সতীর্থ রহমান

  ১০ জুন, ২০১৮

বৃক্ষরোপণ

সুস্থ পরিবেশে বাঁচার পথ

মানবসভ্যতার চরম উৎকর্ষের যুগে বিশ্বজুড়ে পরিবেশগত বিপর্যয় একটি মারাত্মক সমস্যা। পরিবেশের অবক্ষয় ও দূষণের ফলে সমাজজীবন ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। পৃথিবীর অনেক অঞ্চলের মতো বাংলাদেশেও জলবায়ুর ওপর পরিবেশ দূষণের বিরূপ প্রভাব দৃশ্যমান। পরিবেশ বলতে নিছক কিছু গাছপালা বা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের কথা বোঝায় না, বোঝায় না ধ্বংসপ্রায় উদ্ভিদজগৎ বা বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের উদ্বেগের কথা, এর অর্থ সেই সত্তা, যার ওপর নির্ভর করে আমাদের সমগ্র কৃষিব্যবস্থা ও যন্ত্রশিল্প গড়ে উঠেছে। ‘পরিবেশ বিবেচনাকে’ বাদ দিয়ে উন্নয়ন আদৌ সম্ভব নয়, তবে যদি হয় সেটা হবে ভারসাম্যহীন এবং অপরিপক্ব উন্নয়ন। আশির দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ ও প্রকল্প ব্যবস্থাপকদের মুখে ‘টেকসই উন্নয়ন’ (ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ) কথাটি খুব বেশি শোনা যায়। প্রকল্প ব্যবস্থাপকদের মতে, যদি কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নকাল শেষেও কোনো ধরনের বহিঃপৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই টিকে থাকতে পারে, তবে তাকে বলা হয় টেকসই প্রকল্প এবং এ জাতীয় উন্নয়নের গতিধারাকে বলা হয় টেকসই উন্নয়ন। সম্প্রতি বেশ কিছু গবেষণায় বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে চারটি বিষয়কে বিবেচনায় নিতে হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দারিদ্র্য ও সুশাসন, প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট আপদ থেকে উদ্ভূত দুর্যোগ, মানুষের জীবন ও জীবিকার উপায়। বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোক তাদের অর্থনৈতিক কর্মকা- কৃষি সম্পর্কিত ক্ষেত্রে সম্পাদন করে। এর ফলে পরিবেশের ওপর মারাত্মক চাপ পড়ে এবং ভূমির উর্বরতা হ্রাস, পানি ও বাতাস দূষণ, প্রাকৃতিক বনভূমির ক্ষতি দেখা দিচ্ছে। এ ছাড়া উচ্চ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও ব্যাপক দারিদ্র্য ও পরিবেশের ক্ষতি করে থাকে।

বর্তমানে শহর, নগর ও বন্দরে বস্তিবাসী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী পঁচিশ বছরে নগর ও শহরবাসী জনসংখ্যার হার গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ৬০ শতাংশে। ক্রমাগতভাবে জনসংখ্যা বাড়ার ফলে এ বাড়তি জনসংখ্যাকে জায়গা দিতে গিয়ে শহরে দেখা যাচ্ছে নানা ধরনের পরিবেশগত সমস্যা। হারিয়ে যাচ্ছে সবুজের সমারোহ। অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বায়ুদূষণ ও তাপমাত্রা। শহর ও নগরে বাসযোগ্য পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে সবুজ বৃক্ষকে জায়গা করে দিতে হবে প্রতিটি পরিকল্পনায়। সবুজ নগরী তথা পরিবেশবান্ধব শহর ও বিশ্ব গড়ে তুলতে পারলেই আগামী প্রজন্মের জন্য উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা যাবে। ওজোন স্তর ক্ষয়ের ফলে ভূম-লের উষ্ণতা বৃদ্ধির দরুন পৃথিবীতে বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় দেখা যাচ্ছে। এমনকি মানবসভ্যতাও পুরোপুরি হুমকির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। ওজোন স্তর ক্ষয়ের কারণে যদি অতিবেগুনি রশ্মি ভূপৃষ্ঠে আসে, তবে মানুষের শরীর ঝলসে যাবে এবং অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদকুলের স্বাভাবিকভাবে টিকে থাকা সম্ভব হবে না। ওজোন স্তর যদি মাত্র ১ শতাংশ হ্রাস পায়, তবে পৃথিবীতে অতিবেগুনি রশ্মির পরিমাণ বেড়ে যাবে ২ শতাংশ। ভূপৃষ্ঠে যদি অতিবেগুনি রশ্মি ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, তবে অণুজীবদের জীবনচক্র অর্ধেক হয়ে যেতে পারে। আর যদি ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, তবে গাছপালা আর সালোকসংশ্লেষণ চালাতে পারবে না বলেই বিজ্ঞানীদের ধারণা।

ওজোন স্তর শুধু অতিবেগুনি রশ্মিকে শোষণ করে না, বরং বায়ুম-লের তাপমাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করে। ওজোন স্তরের ক্ষয় ঘটলে অতিবেগুনি রশ্মি এসে বায়ুম-লের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করবে এবং সরাসরি প্রাণী ও উদ্ভিদজগতের ক্ষতি করবে। অতিবেগুনি রশ্মির ফলে মানুষের ক্ষতি হবে সবচেয়ে ভয়াবহ। এর প্রভাবে ত্বকে ক্যানসার হতে পারে। রোগ প্রতিরোধ শক্তি হ্রাস পেতে পারে, ফুসফুসে নানা ক্ষতিকর উপসর্গ দেখা দিতে পারে। চোখে ছানি পড়তে পারে, অতিবেগুনি রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে উদ্ভিদ এবং ফসলাদিও মুক্ত নয়। সয়াবিন, শিম, বরবটি, বাদাম, তরমুজ, বাঁধাকপি গোত্রের সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ ছাড়া উদ্ভিদের বৃদ্ধি ব্যাহত, বীজের উৎকর্ষ নষ্ট, পাতা ছোট, ফসলে রোগ ও পোকা-মাকড়ের আক্রমণ বৃদ্ধি পেতে পারে। অতিবেগুনি রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সমুদ্র ও সামুদ্রিক প্রাণীও নিরাপদ নয়। এতে সামুদ্রিক ক্ষুদ্র প্রাণী তথা উদ্ভিদ প্লাংকটনের উৎপাদন ব্যাহত হয়ে খাদ্যচক্রের বিপ্লব ঘটাতে পারে। মাছের চোখও অন্ধ হয়ে যেতে পারে। প্যাটাগোনিয়া অঞ্চলে বর্তমানে অনেক অন্ধ স্যামন মাছ ধরা পড়ছে। প্যাটাগোনিয়ার সাভানা তৃণভূমিতে প্রচুর অন্ধ খরগোশ দেখা যায়।

পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ফলে মেরু এলাকার বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ বৃদ্ধির ফলে ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের সমুদ্রতীরবর্তী নিম্নাঞ্চলও তলিয়ে যেতে পারে। উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে বৃষ্টিপাত, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, সাইক্লোন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাবে। গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, ১৯৬১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ৪০ বছরে এ দেশে প্রতি বছর গড়ে ০.০০৭২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এর প্রায় অর্ধেক তাপমাত্রা বেড়েছে শেষ ১০ বছরে। অন্যদিকে ১৯৬১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়লেও ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুম-লে তাপমাত্রা দিন দিন বৃদ্ধির কারণে উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের ওপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া বিস্তার করছে। এদিকে গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাবে পৃথিবী ক্রমাগত উষ্ণ হচ্ছে। মানবজাতির নির্গত মোট গ্রিনহাউস গ্যাসের শতকরা ২৫ ভাগের জন্য গ্রীষ্মম-লীয় বৃক্ষনিধন দায়ী। গ্রিনহাউস গ্যাসের শতকরা ৯০ ভাগের জন্য দায়ী এই বন উজাড়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বৃক্ষায়ন। বায়ুম-ল থেকে কার্বন গ্রহণের মাধ্যমে বৃক্ষ মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস হ্রাস করে তার প্রভাব থেকে ভূম-লকে রক্ষা করতে পারে। পৃথিবীর নির্গত তাবৎ কার্বনের সবচেয়ে বড় অংশ আনুপাতিক শতকরা ৬০ ভাগ ধারণ করতে পারে বনের পরিবেশ এবং এর অভাবে পৃথিবী থেকে বার্ষিক শতকরা ৯০ ভাগ কার্বন বায়ুম-লে নিঃসরিত হয়। অতএব বিদ্যমান প্রাকৃতিক বনগুলোকে সংরক্ষণ করা এবং ব্যাপক হারে বনায়ন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

পৃথিবীকে লালনপালন করার একটা চমৎকার পদ্ধতি হলো বনায়ন। এটা আমাদের দেশকে আরো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করবে। ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণে বৃক্ষরোপণের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি পবিত্র মক্কা ও মদিনা নগরীর একটি বিশেষ অঞ্চলকে সংরক্ষিত এলাকা বলে ঘোষণা করেন। এসব এলাকার গাছপালা কাটা এবং সেখানে বন্য পশুপাখি শিকার করা আজও নিষিদ্ধ। রাসুলে করিম (সা.) জনগণকে পরিবেশ সংরক্ষণে বৃক্ষরোপণ ও বনায়নে বিশেষভাবে উৎসাহ জুগিয়েছেন। তিনি নিজ হাতে বৃক্ষরোপণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও গাছের পরিচর্যা করেছেন। বৃক্ষরোপণের প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ করে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যদি তোমরা মনে করো যে, কেয়ামত এসে গেছে আর দেরি নয়, যদি হাতের কাছে গাছের একটি চারাও থাকে, সেই চারাটি রোপণ করে ফেলবে।’ বিশ্বের পরিবেশ রক্ষায় রাসুলের এই বাণী মর্মকথা উপলব্ধি করে পথ চলাই হোক আমাদের লক্ষ্য।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist