রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৯ জুলাই, ২০১৮

সিলেট

সম্ভাবনার হাতছানি

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, উৎসব-আনন্দ, অকৃত্রিম জীবনাচার বৃহত্তর সিলেটকে করেছে সমৃদ্ধ। এ ছাড়া এ জনপদের মানুষ বিশ্বের আধুনিক বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে উন্নত জীবনমানের সঙ্গেও পরিচিত ও অভিজ্ঞ। মানুষ আর প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে অর্থনীতির বিপ্লব ঘটতে পারত সিলেটসহ সারা দেশে। প্রয়োজন একটি মহাপরিকল্পনা। সরকারের আন্তরিক উদ্যোগেই পারে পর্যটন শিল্পের কাক্সিক্ষত বিকাশ ও প্রকাশ ঘটানো। কিন্তু সে রকম কোনো উদ্যোগ এখন নেওয়া হয়নি বা হচ্ছেও না। দিন দিন দেশ বিমুখ হচ্ছেন প্রবাসীরা। একই সঙ্গে প্রকৃতি দানবীয় তা-বে বিগড়ে যাচ্ছে। তাই এখনই সময় প্রাকৃতিক উৎসকে সম্পদে পরিণত করার কার্যকর উদ্যোগ। এর মধ্য দিয়ে দেশের অর্থনীতির অনিবার্য অনন্য এক শক্তি হতে পারত সিলেটের পর্যটন সম্পদের বিপুলতা। কারণ সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বিভিন্ন সময়ে আগত পরিব্রাজকরা এর প্রশংসায় হয়েছেন পঞ্চমুখ। বাংলাদেশের সর্বত্র এখন উন্নয়নের হাওয়া বইছে। কিন্তু সে অনুপাতে উন্নয়নের ধারা কিছুটা কম দেখা যাচ্ছে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, মাধ্যমিক শিক্ষা রয়েছে দেশের মোট ২২ শতাংশ মানুষের। অথচ সিলেট বিভাগে এ হার মাত্র ১৯ শতাংশ। মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষায় সবচেয়ে এগিয়ে খুলনা। সিলেট আমার শহর, প্রাণের শহর। কিন্তু এত ভালোলাগার পুণ্যভূমির যেভাবে উন্নতি হওয়া দরকার, তা হয়নি। এ অঞ্চলের তরুণরা একটু বয়স হলেই পড়ালেখা শেষ না করেই তারা বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছে। ফলে মাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষা স্তরে এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম। এদিকে সিলেটের ছেলেমেয়েদের একমাত্র আগ্রহ, তারা বিদেশে যাবে। বিদেশে গিয়ে কিন্তু ছোট কাজই করতে হচ্ছে, অথচ দেশে শিক্ষা অর্জনে তাদের অনীহা। এ জন্য অনেকের আয় বা আর্থিক সংগতি ভালো হলেও শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ছে অঞ্চলটি। বিবিএস বলছে, এ বিভাগের মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে। চারটি জেলা নিয়ে গঠিত সিলেট বিভাগের জনসংখ্যা ৯৮ লাখের বেশি। বর্তমানে এ জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ হচ্ছে ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, চাঁদপুর, বরিশাল, রংপুর ইত্যাদি জেলার অধিবাসী, যারা সিলেটে স্থায়ীভাবে বসবাস করে নানা রকম পেশায় নিয়োজিত থেকে সিলেটের উন্নয়নে সাহায্য করছেন। এ জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ কখনোই বিদ্যালয়মুখী হয়নি। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রেও অন্যতম শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে সিলেট। এখানে বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চল রয়েছে, যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার অন্তরায়। উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে দায়ী করা যায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতাকে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে সিলেট বিভাগে কলেজ রয়েছে মাত্র ১৫৭টি। এদের অনেকগুলোতেই যথোপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ নেই, নেই দক্ষ ও প্রয়োজনীয় শিক্ষকও। যেখানে ঢাকা বিভাগে সরকারি-বেসরকারি কলেজের সংখ্যা ৮৭৩।

সিলেট অঞ্চলের একটি বড় অংশ লোকের অভাব-অনটন ও পুষ্টিহীনতা চোখে পড়ার মতো। বস্তুত অর্থনৈতিকভাবে যে সিলেটের সবাই স্বাবলম্বী, ব্যাপারটা তেমন নয়। মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার, স্বাস্থ্যসামাজিক নিরাপত্তা সূচকের নানা ক্ষেত্রেও সিলেট পিছিয়ে রয়েছে। অথচ গ্যাস, চা বাগানের মতো প্রাকৃতিক সম্পদের কমতি নেই সিলেটে। প্রবাসী-অধ্যুষিত হওয়ায় এখানে অর্থের সরবরাহটাও ভালো। আবার এ অঞ্চলের পাশেই ভারতের সাতরাজ্য। বিশাল এই বাজারে পণ্য রফতানির সুযোগ আছে। সব মিলিয়ে সিলেটে বিনিয়োগের অনেক সম্ভাবনা থাকলেও কাজে লাগানো যায়নি। পাহাড়-টিলা, বন-জলপ্রপাত, হাওর-বাঁওড় মিলিয়ে যে অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশ সেখানে আছে, তা শুধু নান্দনিক বিচারেই নয়, অর্থনৈতিক বিবেচনায়ও মূল্যবান। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা যথেষ্ট মাত্রায় কাজে লাগানো হয়নি। অবকাঠামো খুব দুর্বল এ অঞ্চলে, এখানে পর্যটনের বিস্তর সুযোগ রয়েছে। বিছানাকান্দি, অপূর্ব এক পর্যটন ভূমি। অথচ গেলে দেখা যাবে টয়লেট নেই, খাবারের ভালো ব্যবস্থা নেই। পর্যটন এলাকাগুলোর সড়কের অবস্থা নাজুক। তা ছাড়া পর্যটকদের হয়রানি করা হয় বলেও খবর রয়েছে গণমাধ্যমে। সিলেট অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বেশ সুবিধাজনক। শাহজালাল (রহ.) ও শাহপরানের (রহ.) দরগায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন আসে। অথচ এখানে ভালো টয়লেটের বন্দোবস্ত নেই, গোসলের স্থান নেই। এখানে এবাদতখানা প্রশস্ত করারও বিষয় রয়েছে। অবশ্য সম্প্রতি দুই কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। শাহপরানের মাজারের ওখানে খাবারের স্থান নেই, গাড়ি পার্কিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই, নেই টয়লেটেরও ব্যবস্থা। সুখের বিষয়, সম্প্রতি ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের সহযোগিতায় এসব সমস্যা দূর করার জন্য একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তা ছাড়া সিলেট অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নে নজর দেওয়া কেবল প্রয়োজনীয়ই নয়, অপরিহার্যও বটে। উল্লেখ্য, সিলেট অঞ্চল থেকে প্রতিদিন প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার পাথরভর্তি ট্রাক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাথর সরবরাহ করে থাকে এবং স্থানীয় লোকরা এই অধিকসংখ্যক ট্রাকের যাতায়াতের কারণে অনেকটাই জিম্মি জীবনযাপন করে। তা ছাড়া যোগাযোগের অভাবের কারণে সরকারের প্রস্তাবিত মৌলভীবাজারের অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজে খুব একটা গতি পাচ্ছে না। সিলেটের অনেক প্রবাসীই দেশে শিল্প-কারখানা গড়তে আগ্রহী। প্রতিদিনই আমার সঙ্গে তাদের কেউ না কেউ যোগাযোগ করেন। তারা সিলেট অঞ্চলে বিনিয়োগ করতে চান। কেউ কলকারখানা স্থাপন করতে চান, কেউ চান চা-শিল্পের উন্নয়নে কাজ করতে। তরুণদের জন্য কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণমূলক কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ রয়েছে অনেকের, কেউবা হোটেল-মোটেল স্থাপন করে পর্যটনের উন্নয়নে আগ্রহী। লন্ডনপ্রবাসী ফখরুল ইসলাম চৌধুরী বড় আকারের একটা বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করতে কাজ করছেন। কাজও এগিয়েছে অনেক দূর। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি এখনো অনুমোদন পাননি। তিনি অনুমোদন পেলে আশা করা যায়, তার উদ্যোগের ফলে এ অঞ্চলে প্রায় দুই লাখেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। সিলেট থেকেই বেশি গ্যাস উত্তোলন করা হয়। অথচ এ অঞ্চলের মানুষ গ্যাস পায় না, সব গ্যাস চলে যায় জাতীয় গ্রিডে। এখানে কল-কারখানা গ্যাসের অভাবে মুখ থুবড়ে আছে। লোকজন বাড়ি করছে, সেখানেও নেই গ্যাস। ভালো হোটেল রয়েছে, গ্যাস নেই। শুনেছি মৌলভীবাজারেও প্রাকৃতিক গ্যাসের বড় উৎস রয়েছে, তবে তা উত্তোলনের কোনো উদ্যোগ নেই। কলকারখানা স্থাপনে সম্ভাবনার দিক থেকে সিলেট এগিয়ে আছে।

একসময় সিলেট থেকে গোয়ালন্দ বা ভৈরবের সঙ্গে মূল যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল নৌকায়। নদীর নাব্যতা আজ আর আগের মতো নেই, সেটিরও উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সম্প্রতি সিলেটের সুরমা নদীর কিছু অংশে নাব্যতা বাড়ানোর লক্ষ্যে স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী উদ্যোগ নেন এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় তাদের উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। কিন্তু স্থানীয় জেলা প্রশাসক সেই উদ্যোগটি আটকে রেখেছেন। সারা বাংলাদেশে শুধু সিলেটেই যে রিভার ক্রুজ সুবিধা রয়েছে; ঠিকমতো তা চলছে না। মুক্ত অর্থনীতিতে সবাইকে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়। এর পূর্বশর্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। এখানে আন্তনগর ভালো বাস সার্ভিস নেই। আম্বরখানা এলাকায় আমরা একটি উড়াল সড়কের কথা চিন্তা করেছি, এই উড়াল সড়ক তিন দিকে যাবে; একটি সুনামগঞ্জ সড়কের দিকে, একটি সিলেটের ঈদগাহের দিকে, আরেকটি শাহজালালের মাজারের দিকে। তাহলে যাতায়াত অনেক সহজ হবে, যানজটও কমবে। খালগুলো বেদখল হয়ে আছে। এতে এখন সিলেটে সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি উঠে যায়। সিলেট হলো দিঘির শহর, এখন এই দিঘিগুলো ভরে বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। এগুলো মুক্ত করতে পারলে জলাবদ্ধতার সমস্যা কেটে যাবে।

সিলেটে রয়েছে অর্থনৈতিক সম্পদ, এখানে কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। কাজগুলোকে এগিয়ে নিতে উপযুক্ত নেতৃত্ব যেমন প্রয়োজন, প্রয়োজন স্থানীয় জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা। আমি মনে করি, একটু সুযোগ পেলে এ কাজগুলোকে আমরা এগিয়ে নিতে পারব। প্রধানমন্ত্রী চান কাজ হোক, উন্নয়ন হোক। দেশের একটি নামিদামি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি উদ্যোগে ‘আগামীর সিলেট’ একটি রূপরেখা তৈরি করেছে, যা সিলেটের অতীত ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে, নদী-জলাশয়-টিলার নৈর্ব্যত্তিক সমন্বয় করার চেষ্টা করেছে। বস্তুত ‘আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অনেক সময় কাজের গতি ধীর হয়ে যায়। অবকাঠামো উন্নয়ন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন, ঘুষ-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, হয়রানি থেকে বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দান-এ ধরনের অনেক পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হবে। বিনিয়োগের সামগ্রিক পরিবেশ উন্নত করার মধ্য দিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে সিলেটের ভূমিকা প্রভূত মাত্রায় বাড়ানো সম্ভব। আবার আমাদের ছেলেমেয়েদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে আরো পদক্ষেপ প্রয়োজন। এখানে কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। কাজগুলোকে এগিয়ে নিতে উপযুক্ত নেতৃত্ব যেমন প্রয়োজন, প্রয়োজন স্থানীয় জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা। একটু সুযোগ পেলে এ কাজগুলোকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।

লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist