রহিম আবদুর রহিম

  ১৫ জুন, ২০১৮

মাদক

সাধু...সাধু...সাধু সাবধান

কয়েক বছর আগে এক শুভাকাক্সক্ষী আইনজীবীর সঙ্গে কথা হয়েছিল। তিনি তার আইনপেশার অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘তিনি এক গরু চুরির অপরাধে অভিযুক্ত আসামির মামলা পরিচালনা করছিলেন। বিচার চলাকালীন এই আসামির জামিন হয়। জামিনের পর আইনজীবি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, একটি গরু চুরি করলে কত আয় হয়? জবাবে সে বলেছিল ৩০০ টাকা। আইনজীবি অবাক! একটি গরুর মূল্য ৩০০ টাকা? উত্তরে তিনি বলেছে, না। থানা পুলিশ থেকে শুরু করে, গ্রামের চৌকিদার, টাউট-বাটপার, মেম্বার-চেয়ারম্যানদের ভাগ বাটোয়ারা দেওয়ার পর তার ৩০০ টাকা থাকে। আইনজীবি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তুমি গরু চুরি ছেড়ে দিয়ে অন্য কাজ করে খাও। বিবাদী বলেছিল, ‘উপায় নেই।’ কোথাও চুরি হলেই থানা পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে। আমি চুরি করিনি বলে, থানা পুলিশকে চাঁদা দিতে পারিনি। চাঁদা দিইনি বলেই আমি আজ গরু চোর হয়েছি, গ্রেফতার হয়েছি, জেলহাজতে ঢুকেছি। যদি চুরি করতাম, চাঁদাও দিতে পারতাম। তবে আর আমাকে হাজতে আসতে হতো না। এখন বুঝুন, আমরা কোথায় আছি কীভাবে আছি?

পাঠকদের ধৈর্যচ্যুতি না ঘটিয়ে মূল আলোচনায় যাচ্ছি। দুর্গম পাহাড়ে পণ্য বহনের জন্য ঘোড়ার গাড়ি কিংবা ঘোড়াকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই ঘোড়া যাতে ক্লান্ত এবং দুর্বল হয়ে না পড়ে এবং ঘোড়ার ৮০ বছরের সব শক্তি চুষে টেনে ২০ বছরের মধ্যে এনে এই ঘোড়ার কৃত্রিম শক্তি বৃদ্ধির জন্য আবিষ্কার ‘ইয়াবা’ নামক মরণ ট্যাবলেট। এই ট্যাবলেট উৎপত্তিস্থল মিয়ানমার। যে ট্যাবলেট এখন বাংলাদেশে গ্রাম-গঞ্জে শহর-বন্দরে সহজলভ্য পণ্য হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে। কৌতূহলী যুবসমাজ এই ইয়াবা সেবনে আসক্ত হয়ে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। ফেনসিডিল নামক তরল মেডিসিনটি সর্দি-কাশির সিরাপ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। যে সিরাপটি, অতি মাত্রায় সেবন করলেই সেবনকারী মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। আজ থেকে ২০ বছর আগেও এই মরণ নেশা ইয়াবা ট্যাবলেট ছিল না। উৎপাদন ছিল ভারতে। বাংলাদেশের পশ্চিম, উত্তর এবং পূর্ব সীমান্ত হয়ে অবাধে ফেনসিডিল চোরাই পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। ইয়াবা উৎপাদনকারী দেশ মিয়ানমার সরকার বৈদেশিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ইয়াবা পাচার শুরু করে। ওই দেশের টার্গেট ভারত, বাংলাদেশ এবং থাইল্যান্ড। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের অর্থাৎ সমুদ্রসীমান্ত অরক্ষিত থাকায় ইয়াবা সহজেই বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। ইয়াবার ট্রানজিট পথ বাংলাদেশ ব্যবহার হওয়ায় দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অল্প টাকার পুঁজিতে, অতি দ্রুত কোটিপতি হওয়ার লোভে ইয়াবা-ফেনসিডিল ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে ৭৭ লাখ মানুষ মাদকের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে মাদকের ৫০ হাজার গডফাদার নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে। মদ, আফিম, ভাং, গাঁজা, প্যাথোডিনের মতো মাদক পূর্বেও দেশে ছিল। সম্প্রতি ইয়াবা এবং ফেনসিডিলের মতো মরণনেশা, দেশের যুবসমাজে সৌখিন নেশায় পরিণত হয়েছে। সমাজ রাষ্ট্র এই নেশার রাজ্যে তলিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি র‌্যাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধান অতিথির বক্তব্য প্রদানকালে মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে যাওয়ার ইঙ্গিত দেন। তার বক্তব্যের পরই গত ৪ মে থেকে র‌্যাব, ১৮ মে থেকে পুলিশ মাদকবিরোধী অভিযানে নামে। গত ১৫ মে থেকে ০৩ জুন পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় ১৩০ জন ব্যক্তি মাদকবিরোধী অভিযানে নিহত হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার, মামলা হয়েছে ৮ হাজারের মতো। এই অভিযানে প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনমানুষ অত্যন্ত খুশি। তবে মানবাধিকার কর্মীরা এ ধরনের হত্যা মেনে নিতে পারছেন না। কারণ, ‘আত্মপক্ষ সমর্থনপূর্বক লাখ লাখ অপরাধী বেঁচে গেলেও যেমন বিচারের ব্যত্যয় ঘটে না, তেমনি কোন অপরাধী বিনা বিচারে সাজা হোক এমনটা মানবতায় সমর্থন করে না, বেঁচে থাকার অধিকার সবারই রয়েছে।’

মাদকবিরোধী শক্ত অবস্থানে শুধু কি বাংলাদেশ সরকারই ? না, এর আগেই ১৯৭১ সালের ১৮ জুন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে মাদকবিরোধী যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ওই ঘোষণায় তৎকালীন মাদকনির্ভর কলম্বিয়া, ব্রাজিল, মার্কিন সীমান্তবর্তী মেক্সিকোসহ পুরো দক্ষিণ আমেরিকায় মাদকাসক্ত চার লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। এর মধ্যে কলম্বিয়ায় মারা যায় প্রায় ৬০ হাজার মাদাকসক্ত। মাদকের ভয়াবহ ছোবল যখন ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডের যুব সমাজ ধ্বংসের চরমপ্রান্তে অবতীর্ণ হয়েছিল। ঠিক ওইসময় অর্থাৎ ২০১৬ সালের ১ জুলাই ফিলিপাইন প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতের্তে মাদকবিরোধী যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এই ঘোষণায় ওই দেশে ২০১৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মারা যায় প্রায় চার হাজার; আত্মসমর্র্পন করে ১৩ লাখ। থাইল্যান্ডে মারা যায় ১০ হাজার। বলতে চাচ্ছি না, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের মাদক অপরাধীদের মেরে ফেলা হোক। হত্যা-খুনের মধ্যে দিয়ে নয়, অন্য কোনো উপায় অবলম্বন করা যায় কি না, সেটা ভাবা দরকার। বাংলাদেশের মাদকবিরোধী অভিযানে কিছু বিষয়ে আরো কিছু সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমত যারা মাদক ব্যবসায় জড়িত হওয়ায় মামলায় জড়িয়ে পড়েছে, তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা। দ্বিতীয় অভিযান পরিচালনাকারীরা মাদকের গডফাদারদের কাছ থেকে ঘুষবাণিজ্য করে, সেবনকারীদের মেরে ফেলছে কি না, তা খতিয়ে দেখা। তৃতীয়ত, সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গ্রেফতার ঘুষবাণিজ্য হিসাবে ফায়দা নিচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা। চতুর্থত, মাদকবিরোধী র‌্যাবের অভিযান শুরু হলো ৪ মে, পুলিশ বাহিনী অভিযান শুরু করল ১৮ মে। এখনো অভিযানে নামেনি সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি। এ ক্ষেত্রে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবির যৌথ এবং পরিকল্পিত সাঁড়াশি অভিযান সরকার চালাতে পারে। লেখাটি তৈয়ার করার পূর্বে ছোট-খাটো একজন মাদকব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছি, মাদক ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে অন্য ব্যবসা কেন করছেন না? এমন প্রশ্নের জবাবে, আমার আজকের লেখাটি প্রারম্ভিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে। আমরা বিশ্বাস করি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পারবে দেশ মাদকমুক্ত করতে। তবে এ ক্ষেত্রে দেশের সর্বস্তরের জনমানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। মনে রাখতে হবে একদিকে ক্রসফায়ার, অন্যদিকে ঘুষের দর কষাকষিতে এই অভিযানের সফলতা আনা সম্ভব নয়। অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে অপরাধীর তিন ধরনের সাজা নিশ্চিত করা দরকার। ক. অর্থনৈতিক খ. মানসিক গ. শারীরিক। তাই বলে এই নয়, জটিল পরিস্থিতে অঢেল কিছু পাওয়ার প্রতিযোগিতা। গত ২৯ মে অনিবার্য কারণে হাইকোর্টে গিয়েছিলাম। উকিলের চেম্বারে অপেক্ষা করছি। কক্ষে ফিরবেন কোর্ট শেষে বিকেল পৌনে ৪ টায়। উকিলদের বিশাল একটি বহর তাদের কক্ষে প্রবেশ করলেন। চেয়ারে বসেই সিনিয়র আইনজীবি এক বাদীকে বুঝাচ্ছেন। বিচারক নাকি তাদেরকে বলে দিয়েছেন, একটি ট্যাবলেট পাওয়া গেলেও ৬ মাসের মধ্যে কোনো কথা শুনবেন না। কৌতূহলবশত জানতে চাইলাম, বিষয়টি কী? জানলাম ৫ গ্রাম হিরোইনসহ ষাটোর্ধ্ব বাদীর এক আপনজন ধরা পড়েছে। তাকে জামিন করার জন্য তিনি হাইকোর্টে এসেছেন। মহামান্য হাইকোর্ট সোজা জবাব দিয়েছেন, জামিন দেননি। মাদকের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী, মাদকের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালত, মাদকের বিরুদ্ধে জনমানুষ এরপরও কেন মাদক নির্মূল হবে না? এই প্রশ্নের অন্তরালে ওই গল্পটিÑ এক চালাক শিয়াল কুমিরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল। শিয়াল বন্ধু কুমীরের আস্তানায় বেড়াতে গিয়ে দেখতে পেল, তার আস্তানায় কঁচি কঁচি অনেক কুমিরছানা। সে আর লোভ সামলাতে পারল না। কুমিরকে শিয়াল বলল, বন্ধু তোমার সন্তনাদের কেন লেখাপড়া শিখাচ্ছ না? কুমির বলল, কোথায় শেখাব? শিয়াল বলল, আমার আস্তানায় তো পাঠশালা রয়েছে, সেখানে পাঠাও। কুমির রাজি হলো। সহজ-সরল কুমির, তার সব সন্তানদের শিয়ালের পাঠশালায় পাঠাল। শিয়াল সুযোগ বুঝে যা করার তাই করল। শেষমেষ কুমির বুঝতে পারল, তার সঙ্গে শিয়াল প্রতারণা করেছে। তার সন্তানদের খেয়ে

ফেলেছে। ক্ষুব্ধ কুমির সুযোগ খুঁজছে, কবে তাকে পাকড়াও করা যায়। একদিন সমুদ্রতীরে শিয়াল আহার খুঁজতে গেলে, কুমির শিয়ালের একটি ঠ্যাং কামড়ে ধরল, শিয়াল বুঝতে পেরে বলছে, একি করছো তুমি। তুমি তো ঠ্যাং রেখে আমার লাঠি ধরেছ। এমনটি বলামাত্র কুমির যেই না ঠ্যাং ছেড়ে দিল, শিয়াল দিল ভোদৌড়।

সরকার যখন দেশের সাধারণ জনগণ রক্ষার্থে প্রশংসনীয় অভিযান চালাচ্ছে, ঠিক ওই মুহূর্তে কোনো শিয়াল-কুমিরের নাটক চলুক, এটা জাতি আশা করে না।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist