আবু তাহের
বিশ্লেষণ
ভেঙে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধন
সামান্য ভুল বোঝাবুঝিতে সুখের ঘরে ঢুকে পড়ছে দুঃখের আগুন। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদের মতো ঘটনা। ভেঙে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধন। এর অন্যতম কারণ হিসেবে প্রথমে ধরা হয় পরকীয়ার বিষয়টি। এ ঘটনায় একের পর এক তছনছ হচ্ছে সাজানো সংসার। বাড়ছে খুনোখুনির ঘটনাও। বাবা-মায়ের দাম্পত্য কলহের জেরে অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে নিষ্পাপ শিশুসন্তানরা। পরে এ শিশুরা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। শিশুকাল থেকে পিতৃ-মাতৃহীনতার কারণে ঢুকে যাচ্ছে অন্ধকার নেশার জগতে। আক্রান্ত হচ্ছে নানা মানসিক রোগে। ঝরে পড়ছে বিদ্যাপীঠ থেকে।
বিবিএসের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, দেশে বিবাহিত ও তালাকপ্রাপ্ত পুরুষ উভয়ই বেড়েছে। বিবাহিত পুরুষ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিপতœীক পুরুষের সংখ্যাও বেড়েছে। তালাকপ্রাপ্ত ও বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা পুরুষের হার ২০১৬ সালে ছিল শতকরা ১ দশমিক ৪ শতাংশ। পরের বছর সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৫ শতাংশে। এই হার ৫ বছরের ব্যবধানে বেড়েছে দশমিক ৪ ভাগ। একই সঙ্গে নারীদের বিয়ে, তালাক ও পৃথক বসবাসের সংখ্যাও বেড়েছে। দেশের ১০০ জন নারীর মধ্যে বতর্মানে গড়ে ১০ দশমিক ৫ শতাংশ নারী তালাকপ্রাপ্ত, যা আগের বছর ছিল ১০ শতাংশ। গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে এই হার বেড়েছে দুভাগ। ২০১৭ সাল পর্যন্ত হিসাব অনুসারে দেশের মোট বিবাহযোগ্য পুরুষ জনসংখ্যার ৫৯ দশমিক ৯ শতাংশ বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ। ২০১৬ সালে এ হার ছিল ৫৯ দশমিক ২ শতাংশ। ১০ বছরের বেশি বয়সীদের বিয়ের হিসাব কষে এ হার বের করা হয়েছে।
মূলত কোন বিষয়গুলো এর পেছনে দায়ী? অন্যতম কারণ হিসেবে যেগুলো বিবেচনা করা যায় তা হলোÑমোবাইল ফোন, চ্যাটবক্স, ফেসবুক, যৌতুক, নেশার উন্মাদনা, বিপরীত লিঙ্গ থেকে যৌন চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে দাম্পত্য কলহ, পরকীয়া, আর্থিক দৈন্য, বিদেশি বিশেষ করে ভারতীয় চ্যানেলের নাটক-সিনেমার প্রভাবসহ মানসিক হীনম্মন্যতার কারণে পারিবারিক বন্ধন ভেঙে যাচ্ছে। এর ফলে ভাঙছে সংসার। বিষয়গুলোকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করলেও মূল বিষয় কয়েকটি। পরকীয়া, উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন, দাম্পত্য যৌন জীবন। পরকীয়ার বিষয়টি সবার ওপরে। মোবাইল ফোন, ফেসবুকের মাধ্যমে দিনে দিনে মানুষ এই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আর এই অপরাধকে উসকে দেওয়ার জন্য রয়েছে টিভি চ্যানেলের নাটক-সিনেমা, যা প্রতিদিনই আগের দিনকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের খোলামেলা উপস্থাপন, নিছক ব্যক্তিগত ঢেকে রাখা বিষয়গুলোকে স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ করার ফলে শিথিল হয়ে যাচ্ছে পারিবারিক বিভিন্ন স্তরের বাঁধনগুলো। এ বিষয়গুলো যে শুধু পারিবারিক বাঁধনই ছিন্ন করছে তা নয়, আত্মহত্যার মতো অসংখ্য ঘটনার জন্ম দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমাদের উদার মানসিকতায় ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে পরিবারের বিভিন্ন সদস্য বিভিন্ন ধরনের অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। শুধু যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কে টানাপড়েন তা নয়, সন্তানরাও হরহামেশা ঘটিয়ে যাচ্ছে এ অপরাধ। তারপরও আমরা নির্বাক।
দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন। ফেসবুক, চ্যাটবক্সের মাধ্যমে যে পরকীয়ার সূত্রপাত হয়, তাও এই জীবনযাপন থেকেই শুরু হয়। শহুরে জীবনযাপনে যারা অভ্যস্ত, তারা প্রতিক্ষণে এই জীবনযাপনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ছে। আজকাল ছোট ছোট ছেলেমেয়ে কোনো বিষয়কে উদযাপন করার জন্য এই উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনকে বেছে নিচ্ছে। ডিজে পার্টি, বিভিন্ন নিষিদ্ধ পানীয় পান থেকে শুরু করে রাত যাপন এখন অনেক সহজসিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, যা বাবা-মা থেকে শুরু করে ধারাবাহিকভাবে সন্তানের ওপর প্রভাব পড়ছে। পাশ্চাত্যের অনুকরণে আমরা আমাদের জীবনকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। কিন্তু খুব ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যায়, পাশ্চাত্যে পারিবারিক বন্ধন বলে তেমন কিছুই নেই। পারিবারিক এ ভাঙনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর। যে সংসারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অমিল থাকে, সেখানকার সন্তানরাও মানসিক সমস্যায় ভোগে। ভবিষ্যতে ওই সন্তান জড়িয়ে পড়ে বহুবিধ অপরাধে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণের মধ্যে রয়েছে নারীর আর্থিক সচ্ছলতা। নারী আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ায় সে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। তাই স্বামী ও তার পরিবারের নির্যাতন তারা এখন আর মুখ বুজে সহ্য করছে না। তাই বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা বাড়ছে। এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেকেই উচ্চাভিলাষী হওয়ার কারণে দুহাতে টাকা কামানোর জন্য এভাবেই তাদের জীবনকে সাজিয়ে নিচ্ছে। যে কারণে নারী খুব সহজেই তার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। আর বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে সন্তানরাও মানুষ হচ্ছে লাগামহীনভাবে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিবাহবিচ্ছেদে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে।
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় অনেকেই প্রেমে জড়িয়ে পড়ে গোপনে বিয়ে সেরে ফেলছে। এরপর কয়েক বছর যেতে না যেতেই পরিবারের মন রক্ষা অথবা নানা দৈন্যদশায় পড়ে তারা তালাকের দিকে যাচ্ছে। বিশেষ করে রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরায় ধনাঢ্য পরিবারে সবচেয়ে বেশি বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে। বাদ পড়ছে না মডেল-তারকা পরিবারও। কিন্তু সম্মান বাঁচাতে উভয় পরিবারের পক্ষ থেকে তা গোপন রাখা হয়। এ ছাড়া মাদকের প্রভাবে বিবাহবিচ্ছেদের মাত্রা এখন ভয়াবহ। বিশেষ করে বিয়ের পর নেশাগ্রস্ত স্বামীর প্রতি স্ত্রী আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। একজন নেশাগ্রস্ত মানুষ নানা অপরাধের সঙ্গেই যুক্ত হতে পারেন। নেশায় আক্রান্ত মানুষ শারীরিকভাবেও ধীরে ধীরে অক্ষম হয়ে ওঠে। সংগত কারণে একজন নারী ওই পুরুষের কাছে জীবন ও সংসারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেন না। তখন বিচ্ছেদ আবশ্যক হয়ে ওঠে। নারীদেরও কেউ কেউ নেশায় জড়িয়ে যাচ্ছেন এবং তাদের কারণেও বিচ্ছেদ ঘটছে। আর এ ঘটনাগুলো মূলত শহরকেন্দ্রিক বেশি হচ্ছে। শহরের তুলনায় গ্রামে এ ঘটনাগুলো খুবই কম। গ্রামের মানুষ শহরের মতো এত প্রযুক্তিনির্ভর নয়। টেলিভিশন, ফেসবুক কিংবা ডিজে পার্টি গ্রামে নেই বললেই চলে। যৌথ পরিবারের সবাই নিজেদের মধ্যেই আনন্দগুলো ভাগ করে নেয়। সামাজিকভাবে এদের বন্ধন এতটাই অটুট, অন্যের সঙ্গে রাতে ঘুরে বেড়ানো কিংবা নিজের ব্যক্তিগত ছবি অন্যের সঙ্গে শেয়ার করার সময়ও চিন্তা খুব কমই আসে। তারপরও শহরের ছোঁয়া গ্রামে লাগাতে এখন গ্রামেও বিচ্ছিন্নভাবে অনেক ঘটনাই ঘটছে। কিন্তু এর সংখ্যা খুবই নগণ্য।
বিষয়গুলো বলে হয় তো বোঝানো যাবে না। তারপরও সুস্থ বিবেকবান লোক মাত্রই একটু নজর বুলালে সহজেই শহর আর গ্রামের তফাতটুকু বুঝতে সক্ষম হবেন। আজ আমরা অনেকেই এই বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তিত। সন্তানের ভবিষ্যৎ, পারিবারিক শান্তি, বন্ধন ঠিক রাখার জন্য অনেকেই সভা-সেমিনারে বিভিন্ন বক্তব্য দেন, টকশো কিংবা পত্রিকায় পাতায় কত লেখাই চোখে পড়ে। এদের অনেকেই উপরোক্ত কারণগুলো দ্বারা আক্রান্ত। হয়তো বাস্তবতা ও অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছেন এ সমস্যা। তাই প্রতিকারের কথা বলছেন। কিন্তু শুরুতেই যদি বিষয়গুলোর সুষ্ঠু সমাধান করা যায়, তবে হয়তো অনাকাক্সিক্ষত ভবিষ্যতের দিকে আমাদের আর এগোতে হবে না।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
"