মাহমুদুল হক আনসারী
মতামত
নির্বাচন ও উন্নয়ন
নির্বাচনের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক। প্রার্থীর সঙ্গে দলের সম্পর্ক। উন্নয়নের সঙ্গে দেশ ও জনগণের সম্পর্ক। নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া অন্য কেউ উন্নয়ন করতে পারে না। উন্নয়ন আর নির্বাচন দুর্নীতিমুক্ত না হলে সেখানে সঠিক উন্নয়ন জনগণ দেখতে পায় না। নির্বাচনের সঙ্গে নির্বাচনী দলের সম্পর্ক। যাদের নিবন্ধন আছে তারাই দলীয়ভাবে তাদের প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। নির্বাচনে জয় পরাজয় প্রার্থী ও দলের জন্য থাকলেও সে ক্ষেত্রে প্রার্থী মনোনয়নে কিছু গুণাবলি দলের দেখার প্রয়োজন আছে। আমাদের দেশে নির্বাচন এলে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের নির্বাচনমুখী দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। বড় বড় দলের নমিনেশন পেতে কোটি কোটি টাকার লেনদেন করতেও পিছু হটে না। নির্বাচনে একবার জয়ী হতে পারলেই লাভ লোকসান একসঙ্গে দুই হাতে আয় করা সম্ভব।
গণতন্ত্রের নামে যাদের ন্যূনতম রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা, দেশপ্রেমিক ও মাতৃভূমির প্রতি দায়িত্বশীলতার পরিচয় নেই, এমন ধরনের প্রার্থীকেও নির্বাচনের প্রার্থী হতে দেখা যায়। যাদের হাতে অবৈধ টাকার পাহাড়, তারা অর্থ দিয়ে বড় বড় দলের নীতিনির্ধারকদের বশ করে দলীয় মনোনয়ন পাচ্ছেন। কাড়ি কাড়ি অর্থ খরচ করে ভোটারদের ভোট আদায় করতেও দেখা যায়। এসব প্রার্থী জাতীয় সংসদে গিয়ে এলাকার সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানে দুই মিনিট গোছাল বক্তব্যও রাখতে পারেন না। নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও পরিবারকে গোছাতেই ব্যস্ত থাকেন। তাদের ব্যবসা শত শত গুণ বেড়ে যায়। জনগণ এবং উন্নয়নের সঙ্গে তাদের দেখা মেলে না। যে পরিমাণ অর্থ খরচ করে এরা নির্বাচিত হয়েছেন, তারা তাদের লগ্নি করা অর্থ লাভসহ ফেরত পাওয়ার উদ্দেশ্যেই কাজ করেন। বাংলাদেশের তৃণমূল থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত নির্বাচনের এমন প্রার্থী পরিক্রমা জনগণ দেখতে পায়। এ ধরনের পক্রিয়া ছোট-বড় সব দলের মধ্যে বিদ্যমান। এসব রাজনৈতিক মনোনয়ন জনগণ ভালো চোখে দেখেন না। তার পরও রাজনৈতিক দলগুলো এ ধরনের আদর্শ ও নীতিহীন কতিপয় প্রার্থী জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়।
দেশ এখন উন্নয়নের পথে এগোচ্ছে। শহর, গ্রাম, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত উন্নয়নের ছোঁয়া দেখা যাচ্ছে। উন্নয়ন রাষ্ট্রীয়ভাবে নিজস্ব গতিতে চলছে। বলতে গেলে উন্নয়নের একটা গতি শুরু হয়েছে। এ গতিকে কেউ ইচ্ছে করে থামাতে পারবে না। নতুন প্রজন্ম উন্নয়ন অগ্রগতিতে বিশ্বাসী। দৃশ্যমান উন্নয়ন অগ্রগতিকে তারা সাধুবাদ জানাচ্ছে। অফিস-আদালতে আগের মতো যুগ যুগ ধরে ফাইল আটকে থাকে না। যেকোনো ঘটনা দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থা অনেকটা নিয়মের মধ্যে এসেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য সেবা প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছেমাফিক ভোগান্তির দিন প্রায় শেষ। অন্যায়, অবিচার, জুলুম করলেই সঙ্গে সঙ্গে এখন তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। যতই প্রভাবশালী আর ক্ষমতাধর হোক না কেন, বর্তমান সরকার নিজ দলের হলেও এ ক্ষেত্রে ছাড় দিচ্ছে না। এতে এ প্রজন্মের ভোটারের কাছে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। উন্নয়ন এবং শৃঙ্খলায় দেশ যেভাবে সামনের দিকে এগোচ্ছে, এতে সরকারের সাফল্য ও প্রশংসা জনগণের কাছে বাড়ছে। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত তথ্যপ্রযুক্তি এবং কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণে শিক্ষার্থীরা ঘরে বসেই সরকারের সব ধরনের তথ্য বিজ্ঞপ্তি হাতের নাগালেই পেয়ে যাচ্ছে। ছাত্র আন্দোলন রাজনৈতিক হানাহানি সহিংস কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। জনগণ তাদের কর্মযজ্ঞ চালিয়ে দিনযাপন করতে বাধা পাচ্ছে না। নির্দ্বিধায় অসংকোচে জনগণের পথচলা নির্বিঘœ হয়েছে।
নির্দিষ্ট শ্রেণি ও পেশার মানুষ ছাড়া অন্য জনগণ প্রশাসন ও পুলিশের হয়রানির শিকার হচ্ছেন না। দোকান মার্কেট প্রতিষ্ঠানে একসময় সন্ত্রাসী চাঁদাবাজদের ভয়ে ব্যবসা করতে পারতেন না। এখন সে ধরনের পরিবেশ খুব কমই পাওয়া যাবে। ব্যবসার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, তাদের বক্তব্য তারা ভালোভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। ইচ্ছেমতো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় মাসের পর মাস অবরোধ রেখে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রেখে শিক্ষাজীবন ধ্বংস করার কর্মসূচি এখন আর কেউ করতে পারে না। রাজনীতির নামে ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে আছে। সরকারি-বেসরকারি সবগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন তাদের নিজস্ব নিয়মনীতিতে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ মাদক বেচাবিক্রি প্রায় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে। সরকারের কঠোর পদক্ষেপ এবং মনোবলের কারণে এসব সম্ভব হচ্ছে।
ভোট নাগরিকের মৌলিক অধিকার। ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়। এ পরিবর্তন যেন দুর্নীতিতে এগিয়ে না আনতে পারে। অব্যাহত উন্নয়নের শৃঙ্খলা ধরে রাখতে হবে। উন্নয়নে অর্থ দুর্নীতির মাধ্যমে যাতে অন্যের পকেটে ঢুকতে না পারে, সে দায়িত্ব কঠিনভাবে পালন করতে হবে জনগণকে। যুগ যুগ ধরে যারা দুর্নীতির মাধ্যমে পকেট ভর্তি করেছে, আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে, এ জাতীয় প্রার্থীদের বয়কট করতে হবে। তাদের সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে রাজনৈতিক দল এবং জনগণকে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে যেসব দল অংশগ্রহণ করবে, তারা যেন সৎ, যোগ্য, আদর্শবান দেশপ্রেমিক লোককে মনোনয়ন দেয়। অর্থ আর কালো টাকার দাপটে যেন চোরাকারবারি, মাদক পাচারকারী, দুর্নীতিগ্রস্ত কেউ যেন প্রার্থী হতে না পারে। সে বিষয়ে রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনকে কঠোর হতে হবে। অব্যাহত উন্নয়নের ধারা ধরে রাখতে হলে অবশ্যই গতিশীল দায়িত্বশীল দেশপ্রেমিক সরকার দরকার। যাদের পক্ষে উন্নয়ন এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব তাদেরই ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠা করা জনগণের দায়িত্ব। কোনো ধরনের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত যেন দেশের উন্নয়নের গতিকে থামিয়ে দিতে না পারে, সে দায়িত্ব জনগণকে সঠিকভাবে পালন করতে হবে। উন্নয়ন দেশবিরোধী সব চক্রান্ত ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে জাতিকে সফল হতে হবে। এ সফলতার মাধ্যমে আগামী দিনের জাতীয় সমস্যা কোটি কোটি শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠী যাতে কর্মসংস্থান পায়, সে চিন্তা এখন থেকে করতে হবে। প্রতি বছর সবগুলো বাজেটে অধিকহারে কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। ইতোমধ্যেই সারা পৃথিবীতে শ্রম রফতানির পথ ছোট হয়ে আসছে। হু হু করে পৃথিবীব্যাপী বেকার কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়ে আসছে। এসব চিন্তা পরিকল্পনায় এনে আগামী নির্বাচিত সরকারকে কর্মসংস্থানের অধিক গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। শ্রমশক্তি বিদেশে রফতানি না করে নিজ দেশেই আত্মমর্যাদার সঙ্গে শিক্ষিত যুবশক্তিকে কাজে লাগাতে পারলেই দেশ আর কারো মুখাপেক্ষী হবে না। স্বাধীন বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে বিশ্বকে দেখাবে।
অতএব, একাদশ জাতীয় নির্বাচন দেশের স্বাধীনতার স্বার্বভৌমত্ব ও জনগণের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্বাচন। অতীতের যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে এ নির্বাচন অধিক গুরুত্ব বহন করে। তাই দেশ ও জনগণ সরকারের স্বার্থেই দুর্নীতিবাজ কালো টাকার মালিক অসৎ শ্রেণির লোক ও দলকে বয়কট করার শপথ এখন থেকেই গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকবে। দুর্নীতির শক্তি দুর্বল হবে এবং মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। এ দায়িত্ব সম্মিলিতভাবে দেশপ্রেমিক সব শ্রেণি ও পেশার মানুষকে পালন করতে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই নির্বাচন ও উন্নয়ন একই সঙ্গে জাতির জন্য সফলতা বয়ে আনবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
"