নাফিসা তাবাস্‌সুম

  ২৮ জুন, ২০১৮

বিশ্লেষণ

অপরাধ বিজ্ঞানের চোখে

আশঙ্কাজনক হারে দেশে বেড়ে চলেছে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা। এরই মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ। হবিগঞ্জের কিশোরী বিউটিকে দীর্ঘ এক মাস আটক রেখে ধর্ষণ করে বাবুল নামের এক উত্ত্যক্তকারী। অবশেষে ভাগ্যের পরিহাসে সেই কিশোরী খুন হয় নিজেরই বাবার পরিকল্পনায়। পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মতো বাংলাদেশেও এখন অনার কিলিংয়ের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটছে। অন্যদিকে, গাজীপুরের শ্রীপুরে এক বাবা তার মেয়ের নির্যাতনের সুবিচার না পেয়ে মেয়েকে নিয়েই জীবন বিসর্জন দেয় রেললাইনে। এ ঘটনাগুলোর নেপথ্যে আছে ধর্ষণ। খবরের কাগজ কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো এখন সয়লাব হয়ে থাকে শত শত তনু, বিউটি আর পূজাদের অব্যক্ত আর্তনাদে। পাঁচ মাসের শিশু কিংবা আশি বছরের বৃদ্ধা কেউই আজকের সমাজে নিরাপদ নয়। পূজার ঘটনা অন্তত তেমনটাই বলে।

ধর্ষণ বর্তমানে একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষ করা যায়, ভিকটিম কোনো না কোনোভাবে ধর্ষকের পূর্বপরিচিত থাকে। বিশেষ করে, গ্রামাঞ্চলের নারী ও শিশুরা আশপাশের লোকজন দ্বারা ভিকটিম হয় বেশি, আবার শহরের দিকে ‘ডেট রেপ’-এর হারও বেশি। একজন ধর্ষক পুরুষ কেবল তার বিকৃত মনমানসিকতার পরিচয়ই বহন করে। ভিকটিমের শারীরিক ক্ষত হয়তো মুছে যায় কিন্তু মানসিক যন্ত্রণা আর কিছু বীভৎস স্মৃতিকে বয়ে বেড়াতে হয় সারাজীবন। আজকের সমসাময়িক সময়েও ধর্ষণকারীর চেয়ে ধর্ষিতাকেই সন্দেহের চেখে দেখা হয় বেশি। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ভিকটিম Post Traumatic Stress Disorder-এ ভোগে। হতাশাগ্রস্ত হয়ে অনেকে সুইসাইড করে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান মতে, ২০১৭ সালে দেশে ৮১৮ জন নারী ধর্ষিত হয়, ৪৭ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় এবং ১১ জন সুইসাইড করে। ২০১৮ সালের প্রথম তিন মাসেই ধর্ষণের শিকার হয় ১৮৭ জন, ১৯ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় এবং সুইসাইড করে দুজন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যথাক্রমে ৫৮, ৬২, ৭১ ও ৬৭টি। অন্যদিকে, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, চলতি বছরের প্রথম চার মাসেই ১৩৮টি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।

আমেরিকার অপরাধ বিজ্ঞানী শেফার বলেছেন, একজন ধর্ষক যে কারণেই নারীকে ধর্ষণ করুক না কেন, ধর্ষিতা সারাজীবন মনে করেন তিনি মানুষ নন, তিনি এমন একজন যে কি-না আত্মমর্যাদাহীন, অস্তিত্বহীন, অনুভূতিহীন, সম্মানহীন কেউ। অন্যদিকে রেডিকেল তাত্ত্বিকরা ধর্ষণকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটি বিস্তৃত ক্ষমতা প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেন। একদিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, অন্যদিকে নারীদের মার্জিনালাইজ্ড অবস্থান ধর্ষণকে যেন আরো ত্বরান্বিত করছে। অর্থাৎ নারীরা প্রথমত ভিকটিম হচ্ছে সমাজে তাদের প্রান্তিক অবস্থার কারণে। দ্বিতীয়ত, ধর্ষণের ব্যাপকতার আরেকটি কারণ হতে পারে মোরালিটির অভাব। যে ব্যক্তি সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে তার পক্ষে এমন ঘৃণ্য বিকৃত অপরাধ করা সম্ভব নয়। একইভাবে নৈতিক শিক্ষার অভাব তৈরি হচ্ছে ছোটবেলা থেকেই। তৃতীয়ত, শিশুরা ভিকটিম হয় কারণ তাদের প্রতিরোধ বা বাধা দেওয়ার ক্ষমতা থাকে না। জীবনের মানে বুঝে ওঠার আগেই তাদের বীভৎস অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়।

দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ৩৭৬ নম্বর ধারায় ধর্ষণের শাস্তির কথা উল্লেখ আছে। অপরাধের প্রকৃতি অনুযায়ী ধর্ষককে যাবজ্জীবন কারাদ-, ১০ বছরের কারাদ- ও জরিমানা দেওয়া হয়। ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০’-এর ৯ নম্বর ধারায় ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদ-ের কথা বলা আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আইন থাকলেও আইনের কার্যকারিতা নেই বললেই চলে, যার ভয়াবহতা আমরা দেখতেই পাচ্ছি। আবার ভিকটিম যখন আইনি ব্যবস্থা নিতে যায়, বারবার তাকে অসংলগ্ন প্রশ্নের মাধ্যমে হেয় করা হয়। তবে আশার কথা হচ্ছে, ১২ এপ্রিল হাইকোর্ট ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং রায় দেয় যে, আইনজীবীরা যেন ভিকটিমকে কোনো ধরনের অমর্যাদাকর প্রশ্ন না করেন। এ ছাড়া ধর্ষণ মামলায় ডিএনএ টেস্ট বাধ্যতামূলক করে ১৮টি নীতিমালা প্রণয়ন করেন হাইকোর্ট, যার ফলে মিথ্যা মামলা বন্ধ হবে এবং প্রকৃত ভিকটিমরা উপকৃত হবেন। কিশোরগঞ্জের চার বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যার দায়ে শাহআলম নামে এক যুবককে মৃত্যুদ-াদেশ দিয়েছেন আদালত। সাম্প্রতিক এই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিগুলোকে সামনে আনা জরুরি যাতে অপরাধীরা বিচারব্যবস্থার কঠোরতা ও প্রয়োগ সম্পর্কে জানতে পারে। কিছুদিন আগে রাজধানীর তুরাগ পরিবহনে ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীর শ্লীলতাহানির অভিযোগে উত্তরা ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টরা প্রতিবাদের আওয়াজ তোলে এবং অভিযুক্তরা গ্রেফতার হয়। আমাদেরও একইভাবে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতনতা তৈরি করতে হবে নিজের ঘর থেকে, সামাজিকীকরণের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, নৈতিক অবরোধ তৈরি করতে হবে। ভিকটিম ব্লেমিং বন্ধ করে বিচারব্যবস্থার সুষ্ঠু প্রয়োগ এবং ‘ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার’-এর সেবা নিশ্চিত করতে হবে। দেশে একসময় অ্যাসিড ভিকটিমের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেলে সরকার কঠোর হস্তে তা নিয়ন্ত্রণ করে। বর্তমান সমাজে ধর্ষণ যে মহামারীর রূপ নিয়েছে, তা নির্মূল করতে সরকারের জিরো টলারেন্স পলিসি অনুসরণ করা উচিত। ধর্ষণ যে একটা সিরিয়াস অফেন্স এ বোধটা সবার মধ্যে তৈরি করতে হবে। আইনের কঠোর অনুশাসন মেনে, ধর্ষিতাকে তার প্রাপ্য সম্মান দিয়ে পচে যাওয়া সমাজটাকে আবার নতুন করে মূল্যবোধপূর্ণ, পরিচ্ছন্ন সমাজ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পরিচিত একটি বাক্য দিয়ে লেখা শেষ করতে চাই, যার বাস্তবায়ন খুবই দরকার ‘ধর্ষিতাকে নয়, ধর্ষণকে ঘৃণা করুন’।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist