এস এম মুকুল

  ০১ আগস্ট, ২০১৮

সমাচার

মেধা ও মননে বাংলাদেশ

মেধা আর পরিশ্রম এক হলে যেকোনো মানুষ সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করতে পারে, যশোরের চাঁচড়া গ্রামের ইউসুফ আলী তার অনন্য উদাহরণ। উচ্চশিক্ষিত হয়ে চাকরি না করেও কৃষিকাজের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই কৃষিকাজের প্রতি খুব ঝোঁক ছিল তার। ধান ও ফলের বাগান তৈরিতে বাবাকে সাহায্য করতেন ইউসুফ। কৃষির প্রতি আগ্রহের কারণেই ১৯৮২ সালে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে বের হন। চাকরি-বাকরি না করে কৃষিকাজ করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন ইউসুফ। শুরু হয় তার কৃষি বিপ্লবের সংগ্রাম। বাড়ির পাশে বলাডাঙ্গা এলাকায় পরিচিত লোকদের বুঝিয়ে দুই বিঘা জমি বর্গা চাষ শুরু করেন। এসব জমিতে উচ্চফলনশীল ধানবীজ ব্যবহার করে জৈব সার প্রয়োগের মাধ্যমে প্রথম বছরেই বাজিমাত করে দেখান এলাকার কৃষকদের। অর্জিত শিক্ষাকে নির্দ্বিধায় তিনি প্রয়োগ করেন মাঠে-ময়দানে। তার ব্যাপক সাফল্যে স্থানীয় কৃষকের হয়ে উঠেছেন উজ্জীবিত। একজন আদর্শ প্রগতিশীল কৃষক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন ইউসুফ আলী। তারপর তার ভাবনায় ঘুরপাক খায় আরো বড় কিছু করার। কৃষিকাজের লাভ দিয়ে ১৯৮৮ সালে যশোর সদর উপজেলার ঘুরুলিয়া গ্রামে ১০ বিঘা জমি কেনেন। একটি বৃহৎ পরিসরের খামার গড়ে তোলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজে লাগেন নিরলস। লেগে থাকলে কি-না হয়। এখন ২৩ একর জমিতে তার স্বপ্নের খামার। খামারের নাম মাওলা মৎস্য ও কৃষি খামার। ইউসুফ আলী তার মেধা, পরিকল্পনা আর পরিশ্রমে সাফল্য আসছে নিত্যদিন। ২৩ একর জমির কোথাও এতটুকু ফাঁকা নেই। টমেটো, ফুলকপি, লাউ, আলু, ওলকপি, বাঁধাকপি, মিষ্টি কুমড়া, পেঁপেসহ সব ধরনের মৌসুমি সবজির চাষ চলছে হরদম। তার খামারে দেশি মাগুর মাছ এবং টেবিল ফিশ উৎপাদন হয়। পোনা উৎপাদন হয়। রীতিমতো এক সবুজ বিপ্লব তার খামারে। লাভে লাভে ধন্য মাওলা মৎস্য ও কৃষি খামার। ইউসুফ আলী শিক্ষিত হয়ে চাকরি না করে শিক্ষিত কৃষকের অনন্য উদাহরণ দেখালেন। আমাদের তরুণরা যদি ইউসুফ আলীর পথ অনুসরণ করেন, তাহলে এ বিপ্লব ছড়িয়ে যাবে বাংলার ঘরে ঘরে।

সমাজ বিনির্মাণ অনেকভাবেই সম্ভব। কাজ দিয়ে অথবা সেবা দিয়ে। যুগে যুগে কালে কালে এভাবেই ঘটেছে সামাজিক সংস্কার। মানুষ মানুষের জন্য। জীবনের জন্য জীবন। মানবিক মূল্যবোধে এটিই পরম ধর্ম। আমাদের কাজ যেন হয় মানুষের জন্য, জীবনের জন্য। নওগাঁ শহরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে লায়লা আরজুমান বানু। ১৯৮৯ সালে তার বিয়ে হয়। ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার স্বামী মারা যান। দুর্ঘটনার শিকার স্বামীর বি-পজেটিভ রক্তের অভাবে করুণ মৃত্যু তাকে সেবাধর্মী ও সৃজনশীল কাজে অনুপ্রেরণা জোগায়। ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে তৎপর হন আরজুমান বানু। নিজের স্বর্ণালংকার বিক্রি করে ৬০ হাজার টাকা এবং আত্মীয়স্বজন, শুভাকাক্সক্ষীদের থেকে ধারকর্জ করে সংগ্রহ করেন আরো ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এভাবে তার মোট তহবিল দাঁড়ায় ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। স্বামীর জন্মস্থান নাটোরে একটি ব্লাড ব্যাংক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন আরজুমান বানু। স্বামীর মতো প্রয়োজনীয় রক্তের অভাবে মানুষের অসহায় মৃত্যু ঠেকাতেই তার এই মানবিক উদ্যোগ। শুরু হয় মানবসেবায় ব্লাড ব্যাংকের কার্যক্রম। থ্যালাসেমিয়া ও হিউলিটিক অ্যানিমিয়ায় আক্রান্তসহ দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের মধ্যে নামমাত্র মূল্যে রক্ত সরবরাহের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় আরজুমান বানুর ‘নাটোর ব্লাড ব্যাংক’। এটিই নাটোরের প্রথম বেসরকারি ব্লাড ব্যাংক। উজ্জীবিত নারী আরজুমান বানু এরপর নামেন সামাজিক কার্যক্রমে। স্বাস্থ্যসচেতনতা, নারীর কর্মসংস্থান, আয় বৃদ্ধিসহ নানামুখী উন্নয়নমূলক কাজের অঙ্গীকার করেন। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে ১৯৯৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন স্বেচ্ছাসেবী উন্নয়ন সংস্থা ‘লাস্টার’। পর্যায়ক্রমে সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিভিন্ন দাতা সংস্থারও প্রকল্প সহায়তাও পান। সামাজিক উন্নয়ন, সংস্কার এবং মানবিক কার্যক্রমের স্বীকৃতিই তাকে একসময় এনে দেয় সম্মানজনক অ্যাওয়ার্ড। সমাজসেবায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৬ সালে ভারতের দিল্লিভিত্তিক ‘অর্গানাইজেশন অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং ফ্র্যাটারনিটি’ লায়লা আরজুমান বানুকে ‘রামকৃষ্ণ জয়দয়াল হারমনি অ্যাওয়ার্ডস ২০০৪-০৫’ প্রদান করে। ২০০২ সালে তিনি সমাজসেবক হিসেবে ‘অশোকা ফেলোশিপ’ অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।

পরের খবরটি নেত্রকোনার। বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে জেলার ৬৪৯ জন কিশোরী। ১৩ বছরের কিশোরী আছমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন স্বামীহারা বিধমা মা মমিনা বেগম। কিন্তু আত্মসচেতনায় উজ্জীবিত কিশোরী আছমা নিজেই রুখে দাঁড়াল বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে। আছমা নেত্রকোনার কাওয়ালীকোনা গ্রামের বাসিন্দা। স্থানীয় শিমুলজানি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। মা যখন আছমাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে বাধ্য করতে যাচ্ছিলেন, তখন সে কৌশলে উদ্যোগী হয়ে স্কুলের শিক্ষক এবং বেসরকারি সংস্থার কয়েকজন উন্নয়নকর্মীর শরণাপন্ন হয়। তাদের কাছে বাল্যবিয়ের কুফল এবং এর প্রতিরোধ আইন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয় সে। সব জেনে সে আরো সাহসী হয়ে ওঠে। নিজেকে বাঁচাতে সে শিক্ষক, বেসরকারি সংস্থার উন্নয়নকর্মী এবং স্থানীয় অভিভাবকদের সহায়তায় পাত্রপক্ষ ও তার মাকে বাল্যবিয়ের আইন ও কুফল সম্পর্কে অবহিত করে। অবশেষে আছমার মা এবং পাত্রপক্ষের বোধোদয় হয়। তারা তাদের ভুল বুঝতে পারেন। অবশেষে বাল্যবিয়ের ভয়াল পরিণতি থেকে বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলে মুক্তি পেয়েছে আছমা। এটি এখন সে এলাকার দৃষ্টান্ত। আছমার প্রতিবাদ ও সাফল্য বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে জাগরণ সৃষ্টি করেছে এলাকায়।

আছমা এখন নারী জাগরণের উদাহরণ। তার সাহসী দৃষ্টান্ত সচেতনতার নতুন জাগরণ সৃষ্টি করেছে নেত্রকোনায়। শুধু আছমা নয়, নেত্রকোনার গ্রামে গ্রামে এখন অনেক কিশোরী বাল্যবিয়ের ভয়াল পরিণতির শৃঙ্খলমুক্ত। আছমা যেন বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে ও সচেতনায় মডেল নেত্রী। তার এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সে এলাকার কিশোরীরা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অধিকার, পরিবেশ ও আইন সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। কিশোরীদের পাশাপাশি সচেতন হচ্ছে কিশোররাও। তারা আবার সচেতন করে তোলছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে। এ যেন সমবায়ী চেতনার জাগরণ। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নেত্রকোনার বেসরকারি সংস্থা স্বাবলম্বী উন্নয়ন সমিতি ‘কিশোর ক্ষমতায়ন’ নামে একটি প্রকল্প চালু করেছে। এই প্রকল্পে যুক্ত হচ্ছে গ্রামীণ কিশোর-কিশোরীরা। আত্মবিশ্বাসী, সচেতন ও ক্ষমতায়িত মানুষ তৈরির উদ্দেশ্যে ২০০৪ সাল থেকে জার্মানি দাতা সংস্থা নেটস্-জার্মানির অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে প্রকল্পটি। প্রকল্পের কর্ম এলাকা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে নেত্রকোনা সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা। প্রকল্পের নীতিমালা অনুযায়ী ১২ থেকে ১৮ বছরের কিশোর-কিশোরী, যারা শৈশবে শিক্ষার সুযোগ পায়নিÑ তাদের ২০ জনকে নিয়ে গঠন করা হয় রিফ্লেক্ট সার্কেল। দুই বছর মেয়াদি সার্কেলগুলো পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন একজন সহায়ক। তার সহযোগিতায় কিশোর-কিশোরীরা প্রতিদিন স্বাক্ষরতার পাশাপাশি অধিকার, বিভিন্ন আইন, স্বাস্থ্য, প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ে শেখার ও জানার সুযোগ পায়।

কিশোর ক্ষমতায়ন প্রকল্পের আরেকটি কাজ হলো ‘পাইওনিয়ার দল’ গঠন। স্কুলগামী ২১ জন কিশোর ও কিশোরী নিয়ে গঠিত হয় একটি পাইওনিয়ার দল। তাদের দলপতিকে বলা হয় পাইওনিয়ার লিডার। প্রকল্পের ব্যাপ্তি এখন বিশাল। ৩২টি পাইওনিয়ার কিশোরী দলে ৬৪৯ জন কিশোরী এবং ৮টি কিশোর দলে ১৬৮ জন কিশোর এ সংস্থার অধীনে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করেছে। কিশোর-কিশোরীদের এই দলগুলোর উদ্যোগে সচেতনতামূলক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলা, আলোচনা অনুষ্ঠান এবং দেয়াল পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে নিয়মিত। তারা স্কুল মবিলাইজেশন বিভাগের আওতায় বিভিন্ন স্কুলে কৈশোর দল গঠন করে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করছে। ১১টি উচ্চ বিদ্যালয় এবং ১টি মহিলা মাদরাসায় পরিচালিত হচ্ছে এ কার্যক্রম। যেসব কিশোর-কিশোরী দরিদ্র পরিবারের, শৈশব-কৈশোরে যাদের টানতে হয় সংসারের ঘানিÑতাদের জন্য রয়েছে দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম। এ কার্যক্রমে প্রতি বছর ৫০ জন কিশোর-কিশোরীকে সেলাই, নকশি, বাঁশ-বেত, ব্লক ও বাটিকের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এক বছর প্রশিক্ষণ শেষে তারা সংস্থার সহায়তায় নিজ নিজ এলাকায় কাজ করার সুযোগ পায়।

একজন আছমার সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি এখন হাজারো পরিবারে জ্বালিয়েছে আশার আলো। সচেতনার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনে আছমার সাহসী পদক্ষেপকে আমরা স্বাগত জানাই। সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করতে, সমাজকে জাগিয়ে তুলতে এ রকম আছমার জন্ম হোক বাংলার ঘরে ঘরে।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist