ফনিন্দ্র সরকার

  ২৩ জুলাই, ২০১৮

বিশ্লেষণ

বিদেশি কূটনীতিকনির্ভর রাজনীতি

বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে কালো মেঘের ঘনত্ব ক্রমেই বাড়ছে। সংবিধান অনুসারে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক পরিস্থিতির অস্থিরতা টর্নেডোতে রূপ নিতে পারে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচ-ভাবে শঙ্কা দেখা দিচ্ছে। আজ বলতে হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন পরিস্থিতি দেখার অভিজ্ঞতা নতুন নয়।

অনেক ত্যাগ, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা লাভ করে আমরা বীরের জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করলেও রাজনীতিকদের দৈন্যতায় যে বীরগাথা ইতিহাস, তা মøান হতে চলেছে। দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক দীর্ঘকালীন দ্বন্দ্ব যে কোনো দিনই শেষ হবে না, তা সহজেই অনুমেয়। এর মূল কারুণ, আদর্শিক দ্বন্দ্ব। রাজনীতিতে বহু মত থাকবে, এটাই গণতন্ত্র। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নামক এ দুটি রাজনৈতিক দলের চেতনার ভিন্নতা সুষ্ঠু রাজনীতির অন্তরায়। আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূল চেতনা হিসেবে ধারণকৃত একটি রাজনৈতিক সংগঠন। অন্যদিকে বিএনপির ওই চেতনার বিপরীতে অবস্থান। ধর্মনিরপেক্ষতা অসাম্প্রদায়িক চেতনাবিরোধী রাজনৈতিক দল গঠন করার ফলেই বাংলাদেশের রাজনীতি কলুষিত হয়েছে। তারা গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে যতই চিৎকার করুক না কেন, মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায় না। তারপরও বিএনপি দেশ শাসন করেছে অনেক দিন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তনে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ছিল অনেকটাই নির্বাসিত।

জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রকৃত রাজনীতিকদের হাতছাড়া হয়ে যায় রাজনীতি। অসাধু ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ, আমলা, পাকিস্তানপ্রেমিক চক্রের দখলে যাওয়া রাজনীতিকে সঠিক লাইনে ফিরিয়ে আনতে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকেই আবার আন্দোলনে নামতে হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২১ বছর পর পাকিস্তানপ্রেমিকদের দখলমুক্ত হয় বাংলাদেশ। কিন্তু কলুষমুক্ত হয় না। কলুষিত রাজনীতির ঘোলা জলের পুকুর নিয়ন্ত্রণের সুযোগ লাভ করেন বিদেশি কূটনীতিকরা। প্রসঙ্গত একটি কথা এখানে উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, ক্ষমতাবিলাসী জিয়া ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ সালে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন দল বিএনপি গঠন করেন। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালুর নামে রাষ্ট্রবিরোধীদেরও রাজনীতির সুযোগ তৈরি করে দেন। অতিবাম, অতিডান মধ্যপন্থি সুবিধাবাদীদের তার মন্ত্রিপরিষদে স্থান দেন। প্রতিথযশা খ্যাতিমান অনেক রাজনীতিকও হালুয়ারুটির ভাগ বসাতে জিয়ার গড়া দলে যোগ দেন। এতে তাদের অতীত নৈতিকতা যে প্রশ্নবিদ্ধ হবে, সেদিকে তাকাতেও প্রয়োজন বোধ করেন না। এরা নিজেদের অস্তিত্ব এবং রাজনীতিতে নতুন ধারা সৃষ্টির প্রয়াসে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে বিদেশি কূটনৈতিকদের দ্বারস্ত হন।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এই গোষ্ঠী নতজানু নীতিকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে তাদের যে লাভ হয়, সেটি হচ্ছে বিদেশের সঙ্গে সম্পর্কের সামর্থ্য অর্জন, এমনকি ভারতও জিয়ার সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল নেতার মৃত্যুকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে ধরে নিয়ে একটা অনৈতিক সরকারকেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তখন যদি ভারতের স্বীকৃতি না থাকত, তবে ইতিহাস অন্যরকম হতো। এই পরিস্থিতির আলোকরশ্মিতে বিদেশিরা নিজেদের তাপ দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সমর্থ হন, যা থেকে এখনো রাজনীতিবিদরা বেরিয়ে আসতে পারেননি। আর পারেননি বলেই বাংলাদেশের রাজনীতি হয়ে উঠেছে বিদেশি কূটনীতিনির্ভর। এই নির্ভরতাই রাজনীতিকদের দৈন্যতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।

বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের রাজনৈতিক সৃষ্টকৃত অস্থির পরিবেশটা বিদেশি কূটনীতিকদের উপভোগের অনুষজ্ঞে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে যারা রাজনীতির নেতৃত্ব দেন, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে কূটনৈতিক মিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে খাতির প্রণয়ন করতে ছুটে যান। বঙ্গবন্ধুর শাসনকালের পর থেকেই রাজনীতিতে বিদেশি কূটনৈতিক আধিপত্য শুরু। কী দুর্ভাগ্য আমাদের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো বিশ্বমাপের রাজনৈতিক নেতার নেতৃত্বে যে দেশটি স্বাধীন হয়, সেই দেশে আজকের রাজনীতিবিদদের অবস্থা কী? অভ্যন্তরীন কোনো বিষয় নিজেদের মধ্যে সমাধানযোগ্য হলেও ধরনা দেওয়া হয় বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে। বাংলাদেশে কীভাবে নির্বাচন হবে, দেশ পরিচালিত হবে, তার মতামত দেবে এ দেশের জনগণ অথচ ছুটে যেতে হয় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের কাছে। আমাদের দেশে কোন্্ দল ক্ষমতায় আসবে, তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব জনগণের। কিন্তু রাজনীতিবিদরা নিজ অবস্থান ধরে রাখতে বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছেন। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে অবস্থাটা দেশে একটা ভয়ানক শঙ্কা বিরাজ করছে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাকে কেন্দ্র করে দলটির মধ্যে ব্যাপক জিঘাংসা মনোভাব দেখা যাচ্ছে। খালেদা জিয়াকে প্রায় প্রতিদিনই আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে। এই হাজিরাদানের সময় বিএনপি নেতাকর্মীরা শোডাউনে মহড়া দিয়ে তাদের শক্তি-সামর্থ্যরে জানান দিচ্ছে পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর ও তাদের মারধর করে, যা ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে দেখার সুযোগ হয়েছে দেশবাসীর। গত ৩০ জানুয়ারি ৩০টি দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে নানা কথা তুলে ধরেন, এটা তাদের কাছে বিচার চাওয়ার নামান্তর। বিএনপির মনোভাবে বোঝা যাচ্ছে, বিদেশিদের কাছে ন্যায্য বিচার পাওয়ার আশ্বাস তারা পেয়েছেন।

সত্য বলার অধিকার পৃথিবীর সবারই রয়েছে। এদিকে আর একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, আমাদের রাজনীতিকদের মধ্যে একটা ফোবিয়া কাজ করে, তা হচ্ছে প্রভাবশালী দেশের কূটনৈতিক মিশনের কর্মচারী-কর্মকর্তার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা। এটা করতে পারলে নিজ দেশে রাজনৈতিক অবস্থান পাকাপোক্ত হবে। ক্ষমতাসীন কোনো কোনো নেতা মনে করেন, ভারতীয় কূটনীতিকদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি করতে পারলে হয়তো মন্ত্রীর চেয়ারও পাওয়া যেতে পারে। বিরোধী নেতারাও মনে করেন, ভারতীয় কূটনৈতিকদের সঙ্গে গভীর ভাব করতে পারলে কৌশলে তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দিতে পারবেন। অথচ ক্ষমতার মালিক হচ্ছে জনগণÑএ কথাটি তারা ভুলে যান। একটি কথা আমরা কেন ভুলে যাচ্ছি, অসাধারণ উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির বস্তুগত উদ্দেশ্য বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। সে পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে তুলেছেন আমাদের রাজনীতিবিদরা। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, তারা বৈদেশিক বিনিয়োগের বিষয়ে বেশি মাথা ঘামান। যে সরকার যত বেশি বৈদেশিক বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে পারে, কিংবা উৎসাহিত করতে পারে, সে তত বেশি কৃতিত্বের দাবি করে। কিন্তু বৈদেশিক বিনিয়োগ দেশের সত্যিকারের উন্নয়ন হয় না, সেটা কেউ বুঝতে চায় না। বৈদেশিক বিনিয়োগ মানেই সাম্রাজ্যবাদ জেঁকে বসা। অতীতের ইতিহাসে সেটা প্রমাণিত সত্য। ব্রিটিশরা একসময় এ উপমহাদেশে বিনিয়োগ করে ব্যবসা করতে এসে শাসক হয়ে গিয়েছিল। ২০০ বছরেরও বেশি তারা এ উপমাহাদেশকে শাসন-শোষণ করেছে। বিদেশি বিনিয়োগ ও সাহায্য ছাড়াও যে দেশে দৃশ্যমান উন্নয়ন করা যায়, তা শেখ হাসিনা নগদ দেখিয়ে দিলেন। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ছাড়াই পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প হাতে নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে প্রকল্পের কাজ শেষ হতে চলেছে। কাজেই নেতৃত্বে¡র মধ্যে যদি দৃঢ়তা, নৈতিকতা এবং সাহস থাকে, তবে তা করা যায়।

দেশের মানুষের চাহিদার অন্ত নেই; মানুষ কেবলই চায়। যার আছে সেও চায়, যার নেই সেও। এটা মানবজাতির সহজাত প্রবৃত্তি। পৃথিবীর সব মানুষের ক্ষেত্রেই এটা সত্য। তবে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে নিছক চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপারটি বেশি গুরুত্ব লাভ করায় পুরো রাজনীতিই বিপাকে পড়ে গেছে। কতিপয় সৎ আদর্শবান রাজনীতিকরা অনেকটাই অসহায়। বেশির ভাগ রাজনীতিক, আমলা বিলাসবহুল জীবনের লক্ষ্যে বৈষয়িক ও অর্থনৈতিক ভাবনার দিকে এগিয়ে চলছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অস্থির হয়ে উঠছে রাজনীতির মাঠ, ঘাট ও আকাশ। রাজনৈতিক জীবনের শ্রেষ্ঠত্ব¡ অর্জনে দৌড়াদৌড়ি করা হচ্ছে বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে। এতে যে গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে কারো খেয়াল নেই। ক্ষমতা যেমন চিরস্থায়ী নয়, তেমনি ভোগ্য কোন বস্তু কিংবা সম্পদও চিরস্থায়ী নয়। ভোগ্যবস্তু ও সম্পদ দেহ পুষ্টির জন্য সৃষ্টি হয়েছে। ভোগ্যবস্তু ও সম্পদ অর্জনে একটা পরিমিতবোধ থাকতে হবে। এই পরিমিতবোধে রাজনীতিরও পুষ্টি হয়, যে রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে, সেটা একটি রসালো ফল। এ ফল থেকে কত তাড়াতাড়ি সবটুকু রস বের করে কে কার আগে আকণ্ঠ পান করবেন, রাজনীতিবিদদের মধ্যে চলছে সেই প্রতিযোগিতা। রস পানের কৌশল জানতেই ছোটাছুটি বিদেশি কূটনীতবিদদের কাছে। এটা দেশপ্রেম নয়। এটা রাজনীতির দীনতা। রাজনীতির এই দীনতা ঘোচাতে হবে। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই এই দীনতা ঘোচাতে নেতৃত্ব দিতে হবে। তিনিই পারবেন বলে দেশবাসী বিশ্বাস করে।

লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist