সাধন সরকার
মতামত
বড় বন্যার আশঙ্কা
এ বছর বড় ধরনের বন্যার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে পার্বত্য জেলাসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের (সিলেট, মৌলভীবাজার, ফেনীসহ) বেশ কয়েকটি জেলায় অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে আশপাশের নদ-নদীর বাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়া শুরু করেছে। ধীরে ধীরে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়ে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ছে। বলতে গেলে পুরো বৈশাখে এবার প্রকৃতির আচরণ ছিল এলোমেলো। কালবৈশাখী, শিলাবৃষ্টি ও বজ্রপাতে ইতোমধ্যে বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এখন আউস ও আমন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এখন মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হওয়া শুরু করেছে। আবহাওয়াবিদদের গবেষণা মতে, এ বছর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতসহ চীন-নেপাল-ভারত হয়ে পাহাড়ি ঢল নদ-নদী হয়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। বন্যা বাংলাদেশে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অতিবৃষ্টি ও উজানে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও গঙ্গা অববাহিকায় পানি বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর কমবেশি বন্যা হয়ে থাকে। ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮ সালে ভয়াবহ বন্যাসহ অন্যান্য বছর এবং সাম্প্রতিককালের ২০১৬, ২০১৭ সালের বন্যায় বাংলাদেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বন্যা প্রাকৃতিক হলেও এর ক্ষয়ক্ষতির জন্য মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কার্যকলাপ ও সার্বিক প্রস্তুতির ঘাটতিও কম দায়ী নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অসময়ে অস্বাভাবিক মাত্রায় বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে উন্নত রাষ্ট্রগুলোও দায় এড়াতে পারে না। এশিয়ার দক্ষিণাঞ্চল এমনিতেই পৃথিবীর অন্যতম পানিবহুল ও বৃষ্টিবহুল এলাকা। এ অঞ্চলে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের গড় প্রায় ১ হাজার মিলিমিটার। জলবায়ু বিজ্ঞানীদের ধারণা, আগামী বছরগুলোতেও এ অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত বৃদ্ধির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অতিবৃষ্টি শুধু যে বন্যার সৃষ্টি করছে তা নয়, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ অন্যান্য দুর্যোগ ও ক্ষয়ক্ষতি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ ভারী বর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে। প্রশ্ন হলো, জলবায়ু পরিবর্তনে যাদের বা যেসব দেশের কোনো ভূমিকা নেই, যেসব দেশের মানুষকে বা দেশকে কেন জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে ভুগতে হবে? জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী মাত্র শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ (০.৩) কার্বন নির্গমন করে বাংলাদেশ। বিশ্বকে বাসযোগ্য করার দায় উপেক্ষা করে উন্নত রাষ্ট্রগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নির্গমন করে চলেছে। তাই বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় উন্নত রাষ্ট্রগুলো থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে জোর তৎপরতা চালাতে হবে। অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের ফলে মূলত বন্যার সৃষ্টি হয়। বন্যা একটি প্রাকৃতিক বাস্তবতা এবং ভাটির দেশ হিসেবে অতিরিক্ত পানি বাংলাদেশ দিয়েই নামবে। তবে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নদ-নদী দখলসহ নাব্য কমে যাওয়ার ফলে অতিবৃষ্টির পানিপ্রবাহ বিঘিœত হয়। তাপমাত্রা বাড়ার ফলে মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ এলোমেলো হয়ে যায়। মৌসুমি বায়ু যতই বিস্তৃত হয়, ততই বাড়ে বৃষ্টিপাতের অঞ্চল। আষাঢ়-শ্রাবণের আগে এখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির বদলে মুষলধারে ব্যাপক বৃষ্টি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বার্ষিক বৃষ্টি দিনের সংখ্যা কমে যাচ্ছে কিন্তু মুষলধারে বৃষ্টিপাতের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বৃষ্টিপাতের ধরনও বদলে যাচ্ছে। অল্প সময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত অনিয়ন্ত্রিত বন্যায় রূপ নিচ্ছে। ভারতের পানি নীতিও বাংলাদেশে বন্যার তীব্রতা বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। শুকনো মৌসুমে বাঁধ দিয়ে পানি ধরে রাখা এবং বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়ার ফলে বাংলাদেশে বন্যার আশঙ্কা তৈরি হয়। প্রতি বছর বন্যাকালীন জানমাল ও সার্বিক অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি যেন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্যার সময়ে জানমাল ও ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা ও সমাধানের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গত কয়েক বছরের বন্যার আগে, বন্যাকালীন ও বন্যা-পরবর্তী এলাকাভিত্তিক সার্বিক ক্ষয়ক্ষতি, বন্যার তীব্রতা, ত্রাণ তৎপরতা, পুনর্বাসন, কৃষি সহায়তাসহ সব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদ-নদীর পানি ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া এ বছর রোহিঙ্গা বসতি এলাকায় বন্যা মোকাবিলায় কর্তৃপক্ষকে সতর্ক থাকতে হবে। বন্যার সময় সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে নানা দিক বিবেচনায় রেখে বন্যা মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে হবে। বন্যাকালীন খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সংকটে সর্বাত্মক প্রস্তুতি রাখতে হবে। মূলত গত বছর হাওর অঞ্চলসহ দেশের উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে ব্যাপক বন্যায় সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে জানমাল ও অর্থনৈতিক ক্ষতিসহ সারা দেশে দরিদ্র মানুষের খাদ্য পাওয়ার সুযোগ বেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছিল। এ সময় ফসল উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছায়। তাই বন্যার মতো দুর্যোগকে কাজে লাগিয়ে কোনো মহল বা অসৎ ব্যবসায়ী যাতে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে। বন্যার সময় ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ তৎপরতাসহ প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা, তাৎক্ষণিক আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া, বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসন কর্মসূচি ও কৃষকদের সহায়তা পরিকল্পনা এখন থেকেই নেওয়া উচিত। বন্যাকালীন ও বন্যা-পরবর্তী স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়েও পরিকল্পনা থাকা জরুরি। তাৎক্ষণিক সমাধান নয়, প্রতি বছর হওয়া এ দুর্যোগের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান ও ক্ষয়ক্ষতি সর্বোচ্চ কমিয়ে আনার পথ খুঁজতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-সংস্থাকে সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাৎক্ষণিক বন্যা মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে বন্যাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় উন্নত রাষ্ট্রসমূহকে এগিয়ে আসা উচিত।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
ংধফড়হংধৎশবৎ২০০৫@মসধরষ.পড়স
"