রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৪ জুলাই, ২০১৮

বিশ্লেষণ

স্মার্টফোনে বন্দি জীবন

আধুনিক যুগে প্রযুক্তির ব্যবহারে মুঠোফোনই সব ধরনের মাদকতা সৃষ্টি করছে। হাতে একটি স্মার্টফোন না থাকলে নিজেকে স্মার্ট ভাবতে হয়তো কষ্ট হয় অনেকেরই। কিন্তু প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকেÑ সেটাও মাথায় রাখা উচিত। মুঠোফোন থেকেই ফেসবুক, হোয়াটসআপ, ভাইভার, ইমো ও স্কাইপির সৃষ্টি। দেশে বিদেশে মুঠোফোন গ্রাহকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে মুঠোফোন গ্রাহক ১০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে মুঠোফোন যতটা কার্যকর আবার এর অতিরিক্ত ব্যবহার শরীরের জন্য ঠিক ততটাই ঝুঁকিপূর্ণ। আর এটি শরীরে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে আমাদের ঘুমের ওপর। গবেষকরা বলছেন, মুঠোফোনে অতিরিক্ত কথা বলা এবং একটানা দীর্ঘ সময় কম্পিউটার ব্যবহারে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, যা মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়। সুইডেনের ইউনিভার্সিটি অব গুটেনবার্গের গবেষক সারা থমির মতে, প্রযুক্তি ব্যবহারের সময় স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হলে এর স্বাস্থ্যকর ব্যবহার জানতে হবে। থমি তার সঙ্গীদের নিয়ে মুঠোফোন ও কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের ওপর কয়েকটি গবেষণা চালান। গবেষকদের চারটি দলে ভাগ করেন তিনি। প্রথম দলটি মুঠোফোন অতিরিক্ত ব্যবহারকারী ও দ্বিতীয় দলটি স্বাভাবিক ব্যবহারকারীদের ওপর পর্যবেক্ষণ করে। তৃতীয় দলটি অতিরিক্ত কম্পিউটার ব্যবহারকারী এবং চতুর্থ দলটি স্বাভাবিক ব্যবহারকারীদের পর্যবেক্ষণ করে।

প্রায় এক বছর পর্যবেক্ষণের পর দেখা যায়, যারা অতিরিক্ত কম্পিউটার ও মুঠোফোন ব্যবহার করেন তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে আর এ সংখ্যা তরুণদের মধ্যেই বেশি। যারা মুঠোফোনে অতিরিক্ত কথা বলেন এবং কম্পিউটার ব্যবহার করেন তাদের অনিদ্রাসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয় এবং তারা বেশি মাত্রায় বিষণœতায় ভোগেন। অনেকেই আবার এ বিষণœতার কারণে আত্মহনসহ নানা ধ্বংসাত্মক কাজে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। যারা রাত জেগে একটানা দীর্ঘ সময় কম্পিউটার ব্যবহার করেন বা মুঠোফোন ব্যবহার করেন তাদের রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। গবেষকরা প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণকে সতর্ক করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তাই আমাদের তরুণ প্রজন্মদের এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, প্রযুক্তি আমাদের যেমন প্রয়োজন আবার প্রযুক্তির অতিরিক্ত আসক্তি সমাজ ও শরীরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, কোনো কিছুর অতিরিক্ত আসক্তি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। যোগাযোগের ইতিহাস বদলে দেওয়া এক মাধ্যম। দুনিয়া যেন আক্ষরিক অর্থেই পরিণত হয়েছে এক গ্রামে। ফেসবুক নামের বিশ্বগ্রামে প্রতিদিন নিজেদের মতামত দিচ্ছেন কোটি কোটি মানুষ। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। মুক্ত মাধ্যমে মুক্ত হাতে লিখছেন নানা শ্রেণি-পেশার জনগোষ্ঠী। তবে সামাজিক যোগাযোগের এ মাধ্যমে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সবসময় সামাজিক থাকছে না। মত প্রকাশের নামে চাষ হচ্ছে ঘৃণারও। চরিত্র হরণ করা হচ্ছে মানুষের। অনেকটা সুকৌশলে। মিথ্যা আর অশালীন প্রচারণার মাধ্যম হিসেবে ফেসবুককে ব্যবহার করছেন অনেকে।

রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে অভিনেতা-অভিনেত্রী, সাধারণ মানুষ কেউই বাদ যাচ্ছেন না ফেসবুক হয়রানি থেকে। এমনকি ইতিহাসের অনেক মহামানবকে নিয়েও ফেসবুকে রচনা করা হচ্ছে কুৎসার। একটি নবজাতক যখন পৃথিবীতে আসে তখন সে কাদা মাটির মতোই নরম, অফুটন্ত ফুলের কলির মতো পবিত্র এবং হিমেল হাওয়ার মতো শান্ত থাকে। আর তখন আমাদের করণীয় হলো ওই কাদা মাটিকে একটি সত্যিকারের মানুষের আদলে গড়ে তোলা, অফুটন্ত কলিকে সুন্দর পরিবেশে প্রস্ফুটিত হতে দেওয়া আর ওই হিমেল হাওয়াকে জাতীয় শান্তির উপকরণে পরিণত করা। দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে শিশুদের জন্য সুষ্ঠু কার্যক্রম গ্রহণ অপরিহার্য। প্রত্যেক শিশুকে দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় সবার অংশগ্রহণ একান্ত বাঞ্ছনীয়। শিশুরাই দেশের ভবিষ্যত কর্ণধার। জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে শিশুদের উন্নয়নে সার্বিক কার্যক্রম অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন। একজন মা তার সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার সবচেয়ে নিখুঁত কারিগর। বাবা হতে পারেন মায়ের যোগ্য সহকর্মী। একজন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকের চেয়ে পিতামাতা তার সন্তানের সুপ্ত প্রতিভার খোঁজ বেশি রাখেন। যে সন্তানের যেদিকে ঝোঁক থাকে, তাকে সে পথে চলতে দেওয়াটাই উত্তম। বিখ্যাত মনীষী হওয়ার জন্য, বিশ্বের সবার কাছে শ্রদ্ধেয় হওয়ার জন্য ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে না।

সেলফি হাল ফ্যাশনে ছবি তোলার সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায়, ছুটির দিনে অথবা পারিবারিক ও সামাজিক আনন্দঘন মুহূর্ত ধরে রাখছে সেলফি। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেকে ব্যতিক্রম করে উপস্থাপন করতে এই সেলফি যেন এখন আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। কেন এই সেলফি আসক্তি। সেলফি নেশায় আসক্ত গোটা বিশ্ব। আর সেলফি নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা দুর্ঘটনাও কম নয়। অসতর্কতার কারণে ঘটছে প্রাণহানি। আনন্দ-উল্লাস, হাসি-কান্না, বিদায়-অভিবাদন, প্রার্থনা-মৃত্যু, যেকোনো মুহূর্ত ধরে রাখতে তরুণ প্রজন্মের এই সেলফি আসক্তি স্মার্টনেসের অপরিহার্য অনুষঙ্গ মনে না করে। তার জন্য পরিমিতবোধ ও রুচিশীলতা বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ঝুঁকিপূর্ণ সেলফির মাধ্যমে নিজেকে জাহিরের এই মানসিকতা হীনমন্যতার পরিচয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া সেলফি তুলতে যেন ক্লান্তি নেই কারো। হাতে সেলফোন থাকলেই কারণে অকারণে একের পর এক ছবি তুলতে থাকেন সবাই। কিন্তু বিপত্তি তখনই, যখন ফোনের চার্জ শেষ হযে যায়। আফসোসের যেন শেষ থাকে না আর। শুধু তাই নয়, জনপ্রিয় যোগাযোগ এই মাধ্যমটি এখন সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ হিসেবেও মূল্যায়িত হচ্ছে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে ফেসবুক ব্যবহার হওয়ার কথা, তা থেকে এখন সরে এসে নেতিবাচক উদ্দেশ্যে এটি ব্যবহার হচ্ছে বলে সমাজবিজ্ঞানী ও মনস্তাত্ত্বিকরা বলছেন। এখন অনেকের অশান্তি, দুর্ভোগ ও যন্ত্রণার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেসবুক। সামাজিক এই যোগাযোগমাধ্যমটির কারণে অনেক ঘরে অশান্তি দেখা দিয়েছে। ফেসবুকে বন্ধু হতে গিয়ে অনেকের মধ্যে গড়ে উঠছে পরকীয়ার সম্পর্ক। এতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সন্দেহের দানা বাঁধছে। তরুণ-তরুণীরা প্রতারণামূলক সম্পর্কে জড়িয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রেমের ফাঁদে পড়ে মেয়েদের যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ দিতে হচ্ছে। শিশু-কিশোরদের মাত্রাতিরিক্ত ফেসবুক আসক্তি থেকে পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটছে। সব মিলিয়ে সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমটি এখন সামাজিক সমস্যার মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপকারী একটি উপকরণ যখন ক্ষতির কারণ হয়, সেটা নিয়ে ভয়াবহ উদ্বেগের কারণ রয়েছে। মুঠোফোনের এমন নেতিবাচক ব্যবহার নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার বিষয় রয়েছে। মুঠোফোনে ছবি তোলা যায় এবং ভিডিও করা যায়। এতে রয়েছে অসংখ্য ধরনের খেলা। একটি জরিপে জানা গেছে, স্কুল কলেজের ছাত্ররা এর মাধ্যমে পর্নো ছবি দেখছে। জরিপে দেখা গেছে ৭৭ শতাংশ ছাত্র এর মাধ্যমে পর্নো দেখে। আবার ওই পর্নভিডিও ধারণ করা হয় সেই মোবাইল দিয়ে। এরপর সেটা এর মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বাসে চড়ার সময় বিষয়টি ভালোভাবে লক্ষ করা যায়। সবাই মুঠোফোন নিয়ে ব্যস্ত। পাশে তাকানোর প্রয়োজনও কখনো মনে করে না তারা। এটাকে মারাত্মক আসক্তি বলা যায়। যোগাযোগের এই যন্ত্রটিকে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত রাখতে হলে এর নেতিবাচক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ ধরনের জঘন্য প্রবণতা ব্যক্তির শারীরিক ও সামাজিক ক্ষতি করার পাশাপাশি তার জীবনের সব সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেয়। বস্তুত এই ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি জীবন থেকে জীবন কেড়ে নেয়। যে পরিবারের ছেলেমেয়েরা এ ধরনের আসক্ত রয়েছে সে পরিবারের দুঃখ-দুর্দশার সীমা নেই। আমাদের যুব সমাজের একাংশ আজ মুঠোফোন মাদকতার করাল গ্রাসে নিপতিত হয়ে জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে, যার ফলে বিনষ্ট হচ্ছে সামাজিক স্থিতিশীলতা, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়নের ধারা।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist