রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৯ জুন, ২০১৮

আন্তর্জাতিক

বিশ্বকে দুই নেতার মেসেজ

উত্তাল বিশ্ব রাজনীতির পরিম-লে সমাজতান্ত্রিক ও মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী কমিউনিস্টশাসিত এ দেশটি পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করে আমেরিকার মাথাব্যথা বাড়িয়ে দিয়েছে অনেক আগেই। খবরে প্রকাশ, উত্তর কোরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা কিম ইল সাংয়ের ১০৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সামরিক মহড়ায় দুটি আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের প্রদর্শনী করেছে দেশটি। ৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে এ ক্ষেপণাস্ত্র দুটি যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখ-ে যেকোনো স্থাপনায় আঘাত হানতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনায় বিষয়টা হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইনের আলোচনামুখী নীতি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর নিষেধাজ্ঞা খুবই কার্যকর হয়েছে। প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইনের উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ‘আলোচনায় বিশ্বাসী’ নীতি উত্তর কোরিয়ার ও দেশটির মিত্র শক্তি চীনের রাজনৈতিক সমাজকে প্রবলভাবেই আশ্বস্ত করেছে। মুন জে-ইন যে কোরীয় উপদ্বীপ এলাকাকে স্থিতিশীল রাখতে চাচ্ছেন, কোনো ধরনের যুদ্ধে লিপ্ত হতে চাচ্ছেন নাÑএই মেসেজটি খুব পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। ফলে দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান সম্পর্কে উত্তর কোরিয়ার আর কোনো সন্দেহ নেই। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের একের পর এক কঠোর নিষেধাজ্ঞায় উত্তর কোরিয়া বেশ বেসামাল হয়ে ওঠে। সেই নিষেধাজ্ঞার প্রভাব চীনের ওপরও ঋণাত্মকভাবে পড়ছে। উত্তর কোরিয়া যদি দেশটির পরমাণু কর্মসূচি বিশ্বসমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে চালিয়ে যায় এবং আরো কঠোর নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে, সেটি পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক যুদ্ধে রূপ নেবে। আর এ কারণেই পরমাণু কর্মসূচি থেকে সরে আসতে চীন বারবার উত্তর কোরিয়াকে চাপ দিচ্ছিল। উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচি দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অস্থির করে রেখেছে, বিষয়টি কেবল তা নয়। চীনও বড় ধরনের অস্বস্তিতে রয়েছে এবং উত্তর কোরিয়া চীনের জন্য বহুমুখীয় সমস্যা তৈরি করছে।

উত্তর কোরিয়ার বেপরোয়া নীতির পেছনের শক্তি চীন, সেই ধারণাটি বিশ্বসমাজে প্রতিষ্ঠিত। এমনকি প্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্ক উন্নয়নের বড় বাধাগুলোর একটি হলো উত্তর কোরিয়ার বেপরোয়া আচরণের প্রতি চীনের মৌনতা। খুব নাটকীয়ভাবে কোরীয় উপদ্বীপের ভূ-রাজনীতি মেরূকরণ হচ্ছে। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের ছোট বোন কিম ইয়ো জং দক্ষিণ কোরিয়াতে শীতকালীন অলিম্পিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। তার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই কোরীয় উপদ্বীপের ভূ-রাজনীতির মেরূকরণটি বিশ্ববাসী জানতে পারে। তবে পর্দার আড়ালে কয়েক মাস ধরেই আলোচনা চলছিল। আলোচনার পাশাপাশি উত্তর কোরিয়ার ওপর আরোপিত ছিল কঠোর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। মোটা দাগে এই দ্বিপক্ষীয় পদক্ষেপই উত্তর কোরিয়াকে আলোচনার টেবিলে ফেরাতে ভূমিকা রেখেছে। উত্তর কোরিয়ার ওপর অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিষেধাজ্ঞার ফলে চীনের অর্থনীতি জড়িয়ে পড়ছে। চীনের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর এমনিতেই ট্যারিফ যুদ্ধে দেশ দুটি লিপ্ত। এমতাবস্থায় উত্তর কোরিয়ার ওপর ক্রমবর্ধিষ্ণু নিষেধাজ্ঞা থেকে চীন নিজের অর্থনীতিকে বেশিদিন আগলিয়ে রাখতে পারছে না। উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রকে কোরীয় উপদ্বীপে অবস্থানের বৈধতা দেয়। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বহুমাত্রিকভাবেই চীনের উত্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তা ছাড়া উত্তর কোরিয়া যদি পরিপূর্ণ পারমাণবিক বোমা অর্জনকারী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়, সেটি কোনো একসময় চীনের জন্যও ‘ব্যাকলাশ’ হয়ে উঠতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমাদের দুটি প্যারামিটার বিবেচনায় নিতে হবে। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্রের দিকে ধাবিত হতে পারে। প্রযুক্তির শীর্ষে থাকা জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে অল্প সময়ে শত শত পারমাণবিক বোমা বানানো অসম্ভব নয়।

যদি জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া পারমাণবিক বোমার অধিকারী হয়, সেটি চীনের জন্যও ভালো হবে না। তা ছাড়া আজ উত্তর কোরিয়া চীনের কৌশলগত বন্ধু। সময়ের পরিক্রমায় ও ভূ-রাজনৈতিক নব্য মেরূকরণের কারণে উত্তর কোরিয়া আমেরিকার দলে ভিড় করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত জাপান এখন আমেরিকার বিশ্বস্ত বন্ধু। যে ভিয়েতনামকে আমেরিকা বিধ্বস্ত করে ফেলেছিল, সেই ভিয়েতনামও এখন আমেরিকার কাছের বন্ধু। আমেরিকার কাছ থেকে উত্তর কোরিয়ার অভিজ্ঞতা এখনো জাপান ও ভিয়েতনামের মতো হয়নি। ফলে উত্তর কোরিয়া ও আমেরিকার বন্ধুত্ব যেকোনো সময় হয়ে উঠতে পারে।

এখন প্রশ্ন হলো, উত্তর কোরিয়া কী কেবল দক্ষিণ কোরিয়ার আলোচনার নীতি ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণেই পরমাণু কর্মসূচির বাতিলের মতো এজেন্ডা নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। নাকি আর অন্য কোনো কারণ আছে? উল্লিখিত দুটি কারণ ছাড়াও আরো দুটি বড় কারণ উত্তর কোরিয়াকে আলোচনায় আসতে সহযোগিতা করছে। যদি উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সথেঙ্গ যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তবে অন্য কোনো দেশকে উত্তর কোরিয়া পাশে পাবে না। সামরিক শক্তি দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে উত্তর কোরিয়া শিশুর মতো। উত্তর কোরিয়া চীনের কাছে জানতে চেয়েছিল যদি উত্তর কোরিয়া আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তখন চীন কি পাশে থাকবে? চীন উত্তর কোরিয়াকে সরাসরি ‘না’ জানিয়ে দিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র হামলা করলে নিজেদের কী ক্ষতি হতে পারে সেই হিসাবটি উত্তর কোরিয়া ভালোভাবেই পর্যালোচনা করেছে। উত্তর কোরিয়া যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জাপান হয়ে উঠতে পারে, সেটি তারা ভালো করেই আন্দাজ করতে পেরেছে। এতে যদি শুধু উত্তর কোরিয়ার ‘কমিউনিস্ট’ শাসনব্যবস্থারও পরিবর্তন হয়, দেশটির অস্তিত্বই থাকবে না।

এখানে আমাদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ কোরিয়া তার নিজের মতো করেই সিদ্ধান্ত নেবে। কোরীয় উপদ্বীপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্মকা- চিরতরে বন্ধ করার বিনিময়ে যদি অঞ্চলটিতে শান্তি আসে, তাতে দক্ষিণ কোরিয়ার খুশি হওয়ারই কথা। আলোচনায় যদি এমনটি মনে হয় যে উত্তর কোরিয়া এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য আসলেই সিরিয়াস, সেই ক্ষেত্রে আলোচনায় টেবিলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা দুর্বল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোটের ইতি টানার দিকে চলে যেতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ প্রাধান্য নাও পেতে পারে। অধিকন্তু, কোরীয় উপদ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক খরচের একটি বড় অংশ মেটাতে হয় দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণের ট্যাক্সের টাকায়। দ্বিতীয়ত, উত্তর কোরিয়া গ্যারান্টি চাইবে যেন দেশটির কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার অবসান না হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উত্তর কোরিয়াকে শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে যে, যুক্তরাষ্ট্র পিয়ংইয়ংয়ের শাসনব্যবস্থা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা দেখাবে না। যদি সামান্যতম বিশ্বাসের ঘাটতি থাকে, আলোচনা ফলপ্রসূ হবে না। উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচিটি কেবল দেশটির নিরাপত্তার সঙ্গেই সম্পর্কিত নয়, শাসক গোষ্ঠীর ক্ষমতায় থাকার হাতিয়ারও বটে। প্রসঙ্গত, ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগেও যুক্তরাষ্ট্রের তিনজন প্রেসিডেন্ট : জর্জ ডব্লিউ বুশ, বিল ক্লিনটন ও বারাক ওবামা, উত্তর কোরিয়াকে দেশটির নিরাপত্তা ও শাসক গোষ্ঠীর অপরিবর্তনের বিষয়ে আশ্বস্ত করলেও উত্তর কোরিয়া বিশ্বাস করতে পারেনি। উল্লিখিত তিনজন প্রেসিডেন্ট উত্তর কোরিয়াকে নিরাপত্তার গ্যারান্টিও দিয়েছিল। তৃতীয়ত, উত্তর কোরিয়া চাইবে খুব দ্রুতই যেন দেশটির ওপর থেকে সব ধরনের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞার ফলে অর্থনৈতিকভাবে দেশটি ভেঙে পড়ছে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলে দেশটি চীনের ছাতার নিচে থেকেই এগিয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের সামরিক অবস্থান হারিয়ে উত্তর কোরিয়াকে ডি-নিউক্লিয়ারাইজেশন করতে আগ্রহী হবে কি না ভাবতে হবে। যদি যুক্তরাষ্ট্রকে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে জোট বাদ দিতে হয়, এ অঞ্চলে চীনের বহুমাত্রিক উত্থানকে মোকাবিলা করা দেশটির পক্ষে অসম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্র এমন কৌশলী সুযোগ হাতছাড়া করবে কি না-সেটি এখন বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist