এস এম মুকুল

  ১৯ জুন, ২০১৮

শিক্ষা

সাফল্যের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশ প্রথম স্থানে অবস্থান করছে। ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়ার ফলে গ্রামে বসেই যেকোনো শিক্ষার্থী উন্নত বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছে। একসময় নারী শিক্ষা ছিল শুধু উচ্চবিত্ত ও শহরের কিছু পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় ৬০ ভাগ নারী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। গত একদশকে শিক্ষার সর্বস্তরেই চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি হয়েছে। শিক্ষার এই ব্যাপক অগ্রগতি ও সক্ষমতা অর্জন দেশের অর্থনীতির ভিত্তিকেও মজবুত করে তুলেছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এমন অবিস্মরণীয় সাফল্যে যার অবদান অনবদ্য ভূমিকায় তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াসে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, কৃষি এবং অন্যান্য সেক্টরে উন্নয়নের হাওয়া বইছে। নিরক্ষরতা দূরীকরণেও অর্জিত হয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য। এক দশক আগে যেখানে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ছিল ৬১ শতাংশ, বর্তমানে সেখানে প্রাথমিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় শতভাগ। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তির হার ছিল ৫১ শতাংশ, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২ শতাংশ। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ভর্তির হার ছিল ৩৩ শতাংশ, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৪৪ শতাংশ। ২০০৯ সালে ৯ শতাংশ শিশু বিদ্যালয়ে যেত না। যারা যেত তাদের ৪৮ শতাংশ পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা শেষ করার আগেই ঝরে যেত। এখন প্রায় শতভাগ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়। প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ৪৮ থেকে ২১ শতাংশে নেমেছে। আশার খবরটি হচ্ছে, আমাদের দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা ও মানবসম্পদের উন্নতি সমান্তরালভাবে এগিয়ে চলেছে।

শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের সাফল্যের প্রশংসা করেছেন জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা। ফ্রান্সের প্যারিসে এক সভায় তিনি বলেন, সবার জন্য শিক্ষা (ইএফএ) লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে থাকা দেশগুলো বাংলাদেশের সাফল্যের দৃষ্টান্ত কাজে লাগাতে পারে। সেখানে আরো বলা হয়েছে শিক্ষার অগ্রগতি ও প্রসারের কারণেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বেগবান হচ্ছে। ১৯৮০ সালে মাধ্যমিক পর্যায়ে ১০০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্র ছিল ৭৪ জন, আর ছাত্রী ছিল ২৬ জন। এটা গড় হিসাব; গ্রামে ছাত্রীর সংখ্যা খুবই কম ছিল। ১৯৯৪ সালে কোনো ধরনের শিক্ষাগ্রহণ না করা নারী ছিল ৩৬ শতাংশ। এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এক দশক আগে প্রাথমিকে শতকরা ৬১ ভাগ শিক্ষার্থী ভর্তির রেকর্ড ছিল। বর্তমানে শতভাগ শিশু স্কুলে যাচ্ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে, বিশেষ করে প্রাথমিকে ও মাধ্যমিকে, জেন্ডার সমতা নিশ্চিত হয়েছে। এখন এই দুই পর্যায়ে ছেলের চেয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। এটাকে বর্তমান সরকারের বড় সাফল্য বলে অভিহিত করেছেন শিক্ষাবিদরা।

সরকারের নানা পদক্ষেপের কারণে উচ্চশিক্ষায়ও অংশগ্রহণ বেড়েছে। প্রায় ৩১ লাখ শিক্ষার্থী বর্তমানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। বর্তমানে ৩৭টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ৮৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। মোট শিক্ষার্থীর ৬৩ শতাংশ পড়ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। গবেষণার সুযোগও বাড়ছে। একসময় বছরে প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী শুধু ভারতে উচ্চশিক্ষা নিতে যেত। এখন তা শূন্যের কোঠায় নেমেছে। বরং দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালগুলোয় বর্তমানে ১ হাজার ৬৩০ জন বিদেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ছয়-সাত বছরের মধ্যে উচ্চশিক্ষায়ও ছেলেমেয়ে সমতা অর্জিত হবে।

প্রথম ক্লাসেই সারা দেশে সব ছাত্রছাত্রীর হাতে বই পৌঁছে দেওয়া সরকারের সফলতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। ২০১০ থেকে ২০১৬ সালে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বছরের প্রথম দিবসে ১৮৯ কোটি ২১ লাখ ১৮ হাজার ৮৯৫টি পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে পৌঁছে দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সফলতার অনন্য রেকর্ড গড়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে শিক্ষা খাতে সবচেয়ে দুঃসাহসিক, যুগান্তকারী ও আশাজাগানিয়া বিশাল সফল কর্মযজ্ঞ হলো বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি এবং ঝরে পড়া রোধের লক্ষ্যে ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষ হতে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত সবস্তরের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করছে। বিশ্বের কোনো দেশে এত বই বিনামূল্যে বিতরণের রেকর্ড নেই।

দেশের প্রায় ৯৬ শতাংশ শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। নিরক্ষরতা দূরীকরণেও অর্জিত হয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য। দশ বছর আগে যেখানে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ছিল ৬১ শতাংশ। বর্তমানে সেখানে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের সংখ্যা শতভাগ। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তির হার ৫১ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬২ শতাংশ, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ভর্তির হার ৩৩ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৪ শতাংশ এবং কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরি শিক্ষায় ভর্তির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশে। বাংলাদেশে বয়স্ক শিক্ষার হার উন্নীত হয়েছে ৫৯ শতাংশে। ইতোমধ্যেই জেন্ডার সমতা অর্জন হয়েছে। বিনামূল্যে বই বিতরণ ও উপবৃত্তি কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে ছাত্রীদের ভর্তি হার বৃদ্ধি পেয়ে ৫৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে স্নাতকপর্যায়ে নারী শিক্ষার হার প্রায় ৫০ ভাগ। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নারী শিক্ষার হার প্রায় সমান সমান। শিক্ষা ক্ষেত্রে জেন্ডার সমতায় ইতোমধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জিত হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে লিঙ্গীয় অসমতা অনেক কমেছে। ২০ বছরের কম বয়সী পুরুষদের মধ্যে স্কুলে অংশগ্রহণের হার ৬৪ শতাংশ এবং নারীদের ক্ষেত্রে এই হার ৫৭ শতাংশ। এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি মেয়ে মাধ্যমিক স্কুলে পড়াশোনা করতে পারে। মাধ্যমিক পর্যায়ে এখন ছেলের চেয়ে মেয়ের সংখ্যা বেশি। মেয়েদের ক্ষেত্রে নেট ভর্তির হার ৪৪ থেকে বেড়ে ৫৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর ছেলেদের ক্ষেত্রে এ হার ৩২ থেকে ৪৫ শতাংশ হয়েছে।

স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত অর্থের অভাবে শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা নিশ্চিতকরণে উপবৃত্তি প্রদানের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে এবং এই ট্রাস্ট ফান্ডে সরকার এক হাজার কোটি টাকা সিড মানি প্রদান করেছে। এই তহবিল থেকে এখন ১ কোটি ২৮ লাখ শিক্ষার্থী বৃত্তি পাচ্ছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে স্নাতক (পাস) ও সমমান পর্যায়ে ছাত্রীদের জন্য এ ফান্ড থেকে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৭২৬ ছাত্রীকে মোট ৭৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা উপবৃত্তি দেওয়া হয়েছে। এর ফলে কোনো শিক্ষার্থী দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না। এই তহবিল গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা অব্যাহত রাখতে এবং তাদের অভিভাবকদের বোঝা লাঘবে সহায়তা করছে।

বর্তমান সরকার এ পর্যন্ত ৩ হাজার ১৭২টি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করেছে। এ ছাড়া, ৩১০টি মডেল স্কুল, ৭০টি স্নাতকোত্তর কলেজ, ২০টি সরকারি বিদ্যালয় এবং ৩৫টি মডেল মাদরাসায় কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন এবং প্রয়োজনীয় কম্পিউটার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হচ্ছে।

আমাদের দেশে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাসের পর ছাত্রছাত্রীরা উচ্চশিক্ষার জন্য বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, কেউ মেডিকেলে, কেউ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। আবার যারা উচ্চশিক্ষার এসব ক্ষেত্রে চান্স পায় না, তারা কলেজে সাধারণ ডিগ্রি পড়ে অথবা কলেজের অনার্স কোর্সে ভর্তি হয়। আর্থিক সংগতিসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে গমন করেন। উচ্চশিক্ষা বিস্তারের জন্য অনুমোদিত নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৮টি। এ ছাড়া নতুন ২৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন প্রদান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ আইন-২০১৩ মহান জাতীয় সংসদে অনুমোদন হয়েছে। আরো পাঁচটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইনের খসড়া প্রস্তুতির কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া ৩৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা দুই লাখ। আর ৯২টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় ডিগ্রি কলেজগুলো পরিচালিত হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করে এখন এর কার্যকারিতা আরো বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে উচ্চশিক্ষাঙ্গনে ভর্তির বেশ কিছু সুযোগ উন্মোচিত হয়েছে। নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় বাংলাদেশেই এখন বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে। উচ্চশিক্ষায় সাফল্যের ধারাবাহিকতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সাম্প্রতিক সময়ে সীমিত পরিসর থেকে ক্রমেই বিকশিত হচ্ছে।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist