মোহাম্মদ আবু নোমান

  ২৭ জুন, ২০১৮

বিশ্লেষণ

প্লাস্টিকের ইলিশ খুঁজুন

বড় সন্তানরা সবকিছু বুঝেও বাবার কাছে কোনো আবদার করলে, বাবা কষ্ট পাবেন। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অবুঝ শিশুসন্তানরা! ঈদসহ যেকোনো উৎসব তাদের জন্য কতটা বিভীষিকাময়। ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে একবুক হতাশাসহ দিন কাটাতে হয়েছে এবং হচ্ছে। ভাবা যায়! কেমন আছেন ওরা? কীভাবে চলছেন? আমি নন-এমপিও শিক্ষকদের কথা বলছি।

চাল, আটা, আলু, পেঁয়াজ, তরকারি বা তেলের দোকানে এ পরিচয় দিলে চলবে না, ‘আমি নন-এমপিও শিক্ষক’। দোকানির কাছ থেকে কিনতে হলে এমপিওভুক্ত ও সরকারি চাকরিওয়ালাদের সঙ্গে একই দামে পণ্য সংগ্রহ করতে হবে। পকেটের কথা চিন্তা করে দরদাম করতে গেলে বে-ইজ্জতি হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। নন এমপিওভুক্ত এক শিক্ষকের দুঃখের কথা জানিয়েছেন এভাবে, ছোট ইলিশের দাম করতে গেলে পাতিলওয়ালা ইলিশ বিক্রেতা ধমকের স্বরে জানিয়েছেন, ‘এত দরদাম না করে প্লাস্টিকের ইলিশ খুঁজুন’। বাস্তবতা বলছে, ‘নন-এমপিও শিক্ষক পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য মাছ, মাংসের জোগানÑসে তো অলীক স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়।’

সম্প্রতি বিভিন্ন পর্যায়ে রাষ্ট্রের বেতন ও সুবিধভোগীরা যখন ঈদ উৎসবের কেনাকাটায় ব্যস্ত, তখন এসব নন-এমপিও শিক্ষকরা বেতনের দাবিতে রোদ, বৃষ্টি, ঝড় উপেক্ষা করে খোলা আকাশের নিচে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছেন। অনেক নারী শিক্ষক ছোট সন্তানকে বাড়িতে রেখে, কেউ আবার সঙ্গে নিয়েই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম গত ২৪ জুন জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তরে বলেছেন, বর্তমান সরকারের মেয়াদে প্রশাসনে ৬ লাখ ১৩ হাজার ১৫৫টি পদ সৃজন করা হয়েছে। আরো ৫২ হাজার ৭৯টি পদ সৃজনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ ছাড়া দাবি না থাকা, না চাওয়া সত্ত্বেও অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সরকার জাতীয়করণ করছে। অথচ নন-এমপিওদের বারবার ওয়াদা দিয়েও এমপিওভুক্ত করা হয়নি। এই শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার সামর্থ্য সরকারের নেইÑএ কথা কোনোভাবেই মানা সম্ভব নয়। দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়া না-হওয়া অনেকটা রাজনৈতিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত থাকেন, ভালো ফল না করা সত্ত্বেও সেগুলো দ্রুত এমপিওভুক্ত হয়। আবার তদবিরের জোর না থাকায় ভালো ফল করেও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হতে পারেনি। শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে সরকারের নীতি স্পষ্টই স্ববিরোধী, একপেশে ও বৈষম্যমূলক।

বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধির বিষয়ে এক প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘সরকারি কর্মচারীরা এখন যেসব সুবিধা ভোগ করছেন, তারা জীবনে কখনো এমন সুযোগ-সুবিধা পাননি। তাদের বেতন ৪০ হাজার টাকা থেকে এক লাফে ৮২ হাজার টাকা হয়েছে। তাদের পেনশনে বার্ষিক ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়েছে...। আমার মনে হয় তাদের আর দাবি নেই।’ প্রস্তাবিত বাজেট আবার সহজশর্তে গৃহঋণ সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া ফি বছর বেতন বৃদ্ধি, বৈশাখী ভাতা, ঈদ বোনাস, মোবাইল কেনায় বরাদ্দ, গাড়ি কেনার সহজ সুবিধা, অবসর ভাতা, স্বামী মারা গেলে স্ত্রীর আর্থিক সুবিধা লাভসহ ষোলআনায় ভরপুর সরকারি চাকরিজীবীরা।

নতুন অর্থবছরে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হবে। তীর্থের কাকের মতো দীর্ঘ কষ্টের অপেক্ষার একদিন হয়তো অবসান হবে, এ আসায় ছিলেন শিক্ষকরা। কিন্তু ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে নতুন এমপিওভুক্তির বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু না থাকায় ভেঙে পড়েন শিক্ষকরা। আন্দোলনকারী শিক্ষকরা বলেছেন, ‘আমরা বেতন-ভাতার জন্য পরিবার ছেড়ে রাজপথে নেমেছি। ঈদের দিনেও পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারিনি, একটু মিষ্টি মুখে দেওয়ারও ভাগ্য হয়নি। শিক্ষকতা করে কী আমরা অপরাধ করেছি...? বরিশালের জল্লা ইউনিয়ন আইডিয়াল কলেজের ইতিহাসের প্রভাষক অরুণ কুমার বিশ্বাস বলেছেন, ‘১৮ বছর ধরে আমি শিক্ষকতা করছি। টিউশনি করে চলতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স করে শিক্ষকতা পেশায় এসে মানবেতর জীবনযাপন করছি। বিয়ে পর্যন্ত করতে পারিনি। বর্তমানে ছোট বোনের বিয়ের খরচ জোগাতে পারছি না। শিক্ষকতা পেশায় এসে কি তাহলে ভুল করেছি...?’

বর্তমানে সারা দেশে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে ৫ হাজার ২৪২টি। এগুলোতে শিক্ষক-কর্মচারী আছেন ৭৫ থেকে ৮০ হাজার। এমপিওভুক্ত না হওয়ায় এসব শিক্ষক ন্যূনতম বেতন-ভাতা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শিক্ষাদানের মতো মহৎ পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য এমন পরিস্থিতি লজ্জাজনক, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। শিক্ষকরা না বাঁচলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা শিক্ষা, কোনোটিই রক্ষা করা যাবে না। শিক্ষকসমাজকে পেছনে রেখে রাষ্ট্র কখনোই এগিয়ে যেতে পারবে না। এতে রাষ্ট্রেরই ক্ষতি হচ্ছে। এ ক্ষতি থেকেও দেশকে রক্ষা করাটাই এখন সময়ের দাবি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist