভায় ১৫ হাজার কৃষককে ফসল সংগ্রহ পরবর্তী সময়ে কম সুদে ঋণ দেওয়ার একটি প্রকল্পে বিদেশ সফরের জন্য ৪২ লাখ টাকা বরাদ্দের টাকা গুলো ওই প্রকল্প না হলেও দেশের বিভিন্ন স্তরের অনেকগুলো সমস্যার সমাধান সম্ভব। এ ক্ষেত্রে আমাদের আন্তরিকতাই যথেষ্ট। দেশেকে নিয়ে একটু ভাবতে হবে। ভাবতে হবে দেশের মানুষকে নিয়ে। দেশের বন্যা পরিস্থিতি খুবই নাজুক অবস্থায়। লাখ লাখ মানুষ অনাহারে খোলা আকাশের নিচে মানবেতরভাবে জীবনযাপন করছে। একমুঠো খাবারের জন্য প্রতিক্ষণ তাদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা ব্যক্তিগত বিনোদনের জন্য বিদেশ সফরের জন্য উঠে পড়ে লেগেছি। দেশের মানুষের জন্য একটু ভাবুন, এরপরও যদি না হয় তবে আমি বিদেশ সফরের একটা শর্টকাট ফর্মুলা বাতলে দিতে পারি। আর তা হলো ৫০ টাকায় বিদেশ সফর। জনগণের পয়সা না ভেঙে নিজের পকেটের মাত্র ৫০ টাকা খরচ করেই আপনি বিদেশ ভ্রমণ করে আসতে পারেন।

দুটো আলাদা স্বাধীন দেশ। কিন্তু এক দেশ থেকে আরেক দেশে প্রবেশে লাগবে না কোনো পাসপোর্ট। শুধু নিজ দেশের ইমিগ্রেশন দফতর থেকে দেওয়া বর্ডার পাসটা দেখালেই হবে। ওই দেশে প্রবেশে আর কোনো বাধা নেই। আর এই এক দেশ থেকে আরেক দেশ সফরের অনুমতি পেতে খরচ করতে হবে মাত্র ৫০ টাকা! এ ক্ষেত্রে দুই দেশের মানুষ বাংলাদেশের টেকনাফ স্থল বন্দরের ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট ও মিয়ানমারের মংডু ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট ব্যবহার করেন। বাংলাদেশের নাগরিকদের মিয়ানমার যেতে ওদের মুদ্রায় ৮০০ কিয়াট (১৬ কিয়াট = ১ টাকা) জমা দিতে হয়। বাঙালি মুসলিম সেদেশে গিয়ে তিনদিনের বেশি থাকতে পারবে না। শুধু মংডু শহরেই থাকতে পারবেন এ তিনদিন।

বিদেশ সফরের এ থেকে হয়ত ভালো ব্যবস্থা আর নেই। তারপরও অনুরোধ, আরেকবার ভাবুন। দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে ভাবুন।

লেখক : কলামিস্ট ও সমাজ বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist