মীর আবদুল আলীম
বিশ্লেষণ
জলবায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশ
জলবায়ু পরিবর্তনে পরিবেশ ভারসাম্য হারাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা বলছে, আগামীতে এ ধরনের দুর্যোগ আরো শক্তি নিয়ে আসবে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার প্রয়াস দ্রুততার সঙ্গে জোরদার করার বিকল্প থাকা সংগত নয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। দিন দিন যেভাবে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, তাতে আমরা সত্যিই শঙ্কিত ও হুমকির সম্মুখীন। ২০৮০ সাল নাগাদ সমুদ্রতল ৯ থেকে ৪৮ সেন্টিমিটার এবং কার্বন নির্গমনের উচ্চহারে যে বৈশ্বিক উষ্ণতা হচ্ছে, তার ফলে সমুদ্রতল ১৬ থেকে ৬৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়বে। ২০৮০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ভূমির এক-তৃতীয়াংশ পানিতে নিমজ্জিত হবে। এর ফলে সমুদ্রের কাছাকাছি অঞ্চলগুলোর মানুষ বাস্তুভিটা হারাবে। নদ-নদীতে লোনাপানির পরিমাণ বেড়ে যাবে, বাড়বে শরণার্থীর সংখ্যা। ২০ থেকে ৩০ শতাংশ প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে পড়বে এবং দেশে বিশুদ্ধ পানির সংকট বেড়ে যাবে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়বে, হেপাটাইটিস বি, সংক্রামক ব্যাধি, মেনিনজাইটির মতো গ্রীষ্মকালীন রোগগুলো বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে সূর্যের বিকিরণকৃত আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মিও অনুপ্রবেশ বৃদ্ধির কারণে চামড়ার ক্যানসার ও চোখের ছানি পড়া রোগ বৃদ্ধি পাবে। এমনকি খাদ্যশস্যে তেজস্ক্রিয়তা বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে খাদ্যাভাব দেখা দেবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার কৃষি ও দেশীয় শিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এক দেশে বন্যা হলে তার প্রভাব গিয়ে পড়ছে অন্য দেশে। তবে ক্ষরার ক্ষেত্রে দেখা যায় উল্টোচিত্র। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আঞ্চলিক সমন্বিত উদ্যোগ আরো বাড়ানো দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের অ্যাকশন প্ল্যান দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ ঝুঁকির মধ্যে থাকা বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জেলাগুলোর ১৩ কোটি ৩৪ লাখ মানুষের মাথাপিছু জিডিপি ১৪.৪ শতাংশ হ্রাস পাবে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি মনে করছে, এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৭১ বিলিয়ন ডলার। তথ্য অনুযায়ী, ঝুঁকির শীর্ষে থাকা ১০ জেলা হলো কক্সবাজার, বান্দরবান, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, নোয়াখালী, ফেনী, খাগড়াছড়ি, বরগুনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা। এর মধ্যে বেশি ঝুঁকির মুখে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের মানুষ।
পরিবেশ নিয়ে ভাবনাটা আমাদের দেশে হয় না বললেই চলে। অন্য দেশের কার্বনের ভারে আমরা নতজানু। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ। এখানে কার্বন নিঃসরণের যে মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে কম পরিমাণে কার্বন নির্গত হয়। আবার আমাদের দেশে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। সুন্দর বনের গাছ, লতাগুল্ম, বনের মাটির প্রকৃতি, গাছপালার পরিমাণ প্রভৃতি হিসাব করে দেখা যায়, এই বনের কার্বন শোষণের ক্ষমতা রয়েছে অত্যধিক। এরপরও আমরা উন্নত বিশ্বের নির্গত কার্বনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। কার্বনের প্রভাবে বিশ্ব উষ্ণায়ন বৃদ্ধির কারণে ভূপৃষ্ঠের বরফ গলে আশঙ্কাজনক হারে সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব থেকে রক্ষা পাবে না যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলোও। যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে মিয়ামি বিচ, লুইজিয়ানা ও টেক্সাস উপকূল। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আর মাত্র ১০ মিটার বাড়লেই যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির উপকূলীয় অঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রায় ৬৮ হাজার মানুষ। অর্থের হিসাবে ক্ষয়ক্ষতি হবে প্রায় ২০০ কোটি ডলার। তবে মূল ক্ষতিটা হবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মতে, কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ২০১৪ সালে বায়ুম-লে ক্ষতিকর গ্যাসের উপস্থিতি রের্কডমাত্রায় পৌঁছেছে। সংস্থাটির মতে, কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের মতো ক্ষতিকর দীর্ঘস্থায়ী গ্যাসগুলোর কারণে ১৯৯০ থেকে ২০১৪ সালে আবহাওয়ায় উষ্ণায়নের হার ৩৪ শতাংশ পরিমাণে বেড়েছে। আগামী দশকে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে। তাপমাত্রা বাড়ার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে।
বন্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে হিমালয়ের বরফগলা পানিসহ উজানের নেপাল ও ভারতের বৃষ্টিপাতের পানি, বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদী হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। এভাবে দেখা যায়, প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১০৯৪ মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং ১৫ লাখ হেক্টর চাষের জমি বন্যা ও জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন এ দেশের কৃষি খাতে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। মৌসুমি বৃষ্টিপাত এবং নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার কারণে এ দেশের প্রধান অর্থকারী ফসল হলো ধান। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাবে দিনে দিনে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ধান চাষ। অসময়ে বন্যা, বৃষ্টি এবং প্রবল শিলাবৃষ্টির কারণেও ধান চাষ ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশের সোনালি আঁশ, পাটের উৎপাদন কমে যাওয়ায় চাষিরা পাট চাষে বিমুখ হয়ে পড়ছেন। পাট চাষের ক্রমাবনতির জন্য বিশেষজ্ঞরা জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন। শীতকালের স্থায়িত্ব কমে যাওয়ায় রবিশস্যের জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার শৈত্যপ্রবাহের ফলে সরিষা, মসুর, ছোলাসহ বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসবের ফলে সারা বিশ্বে যে জলবায়ু পরিবর্তনের আলামত দেখা দিয়েছে, তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই।
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ বা তার মতো দেশগুলো দায়ী নয়, দায়ী ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলো। কিন্তু এর খেসারত স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকেই বেশি দিতে হচ্ছে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও ক্ষতি মোকাবিলায় ধনী ও উন্নত দেশগুলো তেমন সহযোগিতা না করা অত্যন্ত হতাশার। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত সমস্যা একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। এ সমস্যা দূর করতে হবে। এ জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগ-পদক্ষেপ অত্যাবশ্যক। এ ব্যাপারে ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলোরই অগ্রবর্তী ভূমিকা রাখা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে অনেক সজাগ নয়। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, কোনো দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি প্রয়োজন। অথচ আমাদের দেশে সরকারি হিসাব মতে মাত্র ১৯ শতাংশ বনভূমি রয়েছে। আর বেসরকারি হিসাবে এর পরিমাণ ৯ শতাংশের বেশি নেই। বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার বিপুল খাদ্যচাহিদা মেটানোর জন্য কৃষিজমির পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে বাসগৃহ ও আসবাবপত্র তৈরিতে এবং জ্বালানির চাহিদা মেটাতে সংগ্রহ করা হয় কাঠ। এ জন্য ব্যাপকহারে বন উজাড় করা হচ্ছে। পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতে বৃক্ষের অপরিহার্যতা অসামান্য। বৃক্ষ প্রতিনিয়ত বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। অর্থাৎ গাছের মূল থেকে সংগৃহীত পানি ও কার্বন ডাই-অক্সাইড সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে বিক্রিয়া করে অক্সিজেন ও গ্লুকোজ উৎপন্ন করে। গাছের আর একটি বিশেষ গুণ হলো নিজের খাদ্য নিজে প্রস্তুত করতে পারে। প্রাণী তা পারে না। বরং উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে বেঁচে আছে। কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয়, মানুষ এই কল্যাণময় পরিবেশ ও বনভূমির ওপর অত্যাচার করে চলেছে। নির্বিচারে উজাড় করা হচ্ছে বৃক্ষরাজি। ২০০০ সালে জাতিসংঘের এক জরিপে বনজ সম্পদের ওপর জরিপ উল্লেখ করা হয়েছিল, ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে আমাদের দেশের সবচেয়ে উন্নত বনাঞ্চলের পরিমাণ ৪৫০ হেক্টর থেকে ২০০ হাজার হেক্টরে এসে দাঁড়িয়েছে। এভাবে বৃক্ষনিধন চলতে থাকলে পরিবেশের অবস্থা খুবই ভয়াবহরূপ ধারণ করবে। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে দেখা দিচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা এবং এ কারণে অতিমাত্রায় অনাবৃষ্টি ও খরার কবলে পড়তে হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর ‘বিজনেস আজ ইউজুয়াল’ পটভূমিতে হিসাব করে দেখিয়েছে, ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর উষ্ণতা ৪.২ ডিগ্রি বাড়বে। জলবায়ুর পরিবর্তনের নেতিবাচক দিক ভেবে মানবসভ্যতা তার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। আইপিসিসির দাবি অনুসারে বর্তমান সময়টি হলো গত ১০০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ। উন্নত বিশ্বের জীবাশ্ম জ্বালানির ফলে বায়ুদূষণ প্রতিক্রিয়ার ফলে ২০৬০ সালের পরে হড়হ সবষধহড়সধ ংশরহ ক্যানসারের ঘটনা সংখ্যা শতকরা ৬ থেকে ৩৫ ভাগ বৃদ্ধি পাবে। সমুদ্র সমতল বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বৃহৎ শহর ও উপকূলের উর্বর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত করে লাখ লাখ জনসাধারণকে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য করবে। এটি তৈরি করবে খাদ্য ঘাটতি এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কিছু অঞ্চলে দুর্ভিক্ষও দেখা দিতে পারে। অপেক্ষাকৃত উষ্ণ ও আর্দ্র অবস্থা ইধপঃবত্রধ এবং অন্যান্য বিষাক্ত উৎপাদক, যেমন : ফাঙ্গাস থেকে নিঃসৃত বিষাক্ত পদার্থ (অভষধঃড়ীরহং) বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে পারে। তার ফলে খাদ্য দূষিত হয়ে নষ্ট হওয়ার পরিমাণ সম্ভবত বৃদ্ধি পাবে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে চাষাবাদের সময়কাল সংকুচিত হতে পারে এবং উৎপাদনশীলতা কমে যেতে পারে। পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ার নেতিবাচক প্রভাব বনাঞ্চলে পড়লে প্রাকৃতিক ভারসাম্যে পরিবর্তন আসতে পারে। প্রাণিকুল, ভূমি, পানি ইত্যাদির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলে বসবাসরত প্রায় দুই কোটি মানুষ বাস্তুহারা হবে। খরা, বন্যা ও লবণাক্ততার ফলে ফসলের উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে।
পরিবেশসচেতন হওয়ার সময় এখনই। আমাদের জনগণ আমাদের পরিবেশ রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে। কেবল সরকারের পক্ষেই পরিবেশ রক্ষা সম্ভব নয়; জনগণকেও এ বিষয়ে সচেতন হয়ে পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখতে হবে। এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস, দীর্ঘমেয়াদি বন্যা, জলাবদ্ধতা, খরা, অতিরিক্ত লবণাক্ততা এসব সমস্যা এখন প্রকট। এসব সমস্যার কারণে প্রতি বছর দেশের লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে। এ অবস্থায় জলবায়ু ও দেশে পরিবেশ রক্ষায় সরকার আরো বেশি সচেষ্ট হবে-এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
"