ড. ফোরকান আলী

  ১৯ জুন, ২০১৮

পরিবেশ

পৃথিবীকে রক্ষা করতে হবে

সুনামি, ক্যাটরিনা, সিডর, নারগিস প্রভৃতি শব্দের সঙ্গে আজ বিশ্ববাসী ব্যাপকভাবে পরিচিত। কারণ গত কয়েক বছরে বিশ্বব্যাপী যে হারে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হেনেছে, তা গত শতাব্দীতেও পরিলক্ষিত হয়নি। অথচ বিজ্ঞানীদের মতে, পরিবেশের ভারসাম্যহীনতাই এর একমাত্র কারণ। তারা আরো হুশিয়ার করে দিয়েছেন, বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে আগামী দিনে পৃথিবী নামক এ গ্রহটির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে। তাই আজ বিশ্বব্যাপী পরিবেশ রক্ষার তাগিদে সবার মধ্যে একই সুর পরিলক্ষিত হচ্ছে। পরিবেশকে বাঁচানোর তাগিদে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় সুইডেনের স্টকহোমে ১৯৭২ সালে। এ বৈঠকে গৃহীত পদক্ষেপগুলো কাগজে-কলমে থাকায় এবং বিশ্বব্যাপী এর কোনো বাস্তব প্রয়োগ না হওয়ায় অচিরেই পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয়। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে বিশ্ববাসী। এর ফলে ‘পৃথিবীকে বাঁচাও এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অত্যধিক নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তোলো’Ñসেøাগানকে সামনে রেখে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে ১৯৯২ সালের ৩ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলন, যা ধরিত্রী সম্মেলন নামে পরিচিত। ওই সম্মেলনে পৃথিবীর ১৭৮টি দেশের প্রতিনিধি এবং বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত এনজিও সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেন। এ সম্মেলনে ও পশ্চিমা দেশগুলোর অবাধ্য আচরণ সুস্পষ্ট রূপে বিশ্ববাসীর সামনে ফুটে ওঠে। ওই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবমালায় স্বাক্ষর করতে অনীহা প্রকাশ করেন। কারণ, পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য ধরিত্রী সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবগুলো মেনে চললে নাকি তাদের দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। রিও আয়োজকরা পরিবেশ ও পৃথিবীর উন্নয়নকল্পে ৭০ লাখ মার্কিন ডলার বরাদ্দের প্রস্তাব রেখেছেন। কিন্তু শোষণকারী বিশ্বের মোড়ল দেশগুলো তার চরম বিরোধিতা করেছিল। অথচ বিশ্বের পরিবেশ দূষণের জন্য ৮০ শতাংশ তারাই দায়ী। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, তারা এ ব্যাপারে এতটুকু ছাড় দিতেও নারাজ। পশ্চিমা দেশগুলোর শিল্পের কাঁচামাল জোগানোর ফলে বিশ্বের ‘ফুসফুস’ বলে খ্যাত রেইনফরেস্ট আজ বিলীন প্রায়। প্রত্যেক বছর ৪০ লাখ হেক্টর রেইনফরেস্ট উজাড় করা হচ্ছে, এর মধ্যে এশিয়ার রয়েছে সিংহভাগ অর্থাৎ পায় ২০ লাখ হেক্টর। ফাওয়ের মতে, একটি দেশের পরিবেশ স্থিতিশীল থাকার জন্য মূল ভূখ-ের অন্তত ২৫ শতাংশ বনভূমি প্রয়োজন। অথচ আমাদের এ সুজলা সুফলা দেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ ছিল বনাঞ্চলে ভরপুর। যেখানে ১৯৬৫ সালে দেশের বনভূমির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৬ শতাংশ, তা বর্তমানে এসে দাঁড়িয়েছে ৭-৮ শতাংশে। মানুষের ধারণা প্রকৃতির ধারণ-ক্ষমতা অসীম। বর্তমান শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত মানুষের বদ্ধমূল এ ধারণা ছিল। মানুষ পরিবেশকে যতই দূষিত করুক না কেন। প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে তা পরিশোধন করতে সক্ষম। ষাটের দশকে এ নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। আশির দশকে বিশেষজ্ঞরা প্রকৃতির সীমিত ক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। নব্বইয়ের দশকে এসে অনুধাবন করেন, পরিবেশ বিবেচনাকে বাইরে রেখে টেকসই উন্নয়ন আদৌ সম্ভব নয়। উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোয় এ পর্যন্ত পরিবেশ সম্পর্কিত কল্পনা-জল্পনা ও উৎসাহের কমতি নেই। আশির দশকের প্রথমে টোকিওতে অনুষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ দলের আলোচনা সভায় এবং ব্যাংককে অনুষ্ঠিত আন্তঃসরকারি আলোচনা সভায় এ বিষয়গুলো বিশ্লেষিত হয়। উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, যুক্তরাষ্ট্র বা জাপানের উন্নয়নে গতিধারার কখনো কখনো যে স্তিমিত অবস্থা লক্ষ করা গেছে। তার পেছনে পরিবেশকে গুরুত্ব না দেওয়া কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পরিবেশ বিবেচনাকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন আদৌ সম্ভব নয়। তবে যদি হয় সেটা হবে ভারসাম্যহীন এবং অপরিপক্ব উন্নয়ন। তবে এদের সবাই একমত, টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিবেশ বিবেচনা আবশ্যক।

আশির দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন ব্যবস্থাপক ও প্রকল্প ব্যবস্থাপকদের মুখে টেকসই উন্নয়ন কথাটি খুব বেশি শোনা যায়। প্রকল্প ব্যবস্থাপকদের মতে, যদি কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নকাল শেষেও কোনো রকম বহিঃপৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই টিকে থাকতে পারে, তবে তাকে বলা হয় টেকসই প্রকল্প। আর এ জাতীয় উন্নয়নের গতিধারাকে বলা হয় টেকসই উন্নয়ন। উন্নয়নশীল বিশ্বের দারিদ্র্য, আন্তর্জাতিক অসমতা, টেকসই উন্নয়ন এগুলো হচ্ছে পরিবেশ ও উন্নয়নের মৌলিক বিষয়। টেকসই উন্নয়ন হলো এমন এক ধরনের উন্নয়ন, যা অধিকতর নিরপেক্ষ অর্থনৈতিক অগ্রগতি আনয়নে অবদান রাখে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্থানীয় ও বিশ্ব পরিবেশকে সংরক্ষণ করে এবং সঠিক অর্থে জীবনের মানোন্নয়ন ঘটায়।

বৈজ্ঞানিক আবিস্কার এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন মানুষকে বস্তুগত ও নানাবিধ ভোগ-বিলাসের স্বাদ দিয়েছে। আর তাই বস্তুগত সম্পদ পাওয়ার আশা কখনো হ্রাস পায় না। সম্পদের ব্যবহার ক্রমেই বেড়েই চলেছে। সেটা এ কারণে যে, আমরা সংখ্যায় অনেক বেশি এবং আমাদের খুব স্বল্পসংখ্যক লোকেই অনেক কিছু দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে গভীর চিন্তাভাবনা করে থাকেন। যার জন্য অনেক কিছুই আমাদের জীবনযাপনের এমনকি বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং সমগ্র সমাজেই জীবম-লের ওপর আচরণের পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তাই, পৃথিবীকে রক্ষা করতে হলে পরিবেশকে বাঁচাতে হবে ও আমাদেরও বাঁচতে হলে পেিববেশে দূষণের মতো ক্ষতিকর অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

লেখক : গবেষক ও শিক্ষাবিদ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist