এস এম মুকুল

  ২৬ জুন, ২০১৮

অন্য চোখে

আমরাই গড়ব সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ

বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনে দেশের শিক্ষিত ও বেকার তরুণ-তরুণীরা এগিয়ে এসেছেন। আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকায় তারা বড় আকারের শিল্প না গড়ে প্রথমে ক্ষুদ্র আকারের শিল্প গড়ে তুলেছেন। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের পুঁজি সরবরাহ করছে। এনজিওসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও এসব ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। সরকার ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্পের খাতগুলো চিহ্নিত করে সেখানে পুঁজি ও পণ্যের বাজারজাতকরণের সুবিধা দিলে বাংলাদেশের বর্তমান তরুণ-তরুণীরা এ ব্যাপারে এগিয়ে আসবে। বাংলাদেশে যেসব সম্পদ রয়েছে, তার যথাযথ ব্যবহার ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলেই দেখা দেবে আশাজাগানিয়া সম্ভাবনা। আমাদের সম্ভাবনার ক্ষেত্র অনেক। অনেক ক্ষেত্রে দেশের মানুষ স্ব-প্রণোদিত হয়ে সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বারবার এ দেশের জনগণ প্রমাণ করেছে, নিজের চেষ্টা, শ্রম আর মেধা দিয়ে আমরা জয় করতে পারি অসাধ্যকেও। আমরা প্রত্যয়ী জাতি। আমরা সম্ভাবনার স্বপ্নকে নিয়ে যেতে পারি সমৃদ্ধির পথে। বিশ্বের অর্থনীতি বিশারদরাও বলছেন বাংলাদেশ-পরবর্তী ভারত বা চায়না হতে পারে। এ জন্য দেশের শিল্প উদ্যোক্তাদের যথাযথ ব্র্যান্ডিং কৌশল নিতে হবে। বিশেষ করে টেক্সটাইল ও ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে প্রচুর সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে। সম্ভাবনা আইটি শিল্প খাতেও রয়েছে।

আমরা জানি, চীন একটি অমিত সম্ভাবনার দেশ। সত্তর দশক থেকে চায়নারা কৃষি, শিল্প, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা এ চারটি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে। এটাই চায়না শিল্প বিপ্লবের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করেন বিশ্লেষকরা। আশির দশক থেকে চীনে ছোট ছোট ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দিলে বাজার অর্থনীতির দ্রুত প্রসার ঘটে। চীন তার বাজার উš§ুক্ত করে দেয় বিদেশি পুঁজি ও টেকনোলজির জন্য। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বিশেষ কিছু শিল্প এলাকা তৈরি করে দিলে লাখ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, যা চীনকে একটি কৃষিনির্ভর রাষ্ট্র থেকে শিল্পনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত করে। কম দাম, গ্রহণযোগ্য মান, প্যাকিং ও পণ্যের বৈচিত্র্যে চীন এখন একচেটিয়া ব্যবসায়িক প্রাধান্য বিস্তার করেছে। বলা হচ্ছে, ২০২০ সালের মধ্যে চীনে তৈরি হবে লাখো লাখো মাল্টি মিলিয়নিয়ার। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে চীন বিশ্বের ৩০ শতাংশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করবে। যদিও বিশ্বের পণ্যবাজারে চীনের বিস্তৃতি এখন ‘ফুটওয়্যার থেকে আন্ডারওয়্যার এবং হার্ডওয়্যার থেকে সফটওয়্যার পর্যন্ত।’ তাই বিপুল বেগে বিকাশমান অর্থনীতির বিশালতায় চীনকে প্রায়ই দৈত্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়। উৎপাদননীতির থিওরি হচ্ছে দারিদ্র্য দূর করার উপায় হলো ভালো জিনিস সস্তায় উৎপাদন করে বিক্রয় করা। চায়নারা সেটা করে দেখাতে পেরেছে। অথচ আমরা ঢাকার কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরাকে শিল্প এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে পারছি না। জিঞ্জিরা দুই নম্বর বা নকল জিনিস তৈরির এলাকা হিসেবে পরিচিত। প্রশ্ন হলো, যারা নিজেদের চেষ্টায় বিদেশি ব্র্যান্ডের নকল পণ্য তৈরি করতে পারছে তাদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে কেন উন্নতমানের দেশীয় পণ্য তৈরির কাজে লাগানো যাচ্ছে না? ধোলাইখালের অশিক্ষিত শ্রমিকরা যদি বিদেশি গাড়ির মেশিনারিজ পার্টস তৈরি করতে পারে, তাহলে তাদের কেন প্রশিক্ষিত করে ধোলাইখালকে শিল্প এলাকায় পরিণত করা যাচ্ছে না? সরকার প্রণোদনা দিলে এসব ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসবেন। তা ছাড়া দেশের অনেক ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শিল্প পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ধ্বংস হতে যাচ্ছে। সরকার না পারলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের তো উৎসাহিত করতে পারে। এভাবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কুটিরশিল্পগুলোকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিলে দেশের মানুষ বহুমুখী কর্মযজ্ঞে সচল রাখবে দেশের অর্থনীতির চাকা। গ্রামের জিনিস শহরে আসবে-যাবে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে। সমৃদ্ধ হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি। পরিকল্পিতভাবে সুযোগগুলোকে কাজে লাগালে চীনকে ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ।

বিভিন্ন বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সিঙ্গাপুরের চেয়ে বাংলাদেশের ধনী দেশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আশপাশের দেশগুলোকে যোগাযোগ রক্ষা করতে হলে বাংলাদেশকে মাধ্যম হিসেবে নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আমরা জানি, পঞ্চাশ বছর আগেও সিঙ্গাপুর ছিল একটি হতদরিদ্র দেশ। সে সময় সিঙ্গাপুরকে ‘কলোনি অব কুলিজ’ বলে উপহাস করত। সিঙ্গাপুরের মোট আয়তন মাত্র ৬১৬ বর্গকিলোমিটার। সিঙ্গাপুরে রয়েছে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বসবাস। কিন্তু গত প্রায় পঞ্চাশ বছরেও সিঙ্গাপুরে জাতিগত বা ধর্মীয় কোনো দাঙ্গা হয়নি। সামান্যতম উসকানিও সেখানে কঠোরভাবে দমন করা হয়। আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের জন্য শুধু একটি গুদামঘর হিসেবে পরিচিত ছোট্ট সীমানা সিঙ্গাপুরই কালপরিক্রমায় মাথাপিছু আয় ৩০ হাজার মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান নিজের লেখা বইতে বলেছেন, মালয়েশিয়া যখন সিঙ্গাপুরকে পৃথক করে দিল, তখন মনে হলো ‘ইট বিকাম এ হার্ট উইদাউট বডি’। কিন্তু সেই অনিশ্চিত সিঙ্গাপুর দরিদ্র থেকে কত ওপরে উঠে এসেছে, তা রীতিমতো অভাবনীয়। ভাবা যায়? এখন দুনিয়াতে ‘সিটি স্টেট’ বলতে সিঙ্গাপুরকেই বোঝায়। সিঙ্গাপুরের এমন ঈর্ষণীয় সাফল্যের মূলে রয়েছে ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে দুনিয়াজুড়ে ব্যাপক পরিচিতি। প্রতি বছর এখানে কয়েক শ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য হয়। এই সাফল্যের নেপথ্যে আরো একটি কারণ, সিঙ্গাপুরের জনগণ কথার চেয়ে কাজে বেশি বিশ্বাসী। তারা মালিক-শ্রমিক বিরোধ বাধতে দেয় না। আগেই ঝামেলা মিটিয়ে ফেলে। সিঙ্গাপুরের লোকসংখ্যার তুলনায় শিল্প-কারখানার সংখ্যাও খুব বেশি নেই। বলা যায়, সিঙ্গাপুরের সমৃদ্ধির নেপথ্য মূলত বন্দরকে কেন্দ্র করেই। আমাদের বাংলাদেশেরও সমুদ্র বন্দর আছে। আমরা চাইলে এই বন্দরগুলোকে বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। আর সত্যিই যদি তা পারা যায় তাহলে সিঙ্গাপুরের চেয়ে বাংলাদেশের ধনী রাষ্ট্র হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।

কিন্তু সম্ভাবনার বাংলাদেশ নিয়ে আমরা কী ভাবছি? বাস্তবিক পক্ষে আমাদের দেশের অর্থনীতিতে যে পরিমাণ অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় হয়, বিনিয়োগের পরিমাণ সে হারকেও ছুঁতে পারেনি। দেশের মানুষের সাধারণ সঞ্চয়কে কোনো সরকারই কাজে লাগাতে পারছে না। সাধারণ মানুষের সঞ্চয় বিনিয়োগের অন্যতম মাধ্যম এখনো সামাজিক উদ্যোগ। এসব সামাজিক উদ্যোগকে পৃষ্ঠপোষকতা দিলে পাল্টে যাবে দেশের চেহারা। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আমাদের দেশীয় শিল্প বিকাশনীতি বাস্তবায়িত হলে উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শিল্প উদ্যোগ একটি সামাজিক, ব্যক্তিক, রাষ্ট্রিক ও মনস্তাত্বিক বোধ পরিবর্তনের আন্দোলন। শুধু কৃষিনির্ভর দেশ পৃথিবীতে অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া অসম্ভব। কাজেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিল্প বিকাশ নীতিকে অগ্রাধিকারের মানসিকতায় নিয়ে আসার বিকল্প নেই। কেননা, শিল্পকে বিকশিত হতে না দিলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বন্ধ হবে। ফলে সরকারের ওপর কর্মসংস্থান সৃষ্টির চাপ বাড়বে। বাড়বে মাদকতা, ছিনতাই, অপহরণ, জঙ্গিবাদ, খুনসহ বহুবিধ অপরাধ। আর এসবের দায় অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা হিসেবে সরকারের ওপর পড়বে। এসব কারণে বাংলাদেশে কোনো সরকার একটানা ক্ষমতায় থাকতে পারে না। বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে যেকোনো সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের সফল বাস্তবায়ন ১২-১৫ বছরের নিচে সম্ভব নয়। আমাদের দেশে সরকারের ধারাবাহিকতা থাকলে সামগ্রিকভাবে সব উন্নয়নের সুফল দেশের সব মানুষের কাছে পৌঁছাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন, ঢাকার বাইরে শিল্প স্থাপন করলেই বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে। এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। ঢাকার বাইরে শিল্প গড়ে উঠলে রাজধানীর ওপর চাপ কমবে। খবরে প্রকাশ, আমাদের দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে। জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্পের (ইউএনডিপি) তথ্য মতে, স্বাধীনতার পর চার দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ জিডিপির আকারের প্রায় ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ। প্রথমত অর্থ কেন পাচার হয় সে কারণটি আগে খুঁজে বের করতে হবে এবং তারপর পাচারের পথ বন্ধ করতে হবে।

আরেকটি বিষয় ভাবতে হবে, কালো টাকা বলে যে টাকাকে দেশের মাটিতে সহজে বিনিয়োগ করতে দেওয়া হচ্ছে না, মূলত সে টাকাই পাচার হয়ে মালয়েশিয়া, লন্ডন, আমেরিকা আর সিঙ্গাপুরে বড় ধরনের বাণিজ্য গড়ে তুলছে। কথা হচ্ছে, মালয়েশিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যদি বাংলাদেশের কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ কেন ১০ বছরের জন্য বিনা বাধায় রেলওয়ে, পরিবহন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আবাসন খাতে এ অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে পারবে না? সেটাই বোধগম্য নয়। দেশ থেকে এ পর্যন্ত যে পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, তা দিয়ে বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশ থেকে ১০ বছরও লাগত না। তাহলে কালো হোক, ভালো হোক দেশের টাকা দেশের মাটিতে গড়াগড়ি খেলেও দেশ ও জনগণের লাভ। সরকারের দরকার দেশে শিল্প বিকাশে এসব টাকা অবশ্যই নির্দিষ্ট মেয়াদে সহজে বিনিয়োগের সুবিধা দেওয়া। পাশাপাশি কালো টাকা উপার্জনের পথও বন্ধ করা দরকার।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist