ইয়াসমীন রীমা

  ৩১ জুলাই, ২০১৮

বিশ্লেষণ

পথশিশুদের ব্যাংকিং হিসাব

তারেক, সাইফুল আর মাইদুল তিন বন্ধু। বয়সের অসমতা থাকলেও একজন আরেকজনকে ছাড়া দিন-রাতের মুহূর্তগুলো যেন বিষণœœময়-নিঃসঙ্গময়-বিরক্তিময়। তারা থাকে কুমিল্লা সদর উপজেলার ঢুলীপাড়ার সেলিম মুহুরীর বস্তিতে। চারদিক বেড়ার ঘেরা টিনশেড ঘর। রান্নার ব্যবস্থা ঘরের বাইরে গণচুলায়। বাথরুমের অবস্থা সেই রকম। তাদের রান্নাটা করা হয় না প্রায়দিন। বাইরে কোথাও অর্থাৎ হোটেল-রেস্তোরাঁয় খেয়ে নেয়। দুপুরে খাওয়া পর্বটা একসঙ্গে হয় না। তারা একই ঠিকানায় ইপিজেডের একটি প্যাকেজিং কোম্পানিতে কাজ করে। ডিউটি তিনজনের তিন সময়। তবে রাতে সবাই মিলিত হয় বস্তি ঘরে। কিংবা কুমিল্লা শহরের নির্জন কোনো জায়গায়। তারেকের বাড়ি নোয়াখালী, সাইফুল গাইবান্দা আর মাইদুল নেত্রকোনার। তারেক সৎমায়ের নিপীড়নে ঘর ছাড়া হয়েছে চার বছর বয়সে। সাইফুলের বাবা রিকশাচালক শহীদুল মিয়ার অকালমৃত্যু হলে অভাব-দারিদ্র্য তাকে বাবার রেখে যাওয়া বন্ধকী ভিটেবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে। সাইফুল মা ও ছোটবোনকে নিয়ে ট্রেনে চেপে আসে কুমিল্লায়। তিন দিন পথে পথে ঘুরে স্টেশনে রাত কাটিয়ে ছোটবোনসহ মাকে হারিয়ে ফেলে। আর মাইদুলকে বয়স্ক সৎভাইয়েরা একদিন রাতের আঁধারে কুমিল্লা শহরের তেলিকোনা এলাকায় ফেলে রেখে যায়। মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে পথে-ফুটপাতে কেটেছে মাইদুলের দীর্ঘসময়। একদিন দেখা হয়ে যায় তারেকের সঙ্গে। পরক্ষণেই সাইফুল। সবার জীবন কাহিনি মিলে যায়। ক্ষুধা-দারিদ্র্য-দুঃখ-অস্থিরতা-বাসস্থানের কষ্ট তারা সমভাবে সহ্য করেছে। পথে পথে কেটেছে তাদের জীবন। একদিন ইপিজেড সড়কে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়া এক গাড়িওয়ালা লোকের গাড়ি ঠেলে দেয় তারা। গাড়ি চালু হলে সেই লোকটি বখশিশ দিতে এসে তাদের নাতিদীর্ঘ জীবন কাহিনিটা জেনে তিনজনকে তার বন্ধুর এই প্যাকেজিং কোম্পানিতে চাকরিতে ঢুকিয়ে দেন। গাড়িওয়ালা সেই লোকটি তাদের প্রিয় রনি ভাই। তাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রা। রনি ভাইয়ের সঙ্গে তাদের আর কোনো দিন দেখা হয়নি ঠিক, তবে মালিকের কাছে খোঁজখবর পায় তিনি এখন আমেরিকায় বসবাস করছেন। প্রথম ছয় মাস তাদের বেতন ছিল দৈনিক ভিত্তিতে অর্থাৎ প্রতিদিন ৭০ টাকা। এখন মাসে পাচ্ছে ৩ হাজার ৫০০ টাকা করে জনপ্রতি। কাজটা হলো, তৈরি বাক্সের আকার ধরে পূর্ণাঙ্গ বাক্সের রূপ দেওয়া। তিনজন মিলে ঘর ভাড়া ও খাওয়া-দাওয়ার অনুষঙ্গিক খরচ করে হাতে মোটামুটি কিছু টাকা থেকে যায়। আগে ভিডিও গেমস, সিনেমা, হোটেলে খেয়ে খরচ করে ফেলত। কিন্তু ইপিজেড এলাকায় শ্রমিক নেতা আসলাম ভাইয়ের বউ ব্যাংকে চাকরি করেন। তারই পরামর্শে বেসরকারি সংস্থা ‘চিলড্রেন সাইড’-এর সার্বিক সহযোগিতায় এখন ব্যাংকে জমা করছে। টাকা জমা করতে পারলে তিনজনের তিনটি স্বপ্ন রয়েছে। মাইদুল অনেক টাকা জমিয়ে মাইক্রোবাস কিনবে, যা ভাড়াভিত্তিক নিজে চালাবে। তারেক একটি দোকান দেবে আর সাইফুল বিদেশ যাবে।

দেশের সুবিধাবঞ্চিত পথ ও কর্মজীবী শিশু-কিশোররা সঞ্চয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষ নাগাদ দেশের ১৮টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে পথশিশুদের অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে ৪ হাজার ৫৪৪টি। এসব হিসাবের বিপরীতে তাদের জমাকৃত টাকার সঞ্চয় ২৭ লাখ ১২ হাজার টাকা। বেসরকারি সংস্থা এনজিওর সহায়তায় এসব অ্যাকাউন্ট খোলা ও পরিচালনা করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৯ মার্চ ১০ টাকার নামমাত্র জামানতে পথশিশুদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ করে দিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নির্দেশনার পর এনজিও প্রতিনিধিদলের সহায়তায় ব্যাংকগুলো পথশিশু ও কর্মজীবী শিশু-কিশোরদের জন্য হিসাব খোলার উদ্যোগ নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ৩১ মে আনুষ্ঠানিকভাবে পথশিশুদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। ওই সময় প্রাথমিকভাবে আটটি এনজিওর সহায়তায় ১০টি ব্যাংকে ৩ শতাধিক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। বর্তমানে আরো চারটি এনজিও ও সাতটি ব্যাংক এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব অ্যাকাউন্ট খোলার উদ্যোগ নেয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিপত্র অনুযায়ী পথশিশু ও কর্মজীবী শিশুদের নামে সঞ্চয়ী ব্যাংক হিসাব খুলতে হবে। তাদের পক্ষে হিসাবটি পরিচালনা করবেন এনজিও প্রতিনিধিরা। তবে হিসাব ফরম ও অর্থ জমার বইয়ে হিসাবধারী শিশু-কিশোরদের অনুস্বাক্ষর থাকতে হবে। আর এ ধরনের হিসাবে কোনো নমিনির দরকার হবে না। জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে দশটি ব্যাংক পথশিশু ও কর্মজীবী-কিশোরদের ব্যাংক হিসাব খোলার দায়িত্ব নেয়। পরে এ শুভ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরো সাতটি ব্যাংক। ব্যাংকগুলো যথাক্রমে সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, দ্য সিটি ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক তথ্যে জানা গেছে, গত বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রূপালী ব্যাংকে মাসাস ও সাফ নামে দুটি এনজিওর সহায়তায় পথশিশু ও কর্মজীবী কিশোররা ১০৫৯টি অ্যাকাউন্ট খুলেছে, যার পুঞ্জীভূত অর্থের পরিমাণ ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা। ৫৪৬টি ব্যাংক হিসাবে খুলে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পূবালী ব্যাংক। ব্র্যাক, অপরাজেয় বাংলাদেশ ও নারীমৈত্রী এই তিন এনজিওর সহায়তায় এসব অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। এই ব্যাংকে পথশিশুদের সঞ্চয় পাঁচ লাখ টাকা। উদ্দীপন নামের একটি এনজিওর সহায়তায় তৃতীয় সর্বোচ্চ ৩১৯টি অ্যাকউন্ট খোলা হয়েছে অগ্রণী ব্যাংকে। এই ব্যাংকটিতে পথশিশুদের সঞ্চয় রয়েছে ৪২ হাজার। এ ছাড়া ট্রাস্ট ব্যাংক ২৮০টি হিসাবের বিপরীতে রয়েছে ৭৯ হাজার ৩০৪ টাকা। মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ২৪৭টির বিপরীতে ৯৯ হাজার ২৯ টাকা। ওয়ান ব্যাংক ২৩১টি হিসাবের বিপরীত ১ লাখ ২৬ হাজার ৫১২ টাকা, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ১৬৩টি অ্যাকাউন্টের বিপরীতে ২৯ হাজার টাকা, দ্য সিটি ব্যাংক ১৫০টি হিসাবের বিপরীতে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা, ব্যাংক এশিয়া ১৯১টি হিসাবের বিপরীতে ১ লাখ ৭৯ হাজার ২৪৫ টাকা, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ৬৯টি হিসাবের বিপরীতে ১ লাখ ১৩ হাজার ৩০৫ টাকা, জনতা ব্যাংকে ১৫০টি হিসাবের বিপরীতে ৭৫ হাজার টাকা ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে ৭৫টি হিসাবের বিপরীতে ৭ হাজার ৫০০ টাকা সঞ্চয় রয়েছে।

ব্যাংকিং সে কেবল বড়দের জন্যই তা নয়। এখন কর্মজীবী দারিদ্র্য শিশু-কিশোর ব্যাংক হিসাব খুলতে পারে। আবার প্রয়োজন পড়লে টাকা ওঠাতে পারে। বিদ্যালয়গামী ছেলেমেয়েদের সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করতে দেশে স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ছাড়াও সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোয় আর্থিক শিক্ষার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। ওইসব দেশে অল্প বয়স থেকেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সঞ্চয়ী অভ্যাস গড়ে তোলা হয়। শৈশব এবং কৈশোরেই প্রতিটি নারী-পুরুষ যেভাবে গড়ে ওঠে যে আদর্শ জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণ করে এবং ধারণ করে সেটাই তার পুরো জীবনের আদর্শ ও জীবনযাপন পদ্ধতি হয় ওঠে। ছেলেমেয়েরা যদি শিশুকাল থেকে বেহিসাবি জীবনযাপনে আকৃষ্ট কিংবা অনুসারী হয়, সঞ্চয়ী মনোভাবাপন্ন না হয়, তাহলে বড় হওয়ার পর তারা জীবনের হিসাব মেলাতে গিয়ে বারবার হোঁচট খায়। দুঃখ, দারিদ্র্য, অভাব, হতাশা তার ভবিষ্যৎ জীবনের সঙ্গী হয়ে যায় নিশ্চিতভাবে। তাই প্রতিটি কর্মজীবী শিশুর-কিশোরদের বাবা-মা কিংবা অভিভাবকরা প্রত্যাশা করেন, তার সন্তানরা যেন মিতব্যয়ী, সঞ্চয়ী এবং হিসাবী স্বভাবে অভ্যস্ত হয়। কারণ, সঞ্চয় বিপদের বন্ধু।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন ডিপার্টমেন্টের মহাব্যবস্থাপক মো. আবুল বশর বলেন, ‘পথশিশু ও কর্মজীবী শিশু-কিশোদের ব্যাংকমুখী করে সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পথশিশুদের ব্যাংকিং কার্যক্রম ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। বিভিন্ন স্থানে যেমন বস্তি, রাস্তাঘাট, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট ও ফুটপাতে বসবাসরত পথশিশু এবং কর্মজীবী শিশু-কিশোরদের ব্যাংকিংসেবায় আনার মাধ্যমে তাদের মধ্যে সঞ্চয়প্রবণতা তৈরি কষ্টোপার্জিত অর্থের সুরক্ষা, পথভ্রষ্ট হওয়ার প্রবণতা হ্রাস করাসহ তাদের বৃহত্তর কল্যাণে ব্যাংক হিসাব খোলার শুভ উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে অধিকাংশ পথশিশু অভিভাবকহীন থাকায় এনজিও প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’

আগে অনেকেই ঘরের খুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত বাঁশের ভেতর টাকা জমাত। কেউ কেউ আবার মাটির ব্যাংকেও টাকা জমিয়েছে। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অনেক অভিভাবক এমন প্রক্রিয়ায় টাকা জমাতেন। সময়ের বিবর্তনে সেই সঞ্চয়ের ধরন বদল হয়েছে। এখন সামান্য কয়েক টাকায় একজন পথশিশু বা কর্মকজীবী কিশোর তার নামে ব্যাংক হিসাব খুলতে পারছেন। ছোটদের সঞ্চয়ে উৎসাহী করে তুলতে নানাভাবে চেষ্টা করা উচিত। অনর্থক অর্থ অপচয় কোনোভাবেই মঙ্গলজনক হতে পারে না। প্রত্যেক বাব-মা তাদের ছেলেমেয়েদের বোঝানো আবশ্যক, ততটাই খরচ করা উচিত যতটা প্রয়োজন। অপার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেকটাই নির্ভর করে আজকের শিশু-কিশোদের ভবিষ্যতর ওপর। একটি কর্মক্ষম জাতি গঠনে প্রথাগত শিশুশ্রমের পাশাপাশি এখন থেকেই শিশুদের মধ্যে ব্যাংকিং জ্ঞান অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা তথা আর্থিক শিক্ষার বীজ বপন করা দরকার।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist