আবু আফজাল মোহা. সালেহ

  ২৩ জুন, ২০১৮

স্মরণ

পলাশীর ভাবনা এবং...

আজ ২৩ জুন ঐতিহাসিক পলাশী ট্র্যাজেডি দিবস। আজকাল অনেকটা অলক্ষ্যেই কেটে যায় দিনটি। ১৭৫৭ সালের এ দিনে পলাশীর আমবাগানে এক অসম্ভব যুদ্ধ জিতেছিলেন রবার্ট ক্লাইভ। পৃথিবীর ইতিহাসে, বিশেষ করে উপমহাদেশের ইতিহাসে পলাশীর যুদ্ধ একটি অন্যতম মোড় পরিবর্তনকারী যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। সে সময় ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বণিকরা ভারতে আসত ব্যবসার উদ্দেশ্যে। কিন্তু মোগল শাসকের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে ইংরেজরা বাংলায় কিছু বিশেষ শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পেয়ে ব্যবসায় সমৃদ্ধি লাভ করে। একপর্যায়ে বাংলায় ইংরেজ এবং ফরাসিদের মধ্যে ব্যবসায়িক বিরোধ তৈরি হয়। বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার নবাব ছিলেন আলীবর্দি খান। তিনি স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল তার মৃত্যুর পর তরুণ সিরাজ-উদ-দৌলা নবাব হন। এটি নওয়াব পরিবারের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। পরিবারের এবং প্রশাসনের অনেকের অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজরা সিরাজ-উদ-দৌলাকে অপসারণের পথ খুঁজতে থাকে। এক বছরের কিছু বেশি সময় তিনি নবাবী করতে পেরেছিলেন। এটি বাঙালির ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। ২৬০ বছর আগে ১৭৫৭ সালের এই দিনে ভাগীরথীর তীরে পলাশীর আম বাগানে ইংরেজদের সঙ্গে এক প্রহসনের যুদ্ধে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার শেষ সূর্য। মীরজাফর-ঘষেটি বেগমরা সেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কুশীলব। প্রহসনের ওই যুদ্ধে পরাজয়ের পর নবাবের বেদনাদায়ক মৃত্যু হলেও উপমহাদেশের মানুষ নবাবকে আজও শ্রদ্ধা জানায়। তার সঙ্গে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, তাদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। পক্ষান্তরে মীরজাফর আজ বেইমানের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঘৃণিত এ নামটি কোনো মা-বাবাই সন্তানের জন্য রাখতে চান না।

১৭৫৭ সালের ২৩ এপ্রিল কলকাতা পরিষদ নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করার পক্ষে প্রস্তাব পাস করে। এ প্রস্তাব কার্যকর করতে ইংরেজ সেনাপতি লর্ড ক্লাইভ রাজদরবারের অভিজাত সদস্য উমিচাঁদকে এজেন্ট নিযুক্ত করেন। এ ষড়যন্ত্রের নেপথ্য নায়ক মীরজাফর। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আমবাগানে সকালে ইংরেজ ও নবাবের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এদিন সৈন্যবাহিনী নিয়ে মুর্শিদাবাদের পথে অগ্রসর হয় ইংরেজ বাহিনী। সিরাজও তার বাহিনী নিয়ে পলাশীর পথে অগ্রসর হন। ইংরেজদের বাহিনীর তুলনায় নবাবের বাহিনীর আকার অনেক বড় হলেও মীরজাফর, ইয়ার লতিফ এবং রায় দুর্লভের অধীনে প্রায় দু-তৃতীয়াংশ সৈন্য নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে থাকে। মীর মর্দান, মোহনলাল, খাজা আবদুল হাদী খান, নব সিং হাজারীর নেতৃত্বাধীন সৈন্যরা এবং ফরাসি সৈনিকদের একটি দল যুদ্ধ চালিয়ে যায়। ক্লাইভ যুদ্ধে ধারণার চেয়ে বেশি প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বৃষ্টিতে নবাব এবং ফরাসিদের কামানের গোলায় ব্যবহৃত গানপাউডার ভিজে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু ইংরেজরা তাদের গান পাউডার সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হয়। মীর মদন ও মোহন লালের বীরত্ব সত্ত্বেও জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ, উর্মিচাঁদ, ইয়ার লতিফ প্রমুখ কুচক্রী প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে নবাবের পরাজয় ঘটে। সেই সঙ্গে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য পৌনে ২০০ বছরের জন্য অস্তমিত হয়। জানা যায়, ক্লাইভ দিনে যুদ্ধ চালিয়ে রাতে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের একপর্যায়ে বিকেল ৩টায় কামানের গোলার আঘাতে মীর মর্দান নিহত হলে নবাব ভেঙে পড়েন এবং মীরজাফরের কাছে পরামর্শ চান। মীরজাফর নবাবকে যুদ্ধ বন্ধ করে পরবর্তী দিনে নতুন উদ্যমে যুদ্ধ করার পরামর্শ দেন। এরপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আড়ালে ইংরেজরা সেবাদাসের সাহায্যে বাংলায় প্রায় ১৯০ বছর শাসনের নামে শোষণ করে। শোষণ করে প্রাচ্যের স্বর্গ বাংলাকে দরিদ্র দেশে পরিণত করে। এর ফল এখনো আমরা বহন করছি।

পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের বিজয় কোনো সামরিক বিজয় ছিল না। এটি ছিল একটি রাজনৈতিক বিজয়। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে আট ঘণ্টার এ যুদ্ধকে ‘যুদ্ধ’ না বলে ছোট দাঙ্গার সঙ্গে তুলনা করা যায়। ঐতিহাসিক মেলেসন পলাশীর প্রান্তরে সংঘর্ষকে যুদ্ধ বলতে নারাজ। তার মতে, ‘নবাবের পক্ষে ছিল ৫০ হাজার সৈন্য আর ইংরেজদের পক্ষে মাত্র তিন হাজার সৈন্য। কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারী ও কুচক্রী মীরজাফর, রায় দুর্লভ ও খাদেম হোসেনের অধীনে নবাব বাহিনীর একটি বিরাট অংশ পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কার্যত কোনো অংশগ্রহণই করেনি। এই কুচক্রীদের চক্রান্তে যুদ্ধের প্রহসন হয়েছিল।’ আরেক ঐতিহাসিক ড. রমেশ চন্দ্র বলেন, ‘নবাব ষড়যন্ত্রকারীদের গোপন ষড়যন্ত্রের কথা জানার পর যদি মীরজাফরকে বন্দি করতেন, তবে অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারী ভয় পেয়ে যেত এবং ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলে পলাশীর যুদ্ধ হতো না।’ অতি ঘৃণ্য মীরজাফরের কুষ্ঠরোগে মৃত্যু হয়। তবে যাই হোকÑএ পরাজয়ের ফলে ইতিহাসে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। পলাশীর ট্র্যাজেডি শুধু বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিতই হয়নি! এ পরাজয়ের মাধ্যমে সমগ্র উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের যাত্রা শুরু হয় এবং পরোক্ষভাবে এখনো সে শাসন চলমান রয়েছে। তাদের রচিত আইন, নীতিমালা ইত্যাদি মেনে ও অনুসরণ করে তা বাস্তবায়ন করছি!

রক্তাক্ত ইতিহাস, পরাধীনতার ইতিহাস, সংগ্রামী মানুষের পরাজয়, ষড়যন্ত্র-বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস, ট্র্যাজেডি ও বেদনাভরা এক রক্তাক্ত ইতিহাস। দৃশ্যপট অন্য রকম হতে পারত! প্রাসাদ-ষড়যন্ত্র না হলে ইতিহাসও অন্য রকম লেখা হতো। পলাশীর আম্রকানন আর মুজিবনগরের (বৈদ্যনাথতলা) আম্রকানন-বিপরীত অবস্থা। একদিকে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা অন্যদিকে বিশ্বাস আর পাওয়ার আকাক্সক্ষাকর ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধতা একবিন্দুতে। এখনো কিন্তু বাংলাদেশে মীরজাফররা আছে। আমাদের ট্র্যাজেডি এই যে, আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি না! অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, পলাশীর যুদ্ধে বাঙালিরা যদি ঐকবদ্ধ থাকতেন, তাহলে ফল বিপরীত হয়ে যেত। তখন ইংল্যান্ড নয় বাংলাই বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিতে পারত।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist