রায়হান আহমেদ তপাদার
বিশ্লেষণ
প্রবাসে ঈদের আনন্দ
আকাশে শাওয়াল মাসের চাঁদ ভেসে ওঠার পরপরই চারদিকে শোনা যায় চিরচেনা সেই গান ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। সৌদি আরবে শাওয়ালের চাঁদ দেখার পর ঈদ উদযাপিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সংগতি রেখে ইউরোপ, আমেরিকাসহ পশ্চিমা প্রায় সব দেশেই উদযাপিত হয় পবিত্র ঈদুল ফিতর। পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক দেশে ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতি শুরু হয় কয়েকদিন আগে থেকেই। লন্ডনসহ ব্রিটেনজুড়ে যথাযোগ্য ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও উৎসাহ-উদ্দীপনায় ঈদ উদযাপন হয়েছে। টানা এক মাস মাহে রমজানের সিয়াম সাধনার পর ১৫ জুন শুক্রবার সমগ্র বিশ্বের মুসলমানরা উদযাপন করছেন পবিত্র ঈদুল ফিতর। বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন মসজিদে ঈদুল ফিতরের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। ইসলামের পবিত্র স্থাপনাগুলোর ভূমি সৌদি আরব, সিরিয়া ও মালয়েশিয়ায় যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপিত হয় ঈদুল ফিতর। কায়রোর তাহরির স্কোয়ারের ঈদ জামাতে অংশ নেন অসংখ্য মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানরাও বিভিন্ন মসজিদ এবং ময়দানে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করেন। সারা বিশ্বের মুসলমানদের ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা জানান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্প। তিনি বলেন, সমগ্র বিশ্বের মতো ঈদ লাখ লাখ আমেরিকানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বহু ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং আমি কামনা করছি এই ঈদ হোক সব মুসলমানের জন্য আশীর্বাদ ও আনন্দ উৎসবে পরিপূর্ণ। বিগত এক মাস মুসলমানরা তাদের বিশ্বাস অনুসারে প্রার্থনাসহ ধর্মীয় কর্মকা- করেছেন, সিয়াম সাধনা করেছেন এবং প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। হোয়াইট হাউসের এ বছরের ইফতারে আমি অসংখ্য আমেরিকান মুসলমানের কয়েকজনের সঙ্গে কিছুটা সময় হলেও কাটানোর সুযোগ হয়েছে। আমাদের গণতন্ত্র ও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। অনেকেরই আমাদের মুসলমান বন্ধু ও সহকর্মীদের সঙ্গে ইফতার করার সুযোগ হয়। ইফতারের এই ঐতিহ্য আমাদের সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্মরণ করায় এবং লাখ লাখ সিরিয়ান, যারা এ রমজানে ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছেন, পরিবার ও প্রিয়জন ছাড়া হয়েছেন, তারা-সহ আমাদের মধ্যে কম ভাগ্যবানদের প্রতি সমবেদনা বাড়িয়ে দেয়। ঈদ হচ্ছে লাখ লাখ আমেরিকানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বহু ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ঈদ ছোট-বড়, ধনী-গরিবের প্রভেদ ভুলিয়ে দেয়। রাজা-প্রজা নির্বিশেষে একসঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ আদায় করেন। শামিল হন ঈদের আনন্দময় উৎসবে। পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা, প্রীতি ও সৌহার্দ্য-সহমর্মিতা বিনিময় করেন এ সময়। সারা পৃথিবীর মানুষ আবার একবার হেসে উঠে সাম্য-মৈত্রী আর ভালোবাসার অটুট বন্ধনে। থাকে না কোনো ধনী-গরিবের ব্যবধান। এক দিনের জন্য হলেও এ আনন্দে বিলীন হয়ে যায় সবাই। ছাত্রজীবনে শিক্ষা লাভের জন্য শিক্ষার্থীদের মা-বাবা, পরিবার, পরিজন, বাঁশ বাগানের মাথার ওপর আধখানা চাঁদ ঝোপে-ঝাড়ে বাতির মতো জোনাকি, ফুলের গন্ধ, সর্বোপরি শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত গ্রাম ছেড়ে দূরে বহুদূরে থাকতে হয়। কিন্তু দূরদূরান্তে থাকলেও এসব নাড়ির টান ও শিকরের বন্ধন সে সব সময় অনুভব করে। মধ্যপ্রাচ্যে আজ ঈদ। আরবের ঘরে ঘরে আনন্দ। রাস্তায় রাস্তায় খুশির জোয়ার। শপিং মলে কেনাকাটা শেষে এখন অনেকটাই ফাঁকা। লাখো মানুষের পদচারণে পিষ্ট এই শপিং মলকে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করতে করতে চোখ জলে টলমল করে উঠে রফিক মিয়ার। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের জল মিশে যায় তীব্র গরমে গা থেকে বেরিয়া আসা দুর্গন্ধময় ঘামের সঙ্গে। মনে কেবল একটাই যাতনা, এত কষ্টের পরও ছেলেমেয়েদের ঈদের কাপড় কিনেই টাকা শেষ। তিন ঈদ চলে গেলেও মায়ের জন্য কিনতে পারেনি কিছুই। ঠিক এমন সময় দেশ থেকে ফোন আসে। ফোনে ওপার থেকে মা জিজ্ঞেস করেন, বাজান কী করো? চোখ মুছতে মুছতে আবেগ সামলে অনেকেই বলেন মা, সব বন্ধু-বান্ধব মেলে সেমাই খাই। এটাই হলো মধ্যপ্রাচ্যে বাঙালিদের ঈদ।
ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। যারা একটু পুরনো, বাড়িতে টাকার চাপ যাদের একটু কম, যাদের কপাল একটু ভালো, তারা অনেকে ঈদে বেশ মজাও করেন। রান্না করেন সেমাই-পোলাও উটের গোশত। গায়ে জড়ান নতুন জামা। আরবদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঈদগাহে ঈদের নামাজও আদায় করে থাকেন। তবে মিসরে বাংলাদেশিদের অবস্থা কিছুটা ব্যতিক্রম। এখানে সাধারণত দুই শ্রেণির বাংলাদেশি আছেন। ছাত্র এবং গার্মেন্টকর্মী। ছাত্রদের হাতে টাকাপয়সা কম থাকলেও তারা মোটামুটিভাবে ভালোই ঈদ উদযাপন করে থাকেন। যারা হোস্টেলে থাকেন, তারা বিভিন্ন দেশের বন্ধুদের সঙ্গে নামাজ আদায় করেন। খাওয়া-দাওয়া সব শেয়ার করেন। নতুন জামাকাপড় পরেন। আর যারা বাসাভাড়া করে থাকেন, তারা অনেকে আগের রাতেই কিছু রান্না করে রাখেন। ভোরে নামাজ আদায় করে এসে কিছু খেয়ে ঘুম দেন। দুপুরে উঠে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা করে আড্ডা দেন। সন্ধ্যায় ছাত্র সংগঠনের অনুষ্ঠানে যোগ দেন, তারপর রাতভর আড্ডা অথবা নীলনদের পাড়ে ঘুরতে যান। অন্যদিকে গার্মেন্টকর্মীরা ঈদে তিন-চার দিন ছুটি পান। তারা সাধারণত একসঙ্গে অনেকজন থাকেন। কাজেই তাদের ঈদ আনন্দটা একটু বেশিই। খাবার আয়োজনেও তারা বেশ মনোযোগী। পাঁচ-সাতজন মিলে রান্না করেন। দুপুরে বিভিন্ন জাগায় ঘুরতে যান। সন্ধ্যায় অনেক সময় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। একসঙ্গে মজা করেন। রাতে শুরু হয় দেশে ফোন করার প্রতিযোগিতা। কারণ পরের দিন বাংলাদেশে ঈদ। সারা দিন যতই উৎফুল্ল থাকুক, রাতে দেশে কথা বলতে গিয়ে সবাই আবেগী হয়ে ওঠেন। পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মেলাতে না পেরে সবাই প্রায় একই মুখস্থ উত্তর দেয়, অনেক কিছু খাইছি, অনেক মজা করছি, আমি ভালো আছি, আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না।
প্রবাসে ভালো থাকার একটি দিন ঈদের দিন। এক মাস সিয়াম সাধনার পর প্রবাসীরা ঈদের আনন্দে মেতে ওঠেন এ দিনটিতে। ক্ষুদ্র জীবন থেকে একে একে চারটি ঈদ কেটে গেলেও ভিসাগত জটিলতা, আর্থিক সমস্যা অথবা মালিকপক্ষের অবহেলায় ঈদের আনন্দকে ভাগাভাগি করা হয়নি পরিবার পরিজনের সঙ্গে। ঈদের দিন নিত্যনতুন জামা-কাপড় পরিধান করলেও ভাবনার জগৎ থেকে আজও হারাতে পারিনি। মায়ের হাতের রান্না, এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে ছোটাছুটিÑএসব এখন শুধুই স্মৃতি। ঈদের দিন তাই খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে সেমাই, পোলাওসহ নানা রকমের খাবার রান্না শেষে পাশাপাশি থাকা একজন অন্যজনের দাওয়াতি মেহমান হিসেবে বাসায় আসে। ঘরোয়া পরিবেশে কতই না মজা হয় তখন, যা একসময়ে স্মৃতির ফ্রেমে বন্দি হয়ে রয়। ঈদের নামাজে যাওয়ার আগ মুহূর্তে বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় আর তাদের দোয়া নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করা। মালয়েশিয়ার প্রতিটি মসজিদে সকাল থেকেই দেশীয় পোশাকে বাংলাদেশিদের পদচারণে মুখরিত হয়ে থাকে পুরো মসজিদ। নামাজ শেষে বাংলাদেশিদের ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি দেখে স্থানীয়দের মধ্যেও এক অনুভূতির সৃষ্টি হয়। স্থানীয়রাও মুগ্ধ হয়। তবে, অনেক প্রবাসী ঈদের জামাত শেষ করেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে দূর-দূরান্তে থাকা আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা করার জন্য। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন প্রদেশে বসবাসরত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে ছুটে যান একে অন্যের কাছে। ঈদের ছুটির এই সামান্য সময়টুকুতেই শুরু হয় খোশগল্প, একে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করে সুখ-দুঃখের কথা।
প্রবাসে আধুনিকায়নের যুগে সব থাকা সত্ত্বেও এখানে পাওয়া যায় না সেই লাল সবুজের সুজলা, সুফলা শস্য, শ্যামলের বাংলাদেশ। নেই মনের মতো প্রতিবেশীও। খ- খ- হৃদয়ের চাওয়াগুলো প্রবাসের এত চাকচিক্যের মধ্যেও মন ভরে না। ফিরে যেতে মন চায় মাটির টানে স্বদেশের আঙিনায়। সময়টা ক্ষণিকের জন্য হলেও মুহূর্তগুলো চিহ্নিত করে রাখে একে অন্যের। সেই স্মৃতিগুলো লেখা হয়ে যায় অনুগল্পে আবার অনেক প্রবাসীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, ঈদের নামাজ শেষে দেশে ফোন করার পর বুকের ভেতর চাপা কষ্টের যন্ত্রণা যেন আরো বেড়ে যায় দ্বিগুণ। পরিবারকে কাছে না পাওয়ার কষ্ট আর যন্ত্রণার বুকফাটা আর্তনাদ বুকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে চোখের পানিতে বালিশ ভিজিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেন। এরপর দুপুর গড়িয়ে পুবের সূর্যটা পশ্চিমে হেলতে শুরু করলে বিছানা ছেড়ে দু-একজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে সামান্য আনন্দের প্রত্যাশায় ছুটে চলেন অজানা গন্তব্যে। এভাবেই কাটে অনেক প্রবাসীর ঈদ নামের নিঃসঙ্গ বেদনার দিনটি। সবশেষে দেশ-বিদেশের সবার জন্য একটাই প্রতিশ্রুতি থাকল, ভোগে নয়, ত্যাগের মহিমায় পবিত্র ঈদ উদযাপন হোক-এটাই সবার প্রত্যাশা।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও যুক্তরাজ্য প্রবাসী
"