মোস্তফা কামাল গাজী

  ১৮ জুলাই, ২০১৮

পর্যালোচনা

আমাদের সোনালি আঁশ

বর্ষা আসার সঙ্গে সঙ্গে অনেক এলাকায় শুরু হয়েছে পাট চাষ। সোনালি আঁশ নামে পরিচিত পাট একসময় বাংলাদেশে ব্যাপক চাষ হলেও, অনেকটাই কমে গেছে এখন। আগের মতো এখন আর নদীর পাড়ে, বিলের ধারে পাটখেত চোখে পড়ে না। দিন দিন পঙ্গু হয়ে পড়েছে পাটশিল্প। মাত্র কয়েক দশক আগেও পাটই ছিল আমাদের প্রধান রফতানিপণ্য। তখন বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের একমাত্র হাতিয়ারও ছিল এটি। তবে যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাব, জুটমিল মালিকদের অজ্ঞতা এবং সরকারের উদাসীনতায় পাটশিল্পে আমরা আমাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারিনি। বর্তমানে এ শিল্প অন্যান্য পাট উৎপাদনকারী দেশগুলোর সঙ্গে ব্যাপক প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছে। ফলে, এ শিল্পে আগের মতো আধিপত্য আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারছি না। ২০০২ সালে নারায়ণগঞ্জের আদমজী জুট মিল বন্ধ হয়ে যাওয়া ছিল বাংলাদেশের পাটশিল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে দুঃখজনক দিন। কেবল আদমজী নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আরো কিছু জুট মিল বন্ধ হতে দেখা গেছে। ফলে একসময়ের সম্ভাবনাময় পাটশিল্প এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে উপনীত হয়েছে। বাংলাদেশের পাটকলগুলোয় এখন যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলো অনেক পুরনো এবং সেকেলে। এসব যন্ত্রপাতি মানসম্মত পাটপণ্য তৈরির সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। পাটশিল্পের আরেকটি বড় সমস্যা হলো, বরাবরই খাতটি ছিল অবহেলিত। তাই বিষয়টিতে সরকার দূরদর্শী কোনো পদক্ষেপ নিলে এ শিল্পকে আমূল পাল্টে দেওয়া যেত। এ শিল্পে আরেকটি বড় সমস্যা দেখা যায় বিপণন নিয়ে। বিপণনের ক্ষেত্রে আমরা কোনোভাবেই প্রথাগত পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। পাটশিল্পের বিপণনে কীভাবে বৈচিত্র্য আনা যায়, কীভাবে একে পরিবেশসম্মত করে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করা যায়, তা নিয়েও ভাবতে হবে।

বিগত দিনগুলোয় দেখা গেছে, কৃষক পাট ঘরে তুলতেই কমে যায় দাম। আনেক সময় উৎপাদনের খরচ ওঠাতেই তাদের নাভিশ্বাস ওঠে। এতে ব্যাপক হতাশায় ভোগেন তারা। ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়েন লাখ লাখ কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, পাটজাত পণ্য উৎপাদনকারী ও রফতানিকারকরা। বীজের সংকট, সারের সংকট, পাট ভেজানোর জন্য পানির সংকট, সর্বোপরি বাজারে গেলে উৎপাদন অনুযায়ী দাম না পাওয়াÑএকটা সংকটময় পরিস্থিতিতে ফেলে দিচ্ছে পাটশিল্পকে। এখন পর্যন্ত পাটতন্তু সবচেয়ে সুলভ বলে বিবেচিত। বাংলাদেশে পাট রফতানি পণ্যের তালিকায় রয়েছে কাঁচাপাট, পাটের সুতা ও কু-লী। পাটজাত পণ্যের মধ্যে রয়েছে হ্যান্ডব্যাগ, লাঞ্চপট, ট্রাভেল ব্যাগ, লেডিস ব্যাগ, পাপোস, টেবিল ম্যাট, পেনসিল বক্স, জুতা, দোলনা, পুতুল, সিক্কা, চাবির রিং, চুড়ি, বেল্ট, কাপড়, পুতুল, বিভিন্ন খেলনাসহ শতাধিক পণ্য। ইপিবির দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কাঁচাপাট রফতানি হয় ১৬ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। পাটের সুতা ও কু-লী রফতানি হয় ৬০ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। পাটের বস্তা ও ব্যাগ রফতানি হয় ১২ কোটি ৭৫ লাখ ডলার। এ ছাড়া অন্যান্য পাটজাত পণ্য রফতানি হয় ৫ কোটি ৯১ লাখ ডলার। বিশ্বব্যাংকের ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বৈশ্বিক জুট মার্কেটে কাঁচা পাটের ৮৪ শতাংশ এবং ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের ৫৫ শতাংশ পাটের জোগান দিতে পারে। কিন্তু দেশের অনেক পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বৃহৎ পরিসরে পাটের বিকাশ ও প্রসার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষস্থানীয় হওয়ায় আমরা বিশ্বব্যাপী পাটপণ্যের বহুমাত্রিক ব্যবহারের বিষয়টি তুলে ধরতে পারি। পাটতন্তু দ্বারা আকর্ষণীয় শপিং ব্যাগ তৈরি করে খুব সহজেই পাশ্চাত্যের দেশে সুলভমূল্যে রফতানি করা যায়। গবেষণা সংস্থাগুলোকে পাটপণ্য ব্যবহারে বৈচিত্র্য আনতে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে। কীভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পাট চাষ করা যায় এবং পাটকাঠি, পাটতন্তু, পাট, পাটপণ্যের বিপণন করা যায়, তা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চালাতে হবে। শ্রমিকদের দক্ষ করে তুলতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন কারখানায় শত বছরের পুরনো মেশিন অপসারণ করে নতুন মেশিন আনতে এখনই উদ্যোগী হতে হবে। পাটতন্তুর ব্যবহারেও ব্যাপক বৈচিত্র্য আনতে হবে। এগ্রো টেক্সটাইল, জিও টেক্সটাইল, টেকনিক্যাল টেক্সটাইল ও হোম টেক্সটাইলে পাটতন্তুর ব্যবহার বাড়াতে হবে। আমাদের দেশে পাটশিল্পে এখনো এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজমান। বিশেষত, এ খাতে শ্রমিক অসন্তোষের বিষয়টিতে সরকারকে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হবে। সরকার, মিলমালিক ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে এ খাতের সব অস্থিরতা দূর করতে হবে।

বর্তমান সরকার পাট উৎপাদনে যথাযথ অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। পাটের সুদিন ফিরিয়ে আনতে চালিয়ে যাচ্ছেন নানামুখী প্রচেষ্টা। ২০১৩ পর্যন্ত সময়ে পাঁচটি বন্ধ পাটকল চালু হয়েছে। দেশের ভেতরে পাটজাত পণ্যের বাজার যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে এর রফতানিও। একই সঙ্গে বর্তমান সরকার ছয় মার্চকে ‘জাতীয় পাট দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। সরকারের এসব সময়োচিত পদক্ষেপের ফলে কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, রফতানিকারক, ভোক্তাসহ প্রায় চার কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের বিপুল সম্ভাবনায় পাট খাতের জীবন ফিরে এসেছে। ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনি সংরক্ষণ এবং পরিবহনে বাধ্যতামূলকভাবে পাটের ব্যাগ ব্যবহারের নির্দেশ দিয়ে ২০১৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর আদেশ জারি করে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন পণ্যে পাটের মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্যবহার করা না হলে এক বছরের কারাদ- বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ের বিধান রয়েছে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে সাজা হবে দ্বিগুণ। আইন হলেও অনেক সময় দেখা যায়, আইন আইনের স্থানেই রয়ে যায়। বাস্তবে এ আদেশ-নির্দেশ তেমন কার্যকর নয়। পলিব্যাগের চেয়ে পাটের ব্যাগের দাম বেশি থাকায় তা ব্যবহারে আগ্রহ কম। ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৯(ক) ধারা অনুযায়ী, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পলিথিন উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাত, বিক্রি, মজুদ এবং ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। কেননা পলিব্যাগ পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। অথচ আমরা এখন সর্বত্রই পলিব্যাগের ব্যবহার দেখছি। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায়ই এমনটি ঘটছে। পলিব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাতের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এতে একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণের হাত থেকে রক্ষা পাবে, তেমনি পাটের ব্যাগের ব্যবহারও বেড়ে যাবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অন্তত ২০টি দেশে পলিথিন নিষিদ্ধ। ফলে বিশ্বব্যাপী পাটের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। এই সুযোগটি বাংলাদেশ ইচ্ছে করলে ভালোভাবেই কাজে লাগাতে পারে। এদিকে সরকারিভাবে পাটপণ্য ব্যবহারে বাধ্যতামূলক করা হলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এতে দেশীয় বাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে না। এতে করে আরো বেশি হতাশ হচ্ছেন কৃষকরা। বাংলাদেশ প্রধানত চীন, ভারত, পাকিস্তান, মিসর, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, ভিয়েতনাম, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, বেলজিয়াম, তিউনিসিয়া, ইরান, এলসালভাদর, স্পেন, ফ্রান্স, ব্রিটেন, আইভরিকোস্ট, ব্রাজিল, জিবুতি, ইতালি ও তাইওয়ানে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে থাকে। দেশে গড়ে প্রতি বছর পাট উৎপাদন হয় ৬৫ থেকে ৭০ লাখ বেল। আর দেশের ভেতরে মোট ৩০ থেকে ৩৫ লাখ বেল পাটের চাহিদা রয়েছে, যা মোট উৎপাদনের অর্ধেক। বাকি পাট বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়। সম্প্রতি শেষ হওয়া অর্থবছরে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারলেও আগের বছরের তুলনায় রফতানি বেড়েছে ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ। সরকার আরো উদ্যোগী হলে আশাজাগানিয়া হারে পাটের রফতানি বৃদ্ধি পাবে।

এ কথা অনস্বীকার্য, পাটশিল্পের ভবিষ্যৎ এখনো উজ্জ্বল। পাটতন্তু সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় যেকোনো কৃত্রিম তন্তুর তুলনায় বিশ্বে এর এখনো বেশ সমাদর রয়েছে। এ ছাড়া পাটশিল্প অত্যন্ত শ্রমঘন শিল্প হওয়ায় বাংলাদেশ এ থেকে বাড়তি সুবিধা পেতে পারে। পাট উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে শ্রমিকের মূল্য কম এবং আবহাওয়া ও মাটি পাট চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী হওয়ায় খুব সহজেই এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে। এতে দেশে বেকারত্বের হার যেমন কমবে, তেমনি আমরা ফিরে পাব হারানো গৌরব।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist