আতিক সিদ্দিকী

  ২৪ জুন, ২০১৮

মাদক

সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান জরুরি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০ জুন সংসদে বলেছেন ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন আরো কঠোর করতে মাদক ব্যবসার পৃষ্ঠপোষক গডফাদারসহ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ প্রণয়ন করা হচ্ছে। মাদক ব্যবসায়ীদের বিচারহীনতা এবং প্রচলিত আইন এবং সাজার ধরন ও পরিমাণ যথেষ্ট না হওয়ার কারণে দেশে মাদকদ্রব্য কেনাবেচা চলছে অবাধে। বিদ্যমান আইনে কোনো ব্যক্তির দখলে, কর্তৃত্বে বা অধিকারে মাদকদ্রব্য পাওয়া না গেলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ না থাকায় মাদক ব্যবসায় জড়িত মাস্টারমাইন্ডরা অধরা থেকে যায়। পুলিশ সদস্য ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের একাংশের সঙ্গে যোগসাজশেই মাদকের এমন রমরমা ব্যবসা চলে আসছিল অবাধে দীর্ঘদিন ধরে। অবৈধ পথে বিদেশ থেকে এসব মাদকদ্রব্য আসছে এটা নিশ্চিত বলা যায়। আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির সদস্যদের অনেকেই সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না বলেই এত অনায়াসে এ পরিমাণ মাদকদ্রব্য পাচার হয়ে আসছে। এ ছাড়া যে কখনোই সম্ভব ছিল না সে কথা কাউকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। সীমান্তপথে মাদক চোরাচালান বন্ধে এবং দেশের ভেতরে মাদকদ্রব্যের অবাধ কেনাবেচা কঠোর হাতে বন্ধ করতে স্থায়ী চিন্তা করতে হবে। আর এ জন্যে তদারকি কাজে নিয়োজিত ব্যাক্তিদের মূল্যায়ন সমীক্ষা নিয়মিত দায়িত্বের মধ্যে আনতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে বাড়াতে হবে প্রয়োজনীয় জনবল। বিজিবি, পুলিশ, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে জবাবদিহিতার আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব নিয়ন্ত্রণে আনা একান্ত জরুরি। অপ্রিয় সত্য তাদের একাংশের সহযোগিতা ছাড়া এ মাত্রায় মাদকের ব্যবসা চলা কিছুতেই সম্ভব নয়।

আমাদের দেশে বীভৎস আর পৈশাচিক হত্যা নির্যাতন দিনদিন যেন বেড়েই চলেছে। এসব হত্যা নির্যাতনের কোনো কোনোটির সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনে প্রচারিত সচিত্র প্রতিবেদন, ভিডিওি কিংবা অডিও প্রকাশ হওয়ায় এসব নৃসংশতার সাক্ষী হচ্ছি আমরা প্রতিনিয়ত। এর মধ্যে শিশু রাজন হত্যার ভিডিও, এমসি কলেজ শিক্ষার্থী খাদিজার ওপর নরপশু বদরুলের রামদার আঘাত, শিশু রবিউলের পেট ফুলে ওঠা মৃতদেহের ছবি আমরা দেখেছি এবং সর্বশেষ কক্সবাজার জেলার টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হত্যার অডিও রেকর্ড দেশবাসীকে বেদনার্ত করেছে। অমানবিক এসব ঘটনাগুলো দেখতে দেখতে আমরা পাথরে বুক বেধেছি। যেন এসব মৃত্যু বা হত্যাকান্ড আমাদের পাষাণ হৃদয়কে নাড়া দেয় না। তবে একরামুলের অডিও ক্লিপটি কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমাদের সেই পাষাণ হৃদয়কে প্রচ- ঝাঁকিয়েছে! ঘুম হারাম করে দিয়েছে দেশের কোটি মানুষের। আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইছে সামাজিকমাধ্যমেও। ঝড় উঠেছিল সরকারদলীয় এক সংসদ সদস্যেকে নিয়েও। গত ১ জুন ওই সংসদ সদস্য ওমরাহ পালনের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন। অবশ্য তার ঘনিষ্ঠজনদের বিরুদ্ধে মাদক কারবারে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। তিনি নিজে এ কারবারে জড়িত নেই বলে বারবার বলে আসছেন। ইতোমধ্যেই তিনি দেশে ফিরেছেন এবং তার নির্বাচনী এলাকা উখিয়া উপজেলায় তাকে সংবর্ধনা দিয়েছে সেখানকার নেতাকর্মীরা।

পৌর কাউন্সিলর একরামুল যখন মৃত্যুর খুব কাছাকাছি তখন তিনি তার প্রিয় সন্তানকে ফোনে বলেছেন, ‘যাচ্ছি মা’। ফোনের অপরপ্রান্তে প্রিয় বাবাকে গুলি করার শব্দ শুনছে তার মেয়ে, প্রিয়তম স্বামীর বুক ঝাঁঝরা করা বুলেটের শব্দ শুনছেন প্রিয়তমা স্ত্রী আয়শা! এ সময় একরামের মেয়ে বলেছে ‘আব্বু, তুমি কাদতেছো যে!’ স্ত্রী আহাজারি করে বলছে ‘আমার স্বামী কিচ্ছু করে নাই’ এ রকম বুকফাটা আর্তনাদ ছাড়া কিছুই সে সময় করার ছিল না তাদের। মৃত্যুর স্বাদ সবাইকে নিতে হয় কিন্তু এমন বীভৎসভাবে, এত নির্দয়ভাবে মরণ কখনোই কাম্য হতে পারে না। প্রিয়জনের এমন নির্মম মৃত্যুর সাক্ষী হতে যেন আর কারো না হতে হয় এমন কামনাই হওয়া উচিত! রাজনকে নির্যাতনের ভিডিও আমরা দেখেছি, খাদিজার ওপর নৃসংশতার ভিডিও দেখেছি, যদিও ভাগ্যগুণে তিনি বেঁচে ফিরেছেন। রবিউলের পায়ুপথে গাড়ির পাম্পার দিয়ে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মৃত্যুর পর তার পেট ফুলে ওঠা লাশের ছবি দেখেছে দেশবাসী। একরামুলের নির্যাতনের ছবি দেখেনি। কিন্তু একরামুলকে হত্যার পুরো প্রক্রিয়া দেশবাসী কান পেতে শুনেছে। নিহত একরাম টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর ও স্থানীয় যুবলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অতি গুরত্বপূর্ণ চলমান মাদকবিরোধী অভিযান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এক সংবাদ সম্মেলনে একরামুলের পরিবার দাবি করেছে, একরামুল নির্দোষ, তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ সংবাদ সম্মেলনে ঘটনার সময়কার ফোনকলের অডিও সাংবাদিকদের শুনিয়েছেন তার পরিবার। একরামুল হকের স্ত্রী আয়শা গণমাধ্যমকে বলেছেন, ঘটনার আগমুুহূর্তে তার দুই মেয়ে প্রথমে একরামুলের মোবাইল ফোনে কল করে তার সঙ্গে অল্প সময় কথা বলেছিল। এরপর মেয়েদের কথোপকথনে পরিস্থিতি খারাপ বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে আয়শা বেগম নিজে ফোন করেন। চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে মাদকসেবীদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে অনেক মানুষ নিহত হয়ছেন। এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন জানিয়েছেন, ৪ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত এই অভিযানে ১২৭ জন নিহত হয়েছেন। তবে এ সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম। শুরু থেকেই বিচার বহির্ভূত এসব হত্যাকা- নিয়ে প্রশ্ন ছিল। আজও রয়ে গেছে। সচেতন সমাজ সবসময় এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ এবং বিরোধিতা করবে এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। এ ধরণের ঘটনা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে আসছেন মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং দেশের সুশীল সমাজ। একরাম হত্যার অডিও প্রকাশের পর চলমান মাদকবিরোধী অভিযান সর্ম্পকে প্রশ্ন তুলে অবিলম্বে বিচার বহির্ভূত এসব হত্যাকান্ড বন্ধের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ছেন দেশের শীর্ষ ১০ বুদ্ধিজীবী। তারা বলেছেন, এই অভিযানে প্রতিদিন অনেক মানুষ বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছেন। যা পুলিশ বন্দুকযুদ্ধে নিহত বলে বর্ণনা করে চলেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যবস্থায় এমন মৃত্যু কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। তারা আরো বলেন, সংবিধানে প্রদত্ত জীবনের অধিকার এভাবে কেড়ে নেওয়া যায় না।

রাজন, খাদিজা বা রবিউলদের হত্যার নির্যাতনকারী ছিল সাধারণ মানুষরূপি পিশাচ। তাদের ঘটনাগুলো প্রকাশের প্রতিবাদ ক্ষোভ-বিক্ষোভ আর সমালোচানার ঝড় উঠেছিল দেশে এবং দেশের বাইরে। এসব ঘটনায় অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। যদিও সবগুলো ঘটনার বিচার এখনো শেষ হয়নি। এবার একরামুলের হত্যা ঘটনায় অভিযোগ করা হয়েছে রাষ্ট্রের একটি বিশেষ বাহিনীর ওপর। তাই বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এই ঘটনাটি দেশের গণতন্ত্রকামী সব মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। মাবাধকিারকে করেছে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশ্নবিদ্ধ করেছে চলমান মাদকবিরোধী অভিযানকেও। তবে কি একরাম ইস্যুতে মাদকবিরোধী অভিযান শৈথিল্য কিংবা বন্ধ করতে হবে? না কিছুতেই সেটা উচিত হবে না। সরকার প্রধান মাদকবিরোধী অভিযানকে সমর্থন করে যে বক্তব্য রেখেছেন সেটা দেশের জনগণ গ্রহণ করেছে। এক কথায় সাধুবাদ জানিয়েছেন। সমস্যা নিয়ে শুরু করা এ নিবন্ধে বলা হয়েছে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- বন্ধে পাশাপাশি মাদকবিরোধী অভিযানের পরিণতি ক্রসফায়ার বন্ধে কৌশলগত উদ্যোগ নেওয়া যায় কি না, এটিকে গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখা উচিত। অভিযানের অনিবার্য পরিণতি ক্রসফায়ার একটি বড় সমস্যা। এ ছাড়াও প্রতিহিংসা বা রাজনৈতিক শিকার হয়ে কারো যেন জীবন বলি না হয়।

মাদক মানুষের জীবন সংহারি বস্তু। আমাদের জাতীয় অগ্রগতির প্রতিবন্ধকতাও এটি। তাই এটাকে নির্মূল করার বিকল্প নেই। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে; যা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু চলমান অভিযানে বিচার বহির্ভূত হত্যার ঘটনা এই অভিযানকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধই করবে না এর সাফল্যকেও মøান করে দিতে পারে। তাই সরকারের উচিত, মাদকের সঙ্গে জড়িত সব শ্রেণির লোকদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। সে ব্যক্তি চুনোপুঁটি না রুই-কাতলা যেটাই হোক বিচারের মুখোমুখি তাকে হতেই হবে।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist