নিতাই চন্দ্র রায়

  ৩১ জুলাই, ২০১৮

সাফল্য

মাছ চাষে নীরব বিপ্লব

মাছ এ দেশের মানুষের প্রিয় আমিষজাতীয় খাদ্য। সারা দেশে জালের মতো বিস্তৃত অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় এবং বর্ষাকালে প্রচুর মৌসুমি বৃষ্টিপাত এবং উপযোগী মাটি ও আবহাওয়া বাংলাদেশকে মৎস্য উৎপাদনের এক অপূর্ব লীলাভূমিতে পরিণত করেছে। স্বাধীনতার ৪৬ বছরে বাংলাদেশে মাছ চাষে এক নীরব বিপ্লব হয়েছে। এ বিপ্লবের অগ্রনায়ক হলো গ্রামগঞ্জের সাহসী যুবক-যুবতীরা। তাদের পরিশ্রম, একাগ্রতা ও ঝুঁকি গ্রহণের সামর্থ্যই এ বিপ্লবকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। মৎস্য উৎপাদনের এ নীরব বিপ্লবে মৎস্যবিজ্ঞানীদের আধুনিক প্রযুক্তি, নতুন জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণকর্মীদের মাধ্যমে সেগুলো মৎস্যচাষিদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও মৎস্য অধিদফতরের ভূমিকাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। মাছচাষি, মৎস্যবিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণকর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টা এবং বর্তমান সরকারে মৎস্যবান্ধব নীতির কারণে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে মাছের উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১ লাখ ৩৪ হাজার টন। সে হিসেবে জনপ্রতি গড়ে বার্ষিক মাছের পরিভোগ দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ২৩ কেজি, যা ২০১০ সালেও ছিল মাত্র ১২ কেজি। অর্থাৎ গত আট বছরে বাংলাদেশে মৎস্য পরিভোগের পরিমাণ শতভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। বছরে চার লাখ টন তেলাপিয়া উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ স্থান এবং এশিয়াতে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। এটাও মৎস্যচাষিদের জন্য কম গৌরবের বিষয় নয়। প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে ভারত ও চীন। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্যবিষয়ক সংস্থা এফএওর সাম্প্রতিক প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়। গত দুই বছর আগেও প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছ আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল পঞ্চম। পঞ্চম থেকে তৃতীয় অবস্থানে উঠে আসার মতো এই বিশাল অগ্রগতির পেছনে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির অবদান উল্লেখযোগ্য। দ্য স্টেট অব ফিশ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০১৮ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, চাষের ও প্রাকৃতিক উৎসের মাছ মিলিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে চতুর্থ। চার বছর ধরে বাংলাদেশ তার এ সফলতার অবস্থানটি ধরে রাখে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে। আর মোট মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। নদী-হাওর-বাঁওড়-খাল-বিলসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছ আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধির পেছনে বাংলাদেশের জাতীয় মাছ; ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। উন্মুক্ত জলাশয় থেকে ২০১৭ অর্থবছরে যে ১০ লাখ ৪৮ হাজার টন মাছ উৎপাদিত হয়, তার মধ্যে ইলিশের উৎপাদন ছিল পাঁচ লাখ টন। বর্তমানে সরকারের জাটকা নিধন বন্ধ, ইলিশের নতুন অভয়ারণ্য সৃষ্টি, জেলেদের খাদ্য সহায়তা এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের মতো যুগোপযোগী কর্মসূচি গ্রহণের ফলে তিন বছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দেড় লাখ টন। মৎস্য ও প্রাণিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে মোট দেশজ উৎপাদনে ইলিশের অবদান ১ শতাংশ। দেশের মোট মাছের ১১ শতাংশ উৎপাদন আসে ইলিশ থেকে। পাঁচ লাখ জেলে সরাসরি ইলিশ ধরার সঙ্গে জড়িত।

দেশব্যাপী মহাধুমধামে পালিত হচ্ছে মৎস্য সপ্তাহ-২০১৮। এবারের মৎস্য সপ্তাহের প্রতিপাদ্য হচ্ছেÑ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ মাছে দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে ইতোমধ্যে ৬০টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর মধ্যে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ১৮টি মাছের পোনা উৎপাদন করেছেন প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞানীরা। এ ছাড়া প্রচলিত মৎস্য প্রজাতির পাশাপাশি বাণিজ্যিক গুরুত্বসম্পন্ন অপ্রচলিত কুঁচিয়া, শামুক, কাঁকরা, সি-উইড ইত্যাদি সংরক্ষণ ও চাষাবাদ কৌশল উন্নয়নে বর্তমান সরকার গুরুত্বারোপ করছে। আমাদের খাদ্য তালিকায় এসব অপ্রচলিত প্রজাতির জলজ প্রাণীর চাহিদা না থাকলেও বিদেশে এসবের প্রচুর চাহিদা ও বাজারমূল্য রয়েছে। এসব পণ্য বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। অন্যদিকে, গত অর্থবছর থেকে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট উপকূলীয় অঞ্চলের ভেটকি, চিত্রা, দাতিনা ও তপসে মাছের প্রজনন এবং পোনা উৎপাদনের ওপর গবেষণা কার্যক্রম শুরু করেছে।

মৎস্য চাষে বাংলাদেশে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। দেশের ১২ শতাংশ মানুষ মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত থাকলেও এ খাতে আর্থিক প্রণোদনা পান শুধু রফতানিকারকরা। জিডিপিতে মাছের অবদান ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ২৪ দশমিক ৪১ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও মৎস্য খাতকে সেভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। কৃষির অন্যান্য খাতের তুলনায় মৎস্য খাতকে অনেকটা অবহেলার চোখে দেখা হয়। মৎস্যবিশেষজ্ঞরা বলেন, সামগ্রিক মৎস্য খাত কৃষির আওতায় পড়ে। কিন্তু মৎস্যচাষিরা কৃষিঋণের মাত্র ১২ থেকে ১৫ শতাংশ পান। ধান ও অন্যান্য ফসল চাষের জন্য কৃষকরা ডিজের ও বিদ্যুতে ভর্তুকি পান। মাছচাষিরা তা পান না। মৎস্য অধিদফতরের হিসাবে, দেশের চার ধরনের মাছের উৎপাদন খরচ এবং দাম প্রায় সমান। কিন্তু এসব মাছ চাষ করে চাষিরা বর্তমানে উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না। অনেক ক্ষেত্রে লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন। বিশেষ করে থাই কৈ, তেলাপিয়া, রুই ও পাঙ্গাশ মাছ চাষ করে চাষিরা বেশি সংকটের মধ্যে পড়েছেন। ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল, ফুলবাড়িয়া, মুক্তাগাছা, ভালুকাতে সবচেয়ে বেশি পাঙ্গাশের চাষ করা হয়। বর্তমানে ময়মনসিংহের এসব উপজেলায় প্রতি কেজি পাঙ্গাশ মাছ পুকুর থেকে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা কেজিতে পাইকারি দরে বিক্রি করা হচ্ছে। চাষিরা বলেন, এ দামে পাঙ্গাশ বিক্রি করে লাভ তো দূরের কথা, আসল টাকাও তোলা সম্ভব হচ্ছে না। কিছুদিন আগেও ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় মাছ চাষ ছিল ধান চাষের চেয়ে অনেক লাভজনক। পুকুরে পাঙ্গাশ চাষ করে এ উপজেলার কোনাবাড়ি, কাকচর, বইলর, ধানীখোলা, পোড়াবাড়ি, নামাত্রিশাল, উজানপাড়া ও ধলা গ্রামের কত মানুষ যে শূন্য থেকে স্বাবলম্বী হয়েছে। লাখ লাখ টাকা ও পাকাবাড়ির মালিক হয়েছেন যে কতজন, তা বলে শেষ করা যাবে না। এত অল্প সময়ে দারিদ্র্যবিমোচন ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে শত শত গ্রামীণ গরিব মানুষের স্বাবলম্বী হওয়ার উদাহরণ বাংলাদেশে অন্য কোনো খাতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেশের ১৪ লাখ নারীসহ প্রায় দুই কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। মৎস্য খাতে প্রতি বছর অতিরিক্ত ছয় লক্ষাধিক লোকের নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে। ত্রিশাল উজানপাড়া গ্রামের মোফাজ্জল হোসেন চরম দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করতেন। স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করার কোনো সুযোগও ঘটেনি তার ভাগ্যে। সম্পূর্ণ নিজের মেধা, মনন, উদ্যম ও অক্লান্ত পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে মাছ চাষের মাধ্যমে তিনি ১২ একর জমিসহ পাঁচতলা ভবনের মালিক হয়েছেন, যা তিনি স্বপ্নেও কোনো দিন চিন্তা করেননি।

মৎস্যবিজ্ঞানীরা বলেন, দেশের মাছচাষিরা বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত জাতগুলো সঠিকভাবে চাষ করে দেশের মৎস্য খাতকে বিশ্বের দরবারে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু মাছের খাবার, পুকুরে সেচসহ অন্যান্য খাতে জ্বালানির অর্থ জোগাড় করতে তাদের যে পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হচ্ছে, তা আর বেশি দিন বহন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। মাছের খাবারের দাম কমানো, মৎস্যচাষিদের কৃষিঋণ প্রদান ও জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতে না পারলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ খাতে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। এতে বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম যেমন নষ্ট হবে, তেমনি গরিব মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তাও বিঘিœত হতে পারে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের মতে, গত এক বছরে দেশের চাল, ডাল, তেল আটাসহ বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও মাছের দাম তেমন বাড়েনি। তিন বছরের তুলনা করলে দেখা যাবে, অন্য প্রাণিজ আমিষ খাসি, গরুর মাংসের তুলনায় মাছের দাম কিছুটা কমেছে। মাছের দাম কমলেও মাছের খাবার, খামারে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ ও ডিজেলের দাম কমেনি, বরং বেশ বেড়েছে। এ ব্যাপারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের বক্তব্য হলো, দেশের সাধারণ মৎস্যচাষি, বিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণকর্মীদের যৌথ প্রয়াসে মৎস্য চাষে এ সাফল্য এসেছে। মাছের খাবারের দাম কমানোসহ অন্য যেসব সমস্যা রয়েছে, তা দূর করতে সরকারের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন মহাপরিচালকের মতে, দেশের বিলুপ্তপ্রায় ছোট মাছগুলো আবারও সাধারণ মানুষের খাবার টেবিলে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছেন মৎস্যবিজ্ঞানীরা। তাদের উদ্ভাবিত উন্নত পদ্ধতির কারণে আজকে টেংরা, গুলশা, পাবদা, শিং, মাগুর প্রভৃতি মাছের উৎপাদন বহু গুণ বেড়েছে। এসব মাছের কেজি আগে ৮০০ টাকার নিচে পাওয়া যেত না। এখন তা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় নেমে এসেছে। বর্তমানে আরো ১৮টি মাছের আধুনিক চাষ পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে মৎস্যবিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আশা করা যায়, এর ফলে চাষিদের উৎপাদন বাড়বে, খরচ কমবে এবং মাছের দাম না পাওয়ায় দুঃখ কিছুটা হলেও দূর হবে এবং বিশ্বে মাছ উৎপাদনের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে যাবে। দেশের সাধারণ মানুষের প্রাণিজ প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হবে এবং মেধার বিকাশ ও গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্যবিমোচন এবং কর্মসংস্থানের পথ সুগম হবে। সেই সঙ্গে মাছ রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পরিমাণও বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।

লেখক : কৃষিবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist