মোহাম্মদ আবু নোমান

  ২০ জুন, ২০১৮

মতামত

মাদক বনাম সমাজ

ওরা শুধু মা-বাবাকেই খুন করেনি, সমাজকেও ধ্বংস করছে। এই মাদকাসক্তরা কী মানুষ? না! ওরা দানব! পরিবারে, সমাজে মানুষের অধিকার থাকতে পারে, কিন্তু দানবের কোনো অধিকার থাকতে পারে না। এক ডাক্তার বলেন, জনৈক বাবা-মা তার চেম্বারে এসে বলেন, ‘আমার সন্তান দানব হয়ে গেছে’। যে বাবা মাথার ওপর ভালোবাসার ছায়া দিয়ে, যে মা তিলে তিলে নিজেকে ক্ষয় করে লালন-পালন করেছেন, মাদকাসক্ত হয়ে বিগত ১০ বছরে সেই সন্তানরা ২ শতেরও বেশি মা-বাবাকে খুন করেছে। শুধু মা-বাবাই নয়, মাদকাসক্তরা সরবে-নীরবে, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে, নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর সবাইকে খুন করছে। এর আগে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না তাদেরই মেয়ে ঐশীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়। ঐশী পেশাদার খুনি ছিল না। সে তার বাবা-মাকে খুন করেছিল ইয়াবা নেশায় আক্রান্ত হয়ে।

বাবা-মায়ের মধ্যে কলহ, বিবাদ থাকলে বাচ্চারা আত্মবিশ্বাসী হয় না। একজন মাদকসেবী স্ত্রীকে নিয়মিতই মারধর করে থাকে। এর প্রভাব সন্তানের ওপরও পড়ছে। যাতে পারিবারিক শান্তি নষ্টের সঙ্গে সামাজিক শান্তিও নষ্ট হচ্ছে। মাদক কারবার তো চলছে, এই মাদকাসক্তদের ডিমান্ডেই। তাই মাদক কারবারির সঙ্গে মাদকাসক্তদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হবে। এতে যদি আমরা ব্যর্থ হই বা সরকার পিছু হটে, তাহলে দেশ ভেসে যাবে। আমরা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব না। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- কেউই সমর্থন করতে পারে না, কিন্তু মাদক সমাজে এতটাই সর্বনাশ ঘটাচ্ছিল, বেশির ভাগ মানুষ মাদকবিরোধী অভিযানকে অযৌক্তিক ভাবেননি বরং সমর্থন দিয়েছে। তাই মাদক নির্মূলে সরকার যে পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে তা যেন কোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপ না হয়, বরং সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়বদ্ধতা থেকেই হয়।

দেশে বর্তমানে ৭৫ থেকে ৭৭ লাখ লোক মাদকাসক্ত। এদের ৬০ শতাংশই তরুণ। তরুণরা ব্যর্থ হলে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়। এটা গভীর দুর্ভাবনার বিষয়। ৬৮ হাজার কারাবন্দির মধ্যে ৩৭ হাজারই মাদকাসক্তের অভিযোগে অভিযুক্ত, যাদের মধ্যে বেশির ভাগই ইয়াবাসেবী। এ থেকেই মাদকের ডিমান্ডের ব্যাপারটি বোঝা যায়। প্রতি বছর মাদকের পেছনে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা নষ্ট হচ্ছে। বর্তমানে শিশু ও নারীদের মধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে, ইয়াবা ছেলেদের মতো মেয়েরাও অবলীলায় গ্রহণ করছে। কোর্ট-কাছারিতে এখন হাজার, হাজার ইয়াবা মামলা।

দেশে মাদকের ডিমান্ড যেখানে আকাশচুম্বী, সেখানে সাপ্লাই বন্ধ করা কঠিন। আরেকটি বিষয় হলো সহজলভ্য। চাইলেই যদি কেউ মাদক নিতে পারে, তবে মাদকাসক্ত হওয়ার প্রবণতা থাকবেই। মাদকবিরোধী অভিযান ও মাদক নির্মূলের ক্ষেত্রে কোনো আপস না করে মাদকাসক্তদের সঙ্গে মাদকের উৎসমূলকে চিহ্নিত করে চিরতরে এর উৎপাদন, বিপণন ধ্বংস করতে হবে। এ ছাড়া মাদকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

বর্তমানে আমাদের দেশে ইয়াবার যে রাজত্ব চলছে, এর সরবরাহ চলছে মিয়ানমার থেকে। দেশে একটা সময় ফেনসিডিলের রমরমা কারবার ছিল। বহন, রিস্ক ও লাভের প্রশ্নে সুবিধা কমে আসায় তার চাহিদা কমে এসেছে। পাশাপাশি ইয়াবার পাচার বন্ধে মিয়ানমারের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না। এর আগে সরকারি পর্যায়ে অনেকবার বৈঠক হলেও বৈঠকের কোনো সিদ্ধান্তই তারা বাস্তবায়ন করেনি। এমনকি তাদের দেশের মাদক প্রস্তুতের বড় বড় কারখানার তালিকা দিলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। জানা যায়, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও সেনাবাহিনীয় সহযোগিতায়ই মিয়ানমারে চলছে এসব মাদক তৈরির কারখানা।

মাদকাসক্তের কারণ হিসেবে দেখা যায়, নানা রকম হতাশা, ব্যর্থতা, বাবা-মায়ের কলহ, অসৎ সঙ্গসহ অন্যান্য বিষয়। এ থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন পারিবারিক শিক্ষা, অনুশাসন আর সচেতনতা। বাবা-মাকে সন্তানের মধ্যে এমন বীজ বপন করতে হবে, যাতে সে আত্মপ্রত্যয়ী হয়, অশুভকে চিনতে পারে। এই মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যে মাঠ ও পাঠাগারগুলো হারিয়ে গেছে, তা ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রতিটি ব্যক্তি, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আন্দোলন শুরু করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক কর্মকা- চালুর সঙ্গে মূল্যবোধ, সুনৈতিকতাবিষয়ক উপস্থিত বক্তৃতা, প্রবন্ধ, রচনা, দেয়াললিখন, পত্রিকা বের করার সঙ্গে এসব কর্মকা-ে যারা ভালো করবে, তাদের পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সৃজনশীলতা বেড়ে যাবে। ইন্টারনেট ও আকাশ সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দেশি-বিদেশি বিভন্ন চলচ্চিত্রের মধ্যে প্রেমপ্রীতি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মাদক গ্রহণকে ফ্যাশন ও মামুলি ব্যাপার মনে করা হয়। এসব চলচ্চিত্রের মাধ্যমে শুভবোধের শিক্ষাকেও ধ্বংস করা হয়েছে।

দেশের প্রতিটি মানুষের প্রধান যুদ্ধ হবে মাদক থেকে সমাজকে রক্ষা করা। তরুণরা লেখাপড়া শেষ করে ভালো চাকরি বা ব্যবসায় জড়াতে চায়। কিন্তু সেই সুযোগটা দেশে এখন অত সহজ নয় বললেই চলে। বেকার থাকায় হতাশা আর অবসাদ ঘিরে রাখে তাদের। এ জন্য তাদের এই হতাশা দূর করার প্রশ্নে কাজের সুযোগ তৈরি এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। আর এই কর্মসংস্থান তৈরির দায়িত্ব মূলত সরকারকেই নিতে হবে। তাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে অবশ্যই উৎপাদন খাতের অগ্রাধিকার থাকতে হবে কমপক্ষে ৭০ ভাগ। বর্তমানে সরকারের পরিকল্পনার প্রায় পুরোটা জুড়েই রয়েছে অনুৎপাদনশীল খাতের বাহুল্য। যদিও অবকাঠামো উন্নয়নে এ দেশে উল্লেখ করার মতো বেশ কিছু কাজ হয়েছে, যা ভবিষ্যতে উৎপাদনশীল কর্মে সহযোগিতা করবে। কথায় আাছে, ‘কাজ না থাকলে মানুষ কুকর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ে। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার প্রশ্নে তাকে অনেকটা বাধ্য হয়েই এ পথে পা বাড়াতে হয়। এখান থেকে তাদের সরিয়ে আনতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন বেকারত্ব থেকে এই জনগোষ্ঠীকে বের করে আনা। আর এ জন্য প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

গবেষণা থেকে দেখা যায়, জেনেটিক কারণ, কখনো কখনো হতাশা, বেকারত্ব ইত্যাদি কারণে একজন মানুষ মাদকাসক্ত হতে পারে। মাদকে এমন একটি কেমিক্যাল থাকে, যা মস্তিষ্কের বিশেষ অংশকে আন্দোলিত করে, মাদক ব্রেনের কোষে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটায় ও অদ্ভুত আনন্দের সৃষ্টি হয়, যা শুরুতে আনন্দদায়ক হলেও পরবর্তী সময়ে মারাত্মক ক্ষতিকর ও বেদনাদায়কের কারণ হয়। এতে লিভার, হার্ট ও কিডনি নষ্ট হয়। কেউ কেউ আনন্দ পেতে, কেউ দীর্ঘ সময় নাচ-গান করতে, বা সখের বসে মাদকের হাতে খড়ি হয়। পরে আর এ অভ্যাস থেকে ফিরে আসতে পারে না।

দেশে মাদক নিয়ন্ত্রণের সক্রিয় অধিদফতর অতীতে ছিল বর্তমানেও আছে। আজকের এই অবস্থানটি এক দিনে আসেনি। মাদকের সহজলভ্য নিয়ন্ত্রণে তারা কী করলেন? মূলকথা হলো, তাদের কাজটি যদি তারা আন্তরিকভাবে করতেন তাহলে হয়তো দেশ ও জাতির অবস্থা এতটা তলানিতে এসে ঠেকত না।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist