জি. কে. সাদিক
আন্তর্জাতিক
চুক্তির বাস্তবতা ও সংশয়
চুক্তি করতে হবে তাই একটা চুক্তি করে দেখানো হলো-পিংয়ং ইয়ং বনাম ওয়াশিংটন চুক্তি প্রসঙ্গে এমনটাই বলা আপাতত জুতসই মনে হচ্ছে। যে চারটি বিষয় প্রাধান্য দিয়ে চুক্তিটি করা হলো, সেখানে উত্তর কোরিয়ার জনগণের কথা কই? ২৭ এপ্রিল পানমোজায় দুই কোরিয়ার মধ্যে যে বৈঠক হয়েছে, এটা গতানুগতিক বৈঠক মাত্র। কারণ এর আগে এমন বাগাড়ম্বরপূর্ণ আরো দুটি বৈঠক হয়েছে (২০০০ সালের ১৩-১৫ জুন ও ২০০৭ সালের ২-৪ অক্টোবর)। কোনোটাই আলোর মুখ দেখেনি। উত্তর কোরিয়ার ওপর অবরোধের মূলে দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, পারমাণবিক অস্ত্র। দ্বিতীয়টি হলো, উত্তর কোরিয়ার বিপর্যস্ত মানবাধিকার পরিস্থিতি। ট্রাম্প-কিম পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে সম্মত হয়েছেন। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার মানবাধিকার বিষয়ে কোনো কথা হয়নি। ‘বড়জন চাইল আর ছোটজন মাথানত করে দিয়ে দিল’Ñএমনটাই বলা যায় এ চুক্তি নিয়ে। কোনো ধরনের দরকষাকষি হয়নি বললেই চলে। বিশেষত দীর্ঘ ৭০ বছর বিবাধে জড়িত থাকা দুটি দেশের মধ্যে এমন সহজ চুক্তির কথা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। ৪০ মিনিটের বৈঠক শেষে ট্রাম্প-কিম যে সৌজন্যমূলক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তাতে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। কারণ মাত্র কিছুদিন আগের পরমাণু বোমার বোতাম টিপে দেওয়ার যে হুমকি দেওয়া হয়েছিল, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এমন প্রশংসাবাণী সত্যিই মহাবিস্ময়ের। সে যাই হোক, শত জল্পনা-কল্পনা শেষে আপাতত যুদ্ধের দামামা থেকে শান্তির বৈঠক এটা ঐতিহাসিক ঘটনা। তবে এ চুক্তির ভবিষ্যৎ ও গুরুত্ব নিয়ে বিশ্লেষকদের অনেক প্রশ্ন ও সংশয় আছে।
ট্রাম্প-কিম চুক্তি নিয়ে সন্দেহের বড় কারণ হলো উত্তর কোরিয়ার বর্তমান রাজনৈতি, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি। ২ কোটি ৫৮ লাখ দুর্ভিক্ষকবলিত জনগণ, যাদের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা ও স্বাধীনতা নেই, তাদের ব্যাপারে উত্তর কোরিয়ার নীতি কী হবে? এ ক্ষেত্রে মার্কিন নীতিই বা কী হবে? চুক্তিতে এ বিষয়ে কোনো কথা বলা হয়নি। আসলে বলতে গেলে চুক্তির কোনো বিষয়ই স্পষ্ট নয়। দেড় পৃষ্ঠার চুক্তি নামাতে কী আছে, তা প্রকাশ করা হয়নি। ১৯৯০-এর দিকে উত্তর কোরিয়ার দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়। তখন রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচারমাধ্যমে ডায়েটের উপকারিতা নিয়ে ‘চলুন দৈনিক দুবেলা আহার করি’Ñসেøাগান প্রচার করা হয়। ইউনিসেফের তথ্য মতে, বর্তমানে উত্তর কোরিয়াতে দুই লাখ শিশু অপুষ্টির শিকার। এর মধ্যে ৬০ হাজার গুরুতর অপুষ্টিতে ভোগছে। উত্তর কোরিয়ার শিশুদের মধ্যে ঝরে পড়ার প্রবণতা বেশি। কারণ পরিবারের অর্থিক অসচ্ছলতার জন্য তাদের উপার্জনে করতে হয়। উত্তর কোরিয়ায় জোর করে শ্রমিকও খাটানো হয়। বছরে দুবার এ কাজে শিক্ষার্থীদের মাঠে নামতে বাধ্য করা হয়। এ ছাড়া বিদেশে যেসব নাগরিককে কাজের জন্য পাঠানো হয়, তাদের মজুরির সিংহ ভাগ সরকার কেড়ে নেয়। মানবাধিকারকর্মীদের ভাষ্য মতে, উত্তর কোরিয়া বিশ্বের বৃহৎ উন্মুক্ত কারাগার। যেখানে নেই ধর্মীয় স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, শিক্ষাগ্রহণের স্বাধীনতা, বিনোদনের অধিকার; এমনকি মুঠোফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপরও রয়েছে ব্যাপক কড়াকড়ি। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) তথ্য মতে, বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে উত্তর কোরিয়ার অবস্থান ১৮০টি রাষ্ট্রের মধ্যে ১৮০তম। একমাত্র রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বাদে আর কোনো গণমাধ্যম উত্তর কোরিয়াতে নেই। যেখানে ২৪ ঘণ্টায় কিম পরিবারের বন্ধনা করা হয়। এমনি ধর্মী প্রতিষ্ঠানে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও কিম পরিবারে বন্ধনা করা হয় এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বিষয় বাদে বাইরের কিছু শেখার অধিকারও নেই। কেউ যদি দক্ষিণ কোরিয়ার ডিবিডি দেখে, তাহলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। মামুলি অপরাধের জন্য শিরñেদ করা হয়। বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার কারাগারগুলোয় এক লাখ মানুষ বন্দি আছে। রাষ্ট্রীয় ইন্টারনেট ব্যবস্থা আছে, সেটা সবার জন্য না। কিছু অভিজাত পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ইচ্ছে করলেও কেউ বাইরের কোনো কিছু জানতে পারে না। একইভাবে জানাতেও পারে না।
ওপরের বর্ণনার চেয়ে পরিস্থিতি আরো ভয়ানক। আর সে কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, শুধু পরমাণু অস্ত্র ধ্বংস করলেই উত্তর কোরিয়ার কি বিশ্বের কাছে স্বাকৃতি পাবে? আর পুঁজিবাদী আমেরিকার সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক কীভাবে সম্ভব? পুরো রাষ্ট্রই যেখানে কড়া নিয়ন্ত্রণে চালিত, সেখানে মুক্তবিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক কতটা বাস্তব? এমন একটা সময় আসবে যখন পশ্চিমা বিশ্ব ও আমেরিকা উত্তর কোরিয়ার বংশানুক্রমিক শাসনের অবসান চাইবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইতে পারে। উত্তর কোরিয়ার মানুষও হয়তো গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য আন্দোলন শুরু করতে পারে। তখন উত্তর কোরিয়া কি গণতন্ত্র মেনে নেবে? নাগরিকদের আন্দোলন সফল হতে দেবে না কি দমনের আশ্রয় নেবে? তখন উত্তর কোরিয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাষ্ট্র চীনের অবস্থান কী হবে? ট্রাম্প-কিম চুক্তির ভবিষ্যতের বিষয়ে এসব বিষয় সামনে আসে।
দুই কোরিয়ার একত্রকরণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বাধা সামনে আসে। প্রথমত, দুই কোরিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি। কারণ দক্ষিণ কোরিয়ায় চলছে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আর উত্তরে সমাজতান্ত্রিক শাসন। উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীও সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন আর দক্ষিণের পরিস্থিতি ঠিক উল্টো। দ্বিতীয়ত, উত্তর কোরিয়ার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নাজুক। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ব্যাপক বিনিয়োগ দরকার। নেটওয়ার্ক খাতে ৬১.২ বিলিয়ন ডলার, কয়লা খাতে ১৩.১ বিলিয়ন ডলার, গ্যাস খাতে ৭.৪ বিলিয়ন ডলার, পারমাণবিক খাতে ৩০.২ বিলিয়ন ডলার এবং অন্যান্য খাতে ১০.৪ বিলিয়ন ডলারসহ মোট ১২২.৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন। (বুলমবার্গ মার্কেটস, ২৬ এপ্রিল, ২০১৮) আমেরিকা উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য সাহায্য করবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে দরজার কাছে আমেরিকার প্রভাব চীন কতটা মেনে নেবে। আর আমেরিকা সম্পূর্ণ বৈরী রাজনৈতিক আদর্শের একটি রাষ্ট্রে স্বার্থ ছাড়া বিনিয়োগ করবে কি? পরমাণু অস্ত্র ধ্বংস করলেই অবরোধ উঠে যাবে; তাহলে কি মানবাধিকারের প্রশ্ন সামনে আসবে না? যদি আসেই জাতিসঙ্ঘের ভূমিকা কী হবে? এই চুক্তি যদি ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে করা চুক্তির মতো হয়, তাহলে ট্রাম্প প্রশাসনের পরবর্তী প্রশাসন কতটা মেনে নেবে, উত্তর কোরিয়ার সার্বিক পরিস্থিতি। দুই কোরিয়ার একত্রকরণের ক্ষেত্রে ওই বিষয়গুলো সামনে আছে। তাই এক কোরিয়ার স্বপ্ন ও ট্রাম্প-কিম চুক্তি নিয়ে সংশয় ও প্রশ্ন থাকছেই।
এ চুক্তির বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের ভেতরেও ঐক্যের অভাব দেখা দিতে পারে। দৃশ্যত দুটি কারণ প্রধান। এক. দক্ষিণ কোরিয়ার ২৮ হাজার ৫০০ মার্কিন সেনা রয়েছে। ট্রাম্প দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া বন্ধ ও দ্রুত সেনা প্রত্যাহারের কথা বলেছে। কথা হলো, এতে ভূ-রাজনৈতিকভাবে মার্কিননীতি মার খাচ্ছে। তাই ট্রাম্প-পরবর্তী প্রশাসন কতটা অটল থাকবে, এ সিদ্ধান্তের ওপর তা দেখার বিষয়। আর বর্তমান প্রশাসনই বা কতটা ইতিবাচকভাবে দেখবে ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তেÑতাও দেখার বিষয়। তা ছাড়া কোরিয়া উপদ্বীপ থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হলে মার্কিন অস্ত্রের বাজার মার খাবে। বিশেষত যদি দুই কোরিয়া শান্তিপূর্ণ অবস্থানে আসে। লকহড মার্টিন, নর্থবোরা গ্রুমম্যান, জেনারেল ডায়নামিকস, রেথিউন ও বোয়িংর মতো বৃহৎ অস্ত্র উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর, যারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ট্যাক্স দিয়ে আমেরিকান অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে, তাদের অস্ত্র ব্যবসা মার খাবে। এদের ব্যাপক প্রভাবের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তিগত অবাধ অস্ত্র ক্রয় নিয়ণন্ত্র করা যাচ্ছে না। তাহলে অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কোন অবস্থানে থাকে সেটাও লক্ষণীয়।
২০০৬ সালের অক্টোবরে উত্তর কোরিয়া প্রথম পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। তখন চীনের উদ্যোগে ২০০৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি উত্তর কোরিয়া একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তির শর্তানুযায়ী উত্তর কোরিয়া তার ণড়হমনুড়হ পারমাণবিক চুল্লিটি বন্ধ করে দেবে এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের তার পারমাণবিক চুল্লি পর্যবেক্ষণ করতে দেবে। বিনময়ে উত্তর কোরিয়া পাবে ৫০ হাজার টন জ্বালানি তেল। কিন্তু চুক্তিটি টেকেনি। কারণ, উত্তর কোরিয়া চুক্তি মোতাবেক জ্বালানি তেল পায়নি ও তাদের পারমাণবিক চুল্লির বিষয় স্পষ্ট করেনি। বর্তমানে তাদের কাছে ৬০টি পারমাণবিক অস্ত্র আছে। যার মাধ্যমে উত্তর কোরিয়া মার্কিন ভূ-খ-ে ও জাপানে আক্রমণ করতে পারবে। অস্ত্রগুলো তৈরি করা হয়েছে নিজেদের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে। যদি উত্তর কোরিয়া মনমতো নিরাপত্তা না পায়, তাহলে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ কতটা সফল হয়, তাও দেখার বিষয়। অন্যদিকে ব্যাপক জ্বালানি চাহিদার বিষয়টিও সামনে আসবে। বৈরী সম্পর্কে দুটি দেশ এত সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান কীভাবে করবে? কারণ এর আগে ১১ বারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। সমস্যা সংকুল একটি ফাপা চুক্তি নিয়ে অনেক ভাবার আছে। ছয় জাতির সঙ্গে স্বাক্ষরিত ইরান চুক্তি থেকে মার্কিন প্রশাসন স্বার্থের জন্য বের হয়ে গেছে। আর দ্বিপক্ষীয় একটা চুক্তির বিষয়ে সন্দেহটা আরো জোরালো হয়।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
"