হিমেল আহমেদ

  ১৫ জুলাই, ২০১৮

পর্যালোচনা

প্লাস্টিক না পৃথিবী!

প্লাস্টিক একসময় ছিল মানুষের পরম বন্ধু, সময়ের আশীর্বাদ। আর এই প্লাস্টিক এখন জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্লাস্টিক দূষণ ও তার ক্ষতিকর প্রভাব বিশ্বকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। যার মারাত্মক প্রভাব জীববৈচিত্র্যে ও পরিবেশকে বিনষ্ট করছে প্রতিনিয়ত। প্লাস্টিক ছাড়া আমাদের একটি দিনও চলে না। যার সহজলভ্যতা আমাদের সঙ্গে এক নিবিড় বন্ধুত্ব তৈরি করেছে, যার ফল ক্রমেই ভোগ করতে শুরু করেছে পুরো বিশ্ব। প্লাস্টিকের এই সহজলভ্যতা ও টেকসই মানের কারণে প্লাস্টিক বর্তমানে পুরো বিশ্বের জন্য শত্রুস্বরূপ। কাগজ ও চটের চেয়ে প্লাস্টিক টেকসই বেশি, তাই মানুষের প্লাস্টিকের প্রতি আকর্ষণ বেশি। যত দিন যাচ্ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়ে চলেছে। যার ব্যবহার প্রতিরোধ করা না গেলে ভবিষ্যৎ এ সমুদ্রে পানির বদলে প্লাস্টিক আর পলিথিন থাকবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ১৯৫০ সালেই পুরো পৃথিবীতে প্লাস্টিকের উৎপাদন ছিল মাত্র ২ দশমিক ২ টন। ৬৫ বছর পর, ২০১৫ সালে সে পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪৮ মিলিয়ন টনে। সত্যি অবাক করার মতো তথ্য। গবেষণায় জানা যায়, পৃথিবীতে এখন প্রতি বছর মাথাপিছু ৬০ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার হয়। উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ এবং জাপানের মতো শিল্পোন্নত দেশগুলোয় এই পরিমাণ মাথাপিছু ১০০ কেজিরও বেশি। বেশি উন্নত দেশগুলোতেই প্লাস্টিকের ব্যবহার বেশি। প্লাস্টিক অপচনশীল পদার্থ হওয়ায় যার কুফলে মাত্রাধিক ক্ষতি করছে আমাদের, সে বিষয়ে আমরা এখনো অজ্ঞাত আছি। প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার এখনই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না হলে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম প্লাস্টিকের মারাত্মক দূষণের কবলে পড়বে। বাংলাদেশেও প্লাস্টিকের ব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলেছে। প্লাস্টিক পচে না এবং মাটি কিংবা পানির সঙ্গেও মেশে না, যার কারণে অপচনশীল এই পদার্থ সামগ্রিক পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওয়েইস্ট কনসার্নের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে পাঁচ লাখ টনেরও বেশি প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার হয়। এর মধ্যে রিসাইকেল হয় মাত্র ৯ দশমিক ২ শতাংশ। বাকি প্লাস্টিক কিছু জ্বালানি হিসেবে পুড়ে বায়ু দূষিত করে। কিছু প্লাস্টিক জমা হয় দেশের নদনদী, খালবিল ও নর্দমায়। ফলে বিঘিœত হয় দেশের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা। বাংলাদেশ নদনদীর দেশ। খালবিল, ড্রেন নর্দমার দেশ। তাই প্লাস্টিকের প্রতিবন্ধকতার কারণে দেশে পানির চলাচলের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ব্যাহত ঘটে এটা বলা ভুল হবে না। বর্তমানে দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। হাটবাজারে, শপিং মলে, কেনাকাটায় সর্বত্র পলিথিনের রাজত্ব। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী প্লাস্টিকের মোড়কে বাজারে সহজলভ্যতা পেয়েছে। প্লাস্টিকের দূষণ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের অভাবের কারণে আমরা প্রতিনিয়ত নিত্যদিনের ব্যবহৃত প্লাস্টিক ড্রেন, নর্দমা, নদনদী ও খালবিলে ফেলে তা ভরাট করে ফেলছি। ফলে বন্ধকতা সৃষ্টি হয় পয়োনিষ্কাশনে। সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় তিন লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য নদীনালা, খালবিল ও উন্মুক্ত স্থানে ফেলা হচ্ছে। এর মধ্যে আবার ১ কোটি ৩০ লাখ টন প্লাস্টিক আবর্জনা সমুদ্রে পড়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। এতে প্রতি বছর ১০ কোটি সামুদ্রিক প্রাণী প্লাস্টিক দূষণের শিকার হয়ে মারা যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সাগরগুলো প্লাস্টিক ও বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থ দিয়ে ভরপুর হয়ে যাবে, এতে সন্দেহ নেই। প্লাস্টিক বর্তমানে এতটাই জনপ্রিয় যে, যার ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। তাই প্লাস্টিক দূষণ থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে আমাদের প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে রিসাইকেল কিংবা আবার ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে। যে প্লাস্টিকগুলো আমরা বর্জ্য হিসেবে ড্রেন, নর্দমা কিংবা নদীতে ফেলছি, তা প্রায় সব কিন্তু সাগরে গিয়ে পড়ছে। অপচনশীল হওয়ায় সাগরও বছরের পর বছর ভেসে বেড়াচ্ছে ক্ষতিকর এই প্লাস্টিক। আর ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে সাগরে বসবাস করা জলজ প্রাণীদের। প্লাস্টিকের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সমুদ্র, যা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অবসান নেই। একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, যদি প্লাস্টিকের ব্যবহার এখন থেকেই নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তাহলে আগামী দশ বছরের মধ্যে পৃথিবীর সমুদ্রগুলোয় প্লাস্টিকের পরিমাণ তিন গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জন্য তৈরি করা এই প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বিশ্বের সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো সমুদ্রে প্লাস্টিক ও অন্যান্য আবর্জনার পরিমাণ বৃদ্ধি। প্লাস্টিকের পরিমাণ বৃদ্ধিতেও সাগরের পানির তাপমাত্রা ও দূষণ বাড়ছে বলে জানানো হয় ওই প্রতিবেদনে। অনেক চেষ্টার পর ও প্লাস্টিকের ব্যবহার কিছুতেই কমানো যাচ্ছে না। তাই এই প্লাস্টিক রিসাইকেল করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বিজ্ঞানীরা। কিছুদিন আগে দৈনিক ইত্তেফাকের শেষ পাতায় এক প্রতিবেদনে পড়েছিলাম প্লাস্টিক রিসাইকেল করা নিয়ে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়; প্লাস্টিক এমন এক রাসায়নিক পদার্থ, যা পরিবেশে পচতে কিংবা কারখানায় পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করতে অনেক সময় লাগে। তাই একে ‘অপচ্য পদার্থ’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া যায়। এগুলো পরিবেশে বর্জ্য আকারে জমা হতে থাকে। হিসাব মতে, পরিবেশ থেকে মাত্র ৯ শতাংশ প্লাস্টিক পুনঃচক্রায়ন করা সম্ভব হয়। কিন্তু প্লাস্টিকের পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী এক পরিবর্তন আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন কানাডার তরুণ বিজ্ঞানী মিরান্ডা ওয়াঙ। মিরান্ডা এবং তার প্রতিষ্ঠান বায়োকালেকশন প্লাস্টিক দূষণের চিত্র বদলে দিতে চান। তারা এমন এক পদ্ধতি আবিষ্কার করার কথা বলছেন, যে প্রক্রিয়ায় পরিবেশে বর্জ্য আকারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্লাস্টিককে অতি সহজে পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ করা যাবে। আমি মনে করি, এটি করা গেলে প্লাস্টিক দূষণ থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি। এই প্লাস্টিক নষ্ট হতে প্রচুর সময় নেয়। এটি প্রথমে মাইক্রো প্লাস্টিকে রূপ নেয়। তার পর পানি, মাছসহ বিভিন্ন উপায়ে মানুষের দেহে প্রবেশ করে নানাবিধ রোগের সৃষ্টি করছে। এই প্লাস্টিকের ব্যবহারে সচেতনতা ও রিসাইকেলিং বর্তমানে বিশ্বের কাছে একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবী নামক এই গ্রহের একজন বাসিন্দা হিসেবে আমাদের দায়িত্ব আমরা যেন আমাদের দেশ, আমাদের পৃথিবী, আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য বসবাসের উপযোগী করে রাখতে পারি। আমাদের কারণেই আজ প্লাস্টিক প্রাণিজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই আগে সচেতন হতে হবে আমাদেরই।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist