নিতাই চন্দ্র রায়

  ২২ জুন, ২০১৮

মতামত

জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্য নিরাপত্তা

জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশ্বের ধনী ও অতি মুনাফালোভী শিল্পোন্নত দেশগুলো দায়ী হলেও এর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো এবং বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। ঝুঁকির তালিকায় ছয়টি দক্ষিণ এশীয় দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ হবে মোট দেশজ উৎপাদনের ২ শতাংশ এবং ২১০০ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপির) ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সামস্টিক উদ্যোগ গ্রহণ করলে ক্ষতির পরিমাণ ২১০০ সাল পর্যন্ত জিডিপির ২ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হবে। জলাবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ব্যয় নিরূপণ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশের বর্তমানে জিডিপির পরিমাণ ১৩০ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান জিডিপির ৯ দশমিক ৪ শতাংশে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। এ বিষয়ে ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসির) সদস্য কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের ভাষ্য হলোÑবাংলাদেশ যে নাজুক অবস্থার মধ্যে আছে, তাতে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ না নিলে আগামী শতাব্দী আসার আগেই দেশে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে। বিপুলসংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। কমে যাবে কৃষিজমি ও কৃষিজীবীর সংখ্যা। বৈশ্বিকভাবে ২০১৫ সালের মধ্যে একটি চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে, যা ২০১০ সাল থেকে বাস্তবায়িত হবে। তার মানে হলো-আগামী পাঁচ-ছয় বছরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশের মোট জনশক্তির প্রায় ৫০ শতাংশ কৃষিকাজে নিয়োজিত। অত্যধিক বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা, দাবদাহ এবং উৎপাদন মৌসুমের সময় কমে যাওয়ার মতো কারণে চাল, গম ও আলু উৎপাদন বর্তমান সময়ের চেয়ে দুই-তৃতীয়াংশ কমে যেতে পারে। এটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে চরম হুমকির মুখে ঠেলে দেবে। জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, যত্রতত্র শিল্প-কারখানা স্থাপন, নদী-নালা, খাল-বিলে শিল্প বর্জ্য ফেলা, জলাশয় ভরাট, বন ও বৃক্ষ উজার করার মতো কাজগুলোও দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বিনষ্টের জন্য কম দায়ী নয়। দেশের ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি উপকূলীয় অঞ্চলে ৩ কোটি ৬০ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাদের বর্তমানের চেয়ে বেশি ঝড়ের মুখোমুশি হতে হবে। আবার সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে প্রচুর কৃষিজমি নদীভাঙনের শিকার হয়ে বিলীন হয়ে যাবে। কৃষিজমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাবে। ফসলের উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে। আবার সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা যদি এক মিটার বাড়ে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে খুলনা বিভাগ সবচেয়ে বেশি। এতে ঢাকা বিভাগের ১৪ শতাংশ জায়গা তলিয়ে যাবে। সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উপকূলী এলাকার সম্পদও বিনষ্ট হবে প্রচুর। জলবায়ু পরিবর্তনের এ অভিঘাত মোকাবিলার জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় এখন থেকে ২১০০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর কমপক্ষে ৭৩ বিলিয়ন ডলার বা এ অঞ্চলের মোট জিডিপির দশমিক ৮৬ শতাংশ ব্যয় করতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, আর্থ-সামাজিকসহ বিভিন্ন খাতের খসড়া হিসাব করেই সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি কমানোর জন্য দুই ধরনের উপায় গ্রহণের সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। এক. বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা, যা বাংলাদেশের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। এ জন্য বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। তারা কার্বন নির্গমণ হ্রাসে বাস্তব ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই তা সম্ভব। দুই. উন্নত দেশগুলোর দেওয়া জলবায়ু তহবিলের অর্থ যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষয়-ক্ষতি কমিয়ে আনা। এর জন্যও প্রচুর অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। জলবায়ুর বিরূপ আচরণের কারণে বন, জলাভূমি এবং বিশ্বের বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অভিঘাত মোকাবিলায় বাংলাদেশকে ২০৩০ সালে বছরে ৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার এবং ২০৫০ সালে বছরে ৩৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার ব্যয় করতে হবে বলে উল্লেখ করেছে এডিবি। এখন প্রশ্ন হলো, জলবায়ু পরিবর্তন প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ কি এত বিপুল অর্থ ব্যয় করতে সক্ষম হবে?

বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার প্রতি বছরই ৬ শতাংশের বেশি করে বৃদ্ধি পাওয়ায় ভবিষ্যতে দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে। তবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে উৎপাদনের বড় একটা অংশ ক্ষতি হলে দারিদ্র্য দূর করতে একটু বেশি সময় লাগবে। জলবায়ু পরিবর্তনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জীবনমান চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে মালদ্বীপ ও নেপাল। বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে ২১০০ সালের মধ্যে মালদ্বীপ তার মোট দেশজ উৎপাদনের ১২ দশমিক ৬ শতাংশ হারাবে। আর নেপাল হারাবে তার মোট দেশজ উৎপাদনের ৯ দশমিক ৬ ও শ্রীলঙ্কা জিডিপির ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হারাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকৃত প্রভাব এবং মোকাবিলায় কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে, তা বিশ্ব সম্প্রদায় নেওয়া পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করবে। ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকায় বর্তমান সময়ের তুলনায় ১১ শতাংশ পানিপ্রবাহ ও কৃষি উৎপাদন হ্রাস পাবে। গবেষকরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে যেমন শস্য উৎপাদন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে, তেমনি এই অববাহিকায় অবস্থিত দেশগুলোর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে এখন থেকেই গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি থেকে উপকূলীয় অঞ্চলকে রক্ষা করার জন্য সরকার ব্যাপক ভিত্তিতে বৃক্ষরোপণের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। চলতি বছরেই নৌবাহিনীর মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে আরো দক্ষতা বাড়াতে হবে। একই কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা সহিষ্ণু ধান, ভুট্টা, সুগারবিট, আখ, সূর্যমুখীর মতো ঘাতসহিষ্ণু ফসল চাষের উদ্যোগ নিতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে তাপ ও জলমগ্নতাসহিষ্ণু ফসলে জাত উদ্ভাবন এবং উৎপাদন প্রযুক্তি কৃষকের কাছে দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার। প্রয়োজনে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শস্য বিন্যাস ও শস্য ক্রমের পরিবর্তন করতে হবে। উদ্ভাবন করতে জলবায়ু পরিবর্তনের ঘাতসহিষ্ণু গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, মাছ ও জলজ প্রাণীর নতুন নতুন জাত ও লালন-পালনের নতুন কৌশল। সেই সঙ্গে কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্যবিষয়ক গবেষণা কার্যক্রম আরো জোরদার করতে হবে। বিশ্বের সব দেশে যদি তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২১০০ সালের মধ্যে দুই ভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার অঙ্গীকার রক্ষা করে, তবে ২০৫০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর আথিক ক্ষতির পরিমাণ জিডিপির ১ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে থাকবে। আর ২১০০ সালের মধ্যে তা বেড়ে সর্বোচ্চ আড়াই শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। এ ক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৪ হাজার ৬ লাখের মধ্যে। এ হিসেবে দেশগুলোর মোট জিডিপি দশমিক ৪৮ শতাংশের মধ্যেই থাকবে ক্ষতির পরিমাণ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সালে বাংলাদেশের কমপক্ষে সাড়ে তিন কোটি মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। গ্রাম ছেড়ে শহরের বস্তিতে আশ্রয় নেবে। তাদের খাদ্য-পুষ্টি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। শিল্প বিপ্লবের পর বর্তমান সময় পর্যন্ত কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ৪০ শতাংশের মধ্যে ৩০ শতাংশ শুষে নেয় সমুদ্র। ফলে সমুদ্রের অম্লতা বেড়ে যাচ্ছে। এতে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে হুমকির মুখে পড়েছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর নিম্নাঞ্চল। বাংলাদেশ জলবাযু পরিবর্তনের এক নির্মমতার শিকার। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশকে তার জিডিপির ১ শতাংশ হারাতে হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো একটি গরিব দেশের জন্য এ পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য অন্যতম দায়ী দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। পশ্চিমা বিশ্বের দ্বারা সৃষ্ট হলেও নেপাল, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপকে গ্রিনহাউস গ্যাসের ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার হতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, সে অনুযায়ী সাহায্য পাওয়া যায় না। ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রতি বছর প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন শুধু দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যা নয়। এটি এখন এক ভয়াবহ বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। তাই মানবজাতির অস্তিত্ব ও টিকে থাকার স্বার্থে এ সমস্যা মোকাবিলায় সব দেশকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

লেখক : কৃষিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist