সাধন সরকার

  ১৫ জুন, ২০১৮

মতামত

বর্জ্যশ্রমিকের জীবনযাপন

দার্শনিক হরেক বলেছেন, ‘যে অন্যকে পরিচ্ছন্ন করার কাজে নিয়োজিত সে কিন্তু নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখে না।’ এ উক্তি বা লাইনটির সঙ্গে বর্জ্যশ্রমিকদের জীবনের বয়ে যাওয়া ‘লাইনের’ (রোজকার জীবনের) মিল পাওয়া যায়। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত মিলিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য শহরগুলোতে প্রায় চার লাখ বর্জ্যশ্রমিক কাজ করে। এর মধ্যে শুধু ঢাকা শহরে কাজ করে প্রায় দুই লাখ বর্জ্যশ্রমিক। নগরের হতদরিদ্র এ জনগোষ্ঠী বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত থাকলেও নিজের জীবনের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থেকে তারা বঞ্চিত। বর্জ্যশ্রমিকরা নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সমস্যার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে থাকে। যে স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পেশাগত নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে মৃত্যুর হাতছানি! অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটা পেশায় নিয়োজিত থেকেও বর্জ্যশ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক কোনো সুযোগ-সুবিধা এখনো গড়ে ওঠেনি। বর্জ্যশ্রমিকদের জীবন যেন এক অবহেলা ও বঞ্চনার নাম। ঢাকা শহরে দৈনিক প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। এসব বর্জ্যরে বেশির ভাগ মূলত গৃহস্থালি, প্রাতিষ্ঠানিক, বাণিজ্যিক, রাস্তাঘাটে ফেলা বর্জ্য, কারখানা ও বিভিন্ন ধরনের নির্মাণকাজ বা ঘরবাড়ি ভাঙার বর্জ্য। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন পর্যায়ের কাজের সঙ্গে বর্জ্যশ্রমিকরা নিয়োজিত থাকে। এর মধ্যে রয়েছেÑ বাসাবাড়ি থেকে ভ্যানে করে বর্জ্য সংগ্রহ করা শ্রমিক এবং তা নিকটস্থ ডাস্টবিনে ও ট্রান্সফার সেন্টারে নিয়ে যাওয়া ভ্যানচালক ও হেলপার; সিটি করপোরেশনের রাস্তার ঝাড়–দার; রাস্তার পাশের ডাস্টবিন, খোলা রাস্তার ওপর বা ড্রেনে জমা বর্জ্য সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার ময়লার ট্রাকে ওঠানো এবং তা আবর্জনার স্তূপে ফেলার শ্রমিক। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা স্থায়ী ও অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকরিতে নিয়োজিত থাকলেও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা রাস্তা, ডাস্টবিন বা বর্জ্য ডাম্পসাইট থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে বিক্রির মাধ্যমে তারা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। উভয় ক্ষেত্রের শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিয়ে সচেতন নয়। কাজ করার সময় বর্জ্য শ্রমিকরা প্রতিরক্ষামূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। কাজের সময় তারা পায়ে জুতা, হাতে গ্লাভস ও মুখে মাস্ক পরে না কিংবা ন্যূনতম কোনো ঝুঁকি সম্পর্কেও তারা সচেতন নয়। বিভিন্ন কাজ করার সময় বর্জ্য শ্রমিকদের হাত-পা কেটে যায়, থেঁতলে যায়, দুর্ঘটনায় কখনো কখনো অঙ্গহানিও ঘটে। এসবই ঘটে বর্জ্য সংগ্রহকারীদের জ্ঞান ও সচেতনতার অভাবের কারণে। বর্জ্যশ্রমিকরা জানেনই না যে ময়লা-আবর্জনার জীবাণু থেকে কঠিন কোনো রোগব্যাধি শরীরে বাসা বাধতে পারে।

প্রকৃত অর্থেই ঢাকা শহরের বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থা আদৌ পরিবেশসম্মত নয়। এখানে সব ধরনের বর্জ্য একই সঙ্গে সংগ্রহ করা হয়! কিন্তু যদি ক্যাটাগরি ভাগ করে যেমনÑ গৃহস্থালি বর্জ্য, শিল্প ও বাণিজ্যিক বর্জ্য, মেডিকেল বর্জ্য, নালার বর্জ্য, কঠিন বা তরল বর্জ্য প্রভৃতি আলাদা আলাদাভাবে সংগ্রহ করা হতো তাহলে যেমন বর্জ্য সংগ্রহ করা সহজ হতো তেমনি বর্জ্যরে রিসাইক্লিং করাও সুবিধা হতো। কেননা, একেক ধরনের বর্জ্যে একেক ধরনের রোগজীবাণু ও স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করার ফলে বর্জ্যশ্রমিকদের বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি শরীরে অজান্তে বাসা বাধে। এর মধ্যে রয়েছে- ধনুষ্টঙ্কার, হাঁপানি, শ^াসকষ্ট, টাইফয়েড, কলেরা, যক্ষ্মা, আমাশয়, ডায়রিয়া, জন্ডিস, নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়া, এইচআইভি সংক্রমণ ও নানা ধরনের চর্মরোগ। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয় খাতের শ্রমিকরা নানা অব্যবস্থাপনার শিকার।

বর্জ্য শ্রমিকরা সাধারণত অশিক্ষিত। এরা নিজেদের স্বাস্থ্যসচেতনতা সম্পর্কে জানে না বললেই চলে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশুশ্রমিকও রয়েছে। এসব শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং জীবন ও জীবিকার উন্নয়নে নেই কোনো উদ্যোগ। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকরা দুর্ঘটনা বা শারীরিক কোনো ক্ষতির শিকার হলে তারা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কোনো সুবিধা পায় না। আপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিকরা ঢাকার মোট বর্জ্যরে প্রায় ১৫ শতাংশ পুনঃপ্রক্রিয়া ও পুনর্ব্যবহার করে থাকে। যার মূল্য কোটি কোটি টাকা। জাতীয় অর্থনীতিতে এ খাতের (অপ্রাতিষ্ঠানিক) বড় ধরনের অবদান থাকলেও বর্জ্য শ্রমিকরা বরাবরই রয়ে গেছে অবহেলিত । ঢাকা শহরে তো বটেই অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোতে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখনো গড়ে ওঠেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন জমা হওয়া বর্জ্যরে প্রায় ৭০ ভাগ সিটি করপোরেশন সংগ্রহ করতে পারে। বাকি ময়লা-আবর্জনা ও বর্জ্য এখানে-সেখানে রয়ে যায়। তাই আধুনিক, বাসযোগ্য, পরিচ্ছন্ন ও সবুজ শহর গড়তে হলে টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি বর্জ্য রিসাইক্লিং ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। এ ছাড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিত বর্জ্যশ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিকে নজর দিতে হবে। বর্জ্য শ্রমিকরা আর কতকাল অবহেলিত থাকবে? অন্যান্য পেশার মানুষের মতো তাদেরও জীবন আছে, ভবিষ্যৎ আছে, আছে সুন্দরভাবে বাঁচার অধিকার। রাষ্ট্রের চোখে, সমাজের চোখে বিশাল এই জনগোষ্ঠী দিনের পর দিন উপেক্ষিত থাকতে পারে না। বর্জ্য ব্যবস্থা সম্পর্কিত যেসব আইন রয়েছে সেসব আইনে বর্জ্যশ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক সুযোগ-সুবিধা ও পেশাগত নিরাপত্তার বিষয়টি উল্লেখ থাকতে হবে। কর্মক্ষেত্রে প্রত্যেক বর্জ্যশ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন সমাজের বিবেকসম্পন্ন মানুষ।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist