ইয়াসমীন রীমা

  ২১ জুন, ২০১৮

বিশ্লেষণ

বহুরূপে নারী নির্যাতন

বেসরকারি সংস্থার তথ্যঘর থেকে বের হয়ে বুকভরে বাতাস টেনে নিলেন নাহিদা। দীর্ঘদিনের নির্যাতনের যন্ত্রণা থেকে যেন একটা মুক্তির পথ তিনি খুঁজে পেয়েছেন। তথ্যঘরের রোকশানা আপার কথাগুলো তার কাছে এখন অভয় বাণীর মতো মনে হচ্ছে। নারীদের জন্য আইন-রীতিনীতি এত সুস্পষ্ট তার জানা ছিল না। এত সহজেই যে একজন নির্যাতিত-বঞ্চিত বা বিতাড়িত নারী নিজের পক্ষের অধিকার আদায় করতে পারেন, তা সম্পূর্ণ ছিল তার অজ্ঞাতসারে। তাই তিনি ভেবেছেন কালই জেলা সদরে পারিবারিক আইন-সালিশি কেন্দ্রে তার অভিযোগগুলো জানাবেন।

কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা অন্তর্ভুক্ত গ্রাম কুটুম্বপুরের রাজমিস্ত্রির কুদ্দুস সর্দারের প্রথম কন্যা নাহিদার বিয়ে হয়েছিল সাত বছর আগে তার পাশের গ্রাম হোসেনপুরের ডায়ানামা মিস্ত্রি রফিকউল্লার সঙ্গে ৭৫ হাজার টাকা দেনমোহরে। বিয়েতে যৌতুক হিসেবে নাহিদার বাবাকে নগদ ৩০ হাজার টাকা দিতে হয়েছিল। স্বামী সংসারে নাহিদার সুখের পাশাপাশি যে দুঃখটি বয়ে চলত, তা ছিল সময়-অসময়ে তার স্বামী রফিকউল্লাহ তুচ্ছ সব ঘটনার রেশ ধরে মারধর করতেন। প্রথম প্রথম নাহিদা লোকলজ্জার ভয়ে সব আড়াল করে যেতেন রফিকউল্লাহর যৌথ পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে। কিন্তু অবস্থা দিন দিন বেগতিক হয়ে পড়ে। একসময় বিনা কারণে কাজটি তিনি প্রকাশ্যে সবার সামনে শুরু করে দেন। প্রথমদিকে শ্বশুর-শাশুড়ি ও ননদ-দেবররা বাধা দিলেও পরবর্তীতে তারাও তার সঙ্গে তাল মেলাতে শুরু করে দেন। নিরুপায় হয়ে পড়েন নাহিদা। পড়ে পড়ে স্বামীর মার খেতে থাকেন। এক এক সময় তার ইচ্ছা জাগতে শুরু করছিল তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেবেন। কিন্তু তিন বছরের কন্যাসন্তানের মুখ চেয়ে সব সহ্য করে যাচ্ছিলেন এবং এই নির্যাতন প্রতিরোধের পথ খুঁজছিলেন। তখনই পেয়ে যান পাশের বাড়ির ঢাকা থেকে আসা কুসুম ভাবির পরামর্শ এবং তার পরামর্শ অনুযায়ী তথ্যঘরে জানতে আসেন। নাহিদা স্থির করে ফেলেছেন একটা বিহিত তিনি করবেনই। এভাবে পড়ে পড়ে আর বিনা অপরাধে মার খাবেন না।

আমাদের দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা হরহামেশা ঘটছে। কেবল সময় আর কালের চক্রে নতুন নতুন ধরন ও মাত্রা যোগ হচ্ছে মাত্র। বউ পিটানো আমাদের সমাজে নারী নির্যাতনের নতুন কোনো ঘটনা নয়। সমাজের উচ্চস্তর থেকে সর্বনিম্নস্তর পর্যন্ত এই নির্যাতন ঘটে থাকে নিরন্তর। সংসারের এই মারধর ও পিটুনি অনেক সময় হত্যাকান্ডে গড়ায়। এসব নির্যাতনের ৮৮ ভাগই পরিবারে মধ্যে ঘটে থাকে। ইউএনএফপির মতে, স্বামী বা পুরুষ সঙ্গী কর্তৃক নারীদের নির্যাতিত হওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়। শতকরা ৮৯ ভাগ স্বামী, ৮৬ ভাগ শাশুড়ি ও ৬৩ ভাগ ননদের হাতে নির্যাতিত হয়। আইসিডিডিআরবি এক জরিপে উল্লেখ, গর্ভাবস্থায় নির্যাতনের মধ্যে ৩৭ ভাগ অভিযোগ করেছেন। এ সময় তাদের পেটে লাথি ও ঘুষি মারা হয়েছে। তাছাড়া ৬২ ভাগ অভিযোগ করছেন গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ও পরিমিত খাবার দেওয়া থেকে বঞ্চিত রাখছে। নারীর অধিকার লঙ্ঘন করা মানে নারীর আইনি লঙ্ঘন। বিয়ে একটি আইনগত, ধর্মীয় এবং সামাজিক বিধান। পরিবার ও বিয়ে সম্পর্কে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ধারা ১৬-এর উপধারা অনুযায়ী পূর্ণবয়স্ক নারী-পুরুষ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ স্বাধীনভাবে স্বামী-স্ত্রী রূপে সঙ্গী বেছে নেওয়ার এবং তাদের স্বাধীন ও পূর্ণ সম্মতিতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া দেশে বিশেষ বিবাহ আইন ১৮৭২ নামে একটি আইন রয়েছে। রেজিস্ট্রেশনবিহীন বিয়ে হওয়ার কারণে অনেক নারী তালাকপ্রাপ্ত হওয়ার পর দেনমোহর বা খোরপোশ দাবি করতে পারেন না। পারেন না দেনমোহরের জন্য আইনের আশ্রয় নিতে। নারীরা বিয়ে-সংক্রান্ত ঘটনায় স্বামী কর্র্তৃক বেশি শিকার হয়ে থাকেন। স্বামীর পাশাপাশি পরিবারের অন্য সদস্যরাও নির্যাতন করে থাকেন। বিয়ে-সংক্রান্ত ঘটনায় স্বামীর পাশাপাশি শাশুড়ি, দেবর, ননদ ও ভাসুরও নির্যাতনে অংশ নেন। সাধারণত নিম্নবিত্ত পরিবারে নারীরা নির্যাতনের বেশি শিকার হন। তবে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারে নারীদের ক্ষেত্রেও নির্যাতন ঘটে থাকে। অপরদিকে বিয়ে-সংক্রান্ত ঘটনার মামলায় রায় হয় খুব কম। আপস করা, সময়মতো পুলিশি তদন্ত রিপোর্ট না পাওয়া এবং বিয়ের কোনো প্রমাণপত্র না থাকা ইত্যাদি কারণে মামলার রায় কম। বিয়ে-সংক্রান্ত নির্যাতনের ধরনগুলো মোটামুটিÑ মারপিট, তালাকের ভয়, একঘরে করে রাখা, পুড়িয়ে মারার চেষ্টা, শরীরের স্পর্শকাতর স্থান ঝলসে দেওয়া, অনাহারে রাখা, মগরম ডাল দিয়ে শরীর ঝলসে দেওয়া, জুয়ার টাকা না পেলে, ভাত রান্নায় বিলম্ব হলে, উলঙ্গ করে পেটানো। তবে সবচেয়ে প্রচলিত চুলের মুঠি ধরে প্রাচীরে ধাক্কা খাওয়ানো।

বৈষম্যমূলক সমাজ কাঠামোর মধ্যে এ দেশের নারীরা নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বর্তমানে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সবক্ষেত্রে বেড়েই চলছে। স্ত্রী নির্যাতন অপরাধ হিসেবে সামাজিকভাবে স্বীকৃত। তবে এ নির্যাতন প্রতিরোধে কোনো আইন নেই। এ ব্যাপারে প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এ কিউ জামান বলেন, ‘আমাদের দেশে স্বামীরা মনে করেন স্ত্রীকে পেটানো তার অধিকার। আবার কুসংস্কার আছেÑ স্বামীর পদতলে স্ত্রীর বেহেশত। বিয়ের সম্বন্ধ করার সময় ভালো শিক্ষিত ও মার্জিত পরিবার খুঁজি। কারণ যে পরিবারের পিছুটান ও সম্মান-ইজ্জত নেই, তারা স্ত্রীকে পিটাতে বা অসম্মান করতে দ্বিধাবোধ করে না।’

নারী নির্যাতন বা স্ত্রী পিটায় ব্যক্তিবিশেষে, সব পুরুষ বা পরিবারে বউ পিটায় না। পরিবারের কুশিক্ষা আচরণ নিচু মন-মানসিকতায় বেড়ে উঠায় স্ত্রীর প্রতি তা প্রকাশ পায়। পরিবার থেকে উপযুক্ত শিক্ষা না পেলে বিরূপ আচরণ করবে; এটাই স্বাভাবিক। স্ত্রীর প্রতি কী ধরনের আচরণ করবে, তা শেখার সুযোগ নেই ঘরে কিংবা বিদ্যালয়ে। এ সমস্যা সমাধানে পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় পর্যায়ে বিষয়টি তুলে ধরতে হবে। একটি সন্তানকে তার পরিবার থেকেই সুশিক্ষা ও আচরণগত বিভেদগুলো বোঝাতে হবে। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম রহমান বলেন, ‘ভারসাম্যহীন পারিবারিক পরিবেশের কারণে স্ত্রীরা প্রহারের শিকার হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে সমাধান করতে পারস্পরিক সহযোগিতা ও আলোচনা করা প্রয়োজন। তাদের মানসিক সম্পর্ক দূরত্ব থাকায় ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। ফলে স্ত্রী-সন্তানকে অবহেলা করে অপরাধ ও অন্যায়কে কর্তৃত্বের মধ্যে ফেলানোর চেষ্টা করেন। স্ত্রীকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ না ভেবে অধীনস্থ কর্মচারীর মতো মনে করেন।’

বউ পিটানো আদিকাল থেকে নারী নির্যাতনের একটি ধরন হিসেবে চলে আসছে ঠিক, তবে বর্তমানে তা হত্যাকান্ডের মতো ঘটনায় পৌঁছে গেছে। বর্তমানে স্ত্রী পিটানো নারী নির্যাতনের আওতায় পড়ে, সেজন্য শাস্তি ও জরিমানা আরো কঠিন করা হয়েছে। স্ত্রী পিটানোর অপরাধের শাস্তির বিধানটি হচ্ছেÑ যদি কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীকে ইচ্ছাকৃতভাবে অথবা তুচ্ছ ঘটনায় আঘাত করে, চড়-থাপ্পড়, লাথি-ঘুষি মারে; তাহলে ৩২৩ ধারামতে এক বৎসরের জেল অথবা পাঁচ হাজার টাকা অর্থদন্ড হতে পারে অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারে। তাছাড়া যদি কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে গুরুতর জখম করে, সেজন্য সাত বৎসর বা এর অধিক শাস্তি হতে পারে। অনেক পরিবারে শিশুকাল থেকে দেখে আসছে পরিবারে-সমাজে বউ পিটাচ্ছে, যারা দেখে সে-ও অধিগ্রহণ করে ফেলে বউ পিটানো যেন একটা সামাজিক কর্তব্য। উন্নত দেশগুলোতে পুলিশ বিভাগে মানসিক উন্নতির জন্য সাইকোলজি বিভাগ আছে, আমাদের দেশে তা না থাকলে অন্তত পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে কাউন্সিলিং করে তাদের চিহ্নিত করতে হবে এবং সংশোধনের জন্য মানসিক উন্নতির লক্ষ্যে প্রয়োজনে রীতিমতো প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ ব্যাপারে বেসরকারি সংস্থাগুলো এগিয়ে আসতে পারে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, সেমিনার ও কর্মশালার মাধ্যমে সবাইকে বোঝাতে হবে- নারীরাই তার মা-বোন-কন্যা এবং বউ।

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist