মোবারক হোসেন

  ২৭ জুন, ২০১৮

মাছ

জাতীয় জীবনে সংস্কৃতির অঙ্গ

‘মাছে-ভাতে বাঙালি’Ñতিন শব্দের এই প্রবাদ গ্রামবাংলার মানুষের জীবনে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। নদী-খাল-বিল-পুকুর, দেশের উজানে থেকে ভাটি পর্যন্ত সবখানে সব জলাভূমিতেÑনানা প্রজাতির মাছ প্রাকৃতিকভাবে জীবন-চক্রে আবর্তিত হচ্ছে। আর এ মাছ সেই আবহমানকাল থেকে আমাদের জাতীয় জীবনে সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে মিশে আছে। গ্রামবাংলায় পুকুরে মাছ চাষ করা, আবার সেই মাছ জাল চালিয়ে শিকার করা শুধু যে আনন্দের, তা কিন্তু নয়; পুষ্টির বিচারে যেমন স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়, তেমনই স্বাদের বিচারেও উপভোগ্য।

একটি জাতীয় দৈনিকে মৎস্যসম্পদ নিয়ে খবর ছাপা হয়। খবরে বলা হয়, দেশে শ-খানেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হতে চলেছে। হুমকিতে রয়েছে আরো ৫৪ প্রজাতির দেশি মাছ। আর ২৮ প্রজাতির মাছ বিপন্ন বলে চিহ্নিত করেছে মৎস্য অধিদফতর।

এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে আমাদের জাতীয় জীবনে পুষ্টির আধার সংস্কৃতির অংশ এই মাছ কি বিলুপ্তির পথে চলে যাবে? আর এর জন্য কি কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে না? এমন শঙ্কা এখন অনেকের মধ্যে দোদুল্যমান।

অবশ্য শঙ্কার পাশাপাশি শুভবার্তাও আছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট বিলুপ্ত প্রায় সব মাছকেই ফিরিয়ে আনতে গবেষণা করছে। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ৪৭টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে এবং ১৭ প্রজাতির মাছকে এর মধ্যে বিলুপ্তির পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছে।

মাছ নিয়ে কত স্মৃতিই তো মনে পড়ে, বছরান্তে প্রখর চৈত্রে পানি কমে যাওয়া বিলে যখন মাছ ধরার উৎসব শুরু হয়, তখন ওই অঞ্চলের লাখো মানুষ একসঙ্গে বিলজুড়ে উৎসব করে। পলোসহ বিভিন্ন মাছ ধরার সামগ্রী দিয়ে মাছ শিকারের আনন্দে মেতে ওঠে। এই যে সামাজিক মেলবন্ধনের আনন্দÑএ আনন্দ আর কোনোভাবে পাওয়া সম্ভব কি না, জানা নেই। তবে মাছ খাওয়ার চেয়ে ধরার যে কী আনন্দÑএটা বলে বোঝানোর নয়। যাদের জীবন-বাস্তবতা মাছ ধরার এ উৎসবকে ছুঁয়ে গেছে, তারাই বলতে পারবেন এই অনুভূতির গভীরতার শেষ তলাতল কোথায়?

কথা এখানেই শেষ নয়, যারা গ্রাম্যজীবনে বিল বা পুকুর পাড়ে গাছের ছায়ায় বসে ভরদুপুরে মাছ ধরায় প্রহর গুনেছেন, ছিপ ফেলে অপলক দৃষ্টি দিয়ে ওত পেতে রয়েছেনÑকখন প্রত্যাশার মাছটি বড়শির টোপ গিলে সুতায় টান মারে, আর ছিপের হুইল ঘোর কাটানো কড়কড় শব্দ করেÑএ প্রতীক্ষার প্রহর যতই লম্বা হোক না কেনÑএই ক্ষণ গণনা বিরক্তির কিছু নয়; তাই জীবিকার তাগিদে শহরবাসী হলেও অনেককে ফেলে আসা স্মৃতি বারবার টেনে নিয়ে যেতে চাই গ্রাম্যজীবনের হারানো শৈশবে।

যাক সে কথা, এখন আর বারো মাস সব খাল, পুকুর, জলাশয় পানিতে ভরপুর থাকে না। ফলে দেশি মাছের প্রাকৃতিক উৎসে আস্তে-ধীরে টান লেগেছে। এ কারণে বিলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে আমাদের অমৃত স্বাদের দেশি মাছ।

মৎস্য অধিদফতরের অধীনে দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় মৎস্য অফিস আছে। এসব অফিসের তত্ত্বাবধানে এলাকার সরকারি পুকুর, জলাশয়, খাল ও বিলে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে প্রতি বছরই মাছ চাষ করা হয়। এর মধ্যে দেশি প্রজাতির ছোট মাছ সংরক্ষণ, প্রজনন ও বংশ বৃদ্ধির জন্য ৩৮টি জেলার ৭৫টি উপজেলার ১৩৬ প্রাকৃতিক জলাশয় পুনঃখনন করা হয়েছে। এসব জলাশয়ে ১৫৪ টন পোনা অবমুক্ত করা হয়েছে। ৫৭টি সরকারি মৎস্য খামারে দেশি প্রজাতির ছোট মাছের কৃত্রিম প্রজননের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসবই মৎস্য উন্নয়নে সুবিস্তৃত্ব পরিকল্পনার অংশ।

শুধু তাই নয়, উৎপাদিত পোনা মাছ ব্যবস্থাপনার জন্য এ পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ৬ হাজার ৪৬৬ জন চাষিকে। সেই সঙ্গে দেশি প্রজাতির মাছ রক্ষায় গত পাঁচ বছরে সারা দেশে বিভিন্ন নদী ও মুক্ত জলাশয়ে ৫৫৪টি মৎস্য অভয়াশ্রম তৈরি করা হয়েছে। যেন দেশি প্রজাতির মাছ মৎস্যজীবীদের নির্বিচার শিকারে বিলুপ্ত হয়ে না যায়।

এই সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসা পাওয়ার অধিকারী। দেশি মাছ রক্ষায় এমন সুচিন্তিত পরিকল্পনা বিপন্ন মৎস্য প্রজাতিকে রক্ষা করবে। অন্যদিকে চাহিদার বিপরীতে মৎস্যসম্পদ নিয়ে বর্ধিত চিন্তার প্রসারিত ক্ষেত্র তৈরি হবেÑসেটা হতে পারে রফতানির মতো বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের পথ।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য মতে, মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের চতুর্থ। ২০২২ সালের মধ্যে প্রথম স্থানে অধিকার করবে বাংলাদেশ। এটাও দেশের জন্য বড় সুসংবাদ। যখন বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে যাচ্ছিল, তখন বিলুপ্তি হতে রক্ষা করা, মৎস্য চাষে স্বয়ংসম্পন্নতা আনাÑঅনেক বড় বিষয়। বলা যায়, এটা সুষ্ঠু পরিকল্পনারই বৃহত্তর অংশ। সংবাদভাষ্য মতে, গত ১০ বছরে মাছের উৎপাদন ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। আর রফতানি বেড়েছে ১৫০ গুণ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মধ্যে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা নিবারণ করে মাছ উদ্বৃত্ত করতে পারবে। আর ওই উদ্বৃত্ত অংশ বিশ্ববাজারে রফতানি করতে পারবে।

অমিত সম্ভাবনার এই বাংলাদেশ। সংকট থেকে বেরিয়ে রফতানিমুখী হওয়া ছোটখাটো কোনো বিষয় নয়, বরং বলতে হবে চ্যালেঞ্জেরই অংশ। আর এই গর্বের অংশীদার আমাদের গবেষণা কর্মকর্তাসহ এ খাতের সংশ্লিষ্টরা।

যখন মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ে দেশি মাছ বিলুপ্তির পথে, তখন দেশে ধীরে ধীরে মৎস্য সংকট প্রকট হচ্ছিল। সেই আশির দশকের সংকটময় সময়ে তখন উন্নতজাতের পাঙ্গাশ, রুই, কাতলা, তেলাপিয়া চাষ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। আর এই উদ্ভাবনে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা রাখেন। আর এখন পাবদা, শিং, সরপুঁটিসহ আরো অনেক রকম মাছের উচ্চমাত্রার উৎপাদন বহরে যুক্ত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যক্তি উদ্যোগে পুকুর খনন করে মৎস্য খামার তৈরি শুরু হয়েছে অনেক আগে। কোনো কোনো এলাকায় মৎস্য চাষ শিল্পে রূপ নিয়েছে। সেসব শিল্প-খামারে চাষ করা হচ্ছে নানা জাতের মাছ। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ছোট-বড় ট্রাকযোগে দেশের নগর-বন্দর, হাট-বাজারে চলে যাচ্ছে এসব মাছ। বলা যায়, চাহিদার সিংহভাগ এখন খামারিদের চাষ করা মাছ দিয়ে পূরণ হচ্ছে।

আমাদের পরম সুভাগ্য, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ মিঠাপানির মাছ চাষে পৃথিবীর সবচেয়ে উপযুক্ত অঞ্চল। উন্মুক্ত জলাশয়ে মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ রয়েছে চতুর্থ স্থানে; আর অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মাছ চাষে এ অবস্থান পঞ্চম স্থানে।

ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে সাফল্য অর্জন করবে, তার শীর্ষে থাকবে বাংলাদেশের নাম। এরপরই থাকবে থাইল্যান্ড, ভারত, চীন ও মিয়ানমারের নাম। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে আমাদের দেশের অবস্থান। একই বলয়ের দেশ হিসেবে ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার আবহাওয়াগত কারণে মৎস্য চাষের উপযোগী। আর এরই মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্থানে সম্ভাবনাময়ী বাংলাদেশ। বিষয়টি একেবারে অবহেলা করার নয়।

ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার একই জলবায়ুর পরিধিতেÑএকই সম্ভাবনার সরলরেখায় দাঁড়িয়ে। জাতিসংঘের মৎস্যসম্পদের রূপরেখায় দেশগুলো বিশ্বের মধ্যে শীর্ষ তালিকায়। উজান থেকে বয়ে আসা প্রাকৃতিক পানি প্রবাহকে কোনো ধরনের কৃত্রিমতায় রুদ্ধ না করে অবাধপ্রবাহ নিশ্চিত করা জরুরি। তাহলে মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে এ অঞ্চলের দেশগুলো আরো অগ্রসর হতে পারবে। এ অঞ্চলের সরকারগুলোকে আঞ্চলিক স্বার্থে চিন্তাভাবনায় এক হয়ে এগিয়ে আসা দরকার। তাহলে আমরা মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে আরো সুনাম অর্জন করতে পারব।

বিশ্ববাণিজ্যে সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে আমাদের মৎস্যসম্পদ দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। এ জন্য সবাইকে সচেতনভাবে আরো উদ্যোগী হওয়া দরকার। এখন আমাদের ভাবতে হবেÑকী করে মৎস্য চাষের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির ফল আরো বেশি ঘরে তোলা যায়।

বিগত সময়ে মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনায় চক্রাকারে যে সংকট তৈরি হয়েছিল, আমাদের গবেষকরা তার উত্তরণ ঘটিয়ে চলেছেন। সরকারের মৎস্য অধিদফতর ঠিক সময় যথাযথ পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে চলেছে, এর ফলে আরেকটি সম্ভাবনার খাত মৎস্যÑদেশের দুয়ারে দিচ্ছে আগামীর হাতছানিÑএ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। এখন সরকারকে সুনজর দিতে হবে যেন ২০২২ সালের লক্ষ্যমাত্রা সফল হয়। আমরা যেন বিশে^র মধ্যে মিঠাপানির মৎস্য উৎপাদনে উচ্চ শিখরে আরোহণ করে শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে পারিÑএ দীর্ঘ লালিত প্রত্যাশা আমাদের সবার।

লেখক : অর্থনীতি ও মিডিয়া বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist