মো. কায়ছার আলী

  ০৯ জুন, ২০১৮

পর্যালোচনা

প্রাকৃতিক রসগোল্লা লিচু

হামরা দিনাজপুরিয়ারা এই লিচুকে ভালোবেসে বলি প্রাকৃতিক রসগোল্লা। স্বাদ আর বর্ণের জন্য দিনাজপুরের লিচুর ব্যাপক চাহিদা। এমনকি নিকট প্রতিবেশী দেশগুলো থেকেও ক্রেতারা আসেন দিনাজপুরের লিচুর বাজারে। বাংলাদেশের লিচু বলতে দিনাজপুরের লিচু অতুলনীয়। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠÑএই দুই মাস গরমকাল। ঋতুচক্রে গরমকাল হলেও ফলের বিবেচনায় এ মাসকে বলা হয় ‘মধু ঋতু’। জ্যৈষ্ঠ মাস হলো মধু মাস। মধু মাসে কত ফলই না ফলে গাঁয়ের এ বাগানে, ও বাগানে, এ বাড়িতে, ও বাড়িতে। গ্রীষ্মের গরম উপেক্ষা করে লিচু হাতে পেলে মানুষ ভুলে যায় অসহ্য গরমের যন্ত্রণা। লিচু পুষ্টি এবং স্বাদে এত মজা যার তুলনা অন্য কোনো ফলের সঙ্গে করা যায় না। কেননা বিভিন্ন ফলের স্বাদ ও পুষ্টিগুণ এবং এর ভেষজ মূল্য এক এক রকম।

এক এক জেলা এক এক ফলের জন্য বিখ্যাত, যা মাটির ওপর নির্ভর করে। মাটি হলো পৃথিবীর উপরিভাগের একটি আস্তরণ, যা প্রাণী ও উদ্ভিদের পুষ্টি জোগায় ও বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। এ মাটির উৎপত্তি হয়েছে টারশিয়ারি যুগের শিলা, প্লাইস্টোসিন যুগের সোপান এবং সাম্প্রতিককালের পলল থেকে। জেলা শহরের চারদিকে বিশেষ করে দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশে গ্রামগুলোয় ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন শস্যের চাষাবাদের সুসমতল কৃষি শ্যামল উর্বর বিস্তৃত কৃষিক্ষেত্র। জনপদ মাত্রই কিছু কিছু অর্থনৈতিক সম্পদ ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রভূমি। সুন্দর প্রাকৃতিক শোভায় এ জেলা অতি মনোমুগ্ধকর। কিন্তু সে সৌন্দর্য বৈচিত্র্যহীন ও অবিচ্ছিন্ন। কারণ এ জেলায় কোনো পাহাড়-পর্বত, মরু প্রাপ্তর, হৃদ বা বৃহৎ জলাভূমি নেই। তবে এ জেলায় রয়েছে মাটির সমতল বুক চিরে প্রবাহিত অনেক চঞ্চল গতি ক্ষীণকায় নদী। বস্তুত নির্জন নিবিড় বনময় মুগ্ধ প্রকৃতির কোলে অবস্থিত মাধববাটি বা মাশিমপুর বরাবরই একটি স্বনামধন্য গ্রাম। স্বর্গীয় সম্পদে বৈশিষ্ট্যে ভরপুর এ গ্রামের মানুষরা হাজার হাজার একর জমি লিচু আবাদ করে দেশবাসীকে এক মায়ার জালে বেঁধে ফেলেছে। এ গ্রামের লিচুচাষিরা তাদের যোগ্যতা ও মেধার বিকাশ ঘটিয়েছে। জাতীয় ফল কাঁঠাল, ফলের রাজা আম অবশ্যই পুষ্টিকর ও উপাদেয় ফল। লিচু সম্পর্কে লিখতে গেলে মনের অজান্তে কেন জানি লিখতে ইচ্ছে করে লিচু হলো ফলের রানি। জানি না তা বলা ঠিক হবে কি না? তবে এটা আমার ব্যক্তিগত মত। মতান্তর থাকতে পারে। লিচু হলো বিশ্বের সবচেয়ে রোমান্টিক এবং উপকারী ফল।

প্রায় দুই হাজার বছর থেকে এ ফলটি এ মর্যাদা পেয়ে আসছে। বিশ্বে প্রথম ফল চাষের বই লেখা হয়েছিল ১০৫৬ সালে, সেটিও ছিল লিচুকে নিয়ে। বিশ্বে অনেক রাজা-বাদশাহ রানি-বেগমদের মন জয় করতে যুগে যুগে লিচু ফল উপহার দিয়েছেন। অষ্টম শতকে চীনা স¤্রাট হুয়ান সাংও একই কাজ করে বেগমের মন জয় করেছিলেন। দক্ষিণ চীন থেকে লিচু বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সুদূর উত্তর চীনে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে লিচুর চাষাবাদ শুরু। লিচুর আছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। তা ব্রেস্ট ক্যানসার নিরাময়ে সহায়তা করে থাকে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হার্ট ভালো রাখে। এতে পাওয়া যায় অলিগনাল নামক বিশেষ উপাদান। তা নাইট্রিক অ্যাসিড উৎপাদন করে। এ অ্যাসিড ঠধংড়ফরধষধঃড়ৎ-এর কাজ করে। মানে, ব্লাড ভেসেল এক্সপান্ড করে দেয়। ফলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে। লিচু শরীরের রক্তচাপও ঠিক রাখে। হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটাতে লিচু দারুণ দারুণ কাজ করে। চোখে সহজেই ছানি পড়তে দেয় না লিচুতে থাকা ফাইটো কেমিক্যাল থেকে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এতে থাকা অ্যান্টি নিওপ্লাসমিক প্রপার্টি তৈরি হয় বলে কোস বিভাজন নিয়ন্ত্রণে রাখে। ফলে চোখে ছানি পড়ে না। ইনফ্লুয়েঞ্জা হওয়ার প্রধান কারণ হলো বিভিন্ন ভাইরাস। দেখা গেছে, ইনফু¬য়েঞ্জা হলে লিচু খেলে তা দ্রুত সেরে যায়। শুধু তা-ই নয়, লিচু থেকে এ অসুখের ওষুধ তৈরি করা যায় কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। প্রতি ১০০ গ্রাম লিচুতে আছে ৬৬ ক্যালরি। এ ছাড়া আছে ফাইবার। তা চর্বি গলাতে সাহায্য করে। তাই যারা ওজন কমাতে চান, তারা ডায়েটে অবশ্যই লিচু রাখুন। লিচুতে আছে পর্যাপ্ত ভিটামিন ‘সি’। ফলে আমাদের শরীরে ইমিউনিটি বাড়াতে সাহায্য করে।

বিজ্ঞানীরা নানা জাতের লিচু উদ্ভাবন করেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণা দ্বারা তিনটি জাতের লিচু উদ্ভাবন করেছেন। এ দেশে যেসব জাতের লিচু পাওয়া যায় সেগুলো হলো বোম্বাই, মাদ্রাজি, চায়না-৩, মঙ্গলবাড়ি, মোজাফ্ফরপুরী, বেদানা লিচু, বারি লিচু-১, বারি লিচু-২, বারি লিচু-৩। এই জাতের গাছে প্রতি বছরই ভালো ফল ধরে। বেদানা নাবি জাত। বারি লিচু-১ আগাম জাত, বারি লিচু-৩ মৌসুমি জাত, কিন্তু বারি লিচু-২ নাবি জাত। লিচু লাগানোর জন্য এসব জাত থেকে যেকোনো জাত নির্বাচন করা যেতে পারে। সাধারণত লিচু গাছে তিন থেকে ছয় বছর পর ফল ধরে। তবে বিশ-ত্রিশ বছর পর্যন্ত লিচু গাছে ফলন বাড়তে থাকে। সাধারণত প্রতিটি গাছ থেকে বছরে ৮০-১৫০ কেজি বা ৩২০০-৬০০০টি লিচু পাওয়া যায়। অবস্থাভেদে এর তারতম্য লক্ষ করা যায়। কিন্তু বীজ থেকে উৎপাদিত গাছে ফল ধরতে ৭-১২ বছর সময় লাগে। এ জন্য বীজ থেকে সাধারণত চারা উৎপাদন করা হয় না। চারা উৎপাদনের জন্য গুটিকলম লিচুর ক্ষেত্রে সর্বাধিক উপযোগী। তবে এ পদ্ধতি ছাড়া জোড় কলম, কুঁড়ি সংযোজন, ছেদ কলম প্রভৃতির মাধ্যমে সবভাবে চারা উৎপাদন করা যায়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নভাবে জমি তৈরি করে জমি সমান করতে হবে। মে-জুন মাসে জমি তৈরি করা ভালো। জমিতে বর্গাকার বা ষড়ভোজী রোপণ প্রণালি অনুসরণ করে ১০ মিটার দূরে দূরে ১ মিটার ১ মিটার আকারের গর্ত খনন করতে হয়। গর্ত করার পর গর্তের ওপরের মাটির সঙ্গে গর্তপ্রতি ২০-২৫ কেজি জৈব সার ২ কেজি হারের গুঁড়ো বা ৫ কেজি কাঠের ছাই মিশিয়ে গর্ত ভরে দিতে হবে। তারপর তাতে পানি দিয়ে কিছুদিন রেখে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসের দিকে গর্তের মাটির সঙ্গে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও এমওপি মিশিয়ে গর্তের মাঝখানে লিচুর চারা বা গুটিকলম লাগাতে হবে। লাগানোর পরপরই পানিসেচ দিতে হবে। প্রয়োজনবোধে কিছু পাতা ছাঁটাই করা ভালো। প্রতি বছর তিনবার সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছে যদি তামাটে রং ধারণ করে, তবে প্রতি বছর ৫০০ লিটার পানির সঙ্গে দুই কেজি চুন ও জিঙ্ক সালফেট গুলে বসন্তকালে গাছে ছিটাতে হবে। এর ফলে ফল ঝরা কমে যাবে। ভরাট করার সময় জমির লেভেল থেকে কমপক্ষে ১৫-২০ সেমি উঁচু ঢিবির মতো করতে হয়। ঢিবির মধ্যখানে হাত দিয়ে বা নিড়ানি দিয়ে গুটিকলমের মাটির পাত্র বা পলিব্যাগের আকারে ছোট গর্ত করে তাতে লিচুর গুটি কলমের মাটির বলটি বসিয়ে চারদিকে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। কলমটি যাতে বাতাসে হেলে না পড়ে। সে জন্য কলমগাছের গোড়া থেকে ১০-১৫ সেমি দূরে একটি খুঁটি পুঁতে খুঁটিতে হেলিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে দিতে হয়। কিছু পানি গাছের পাতায় ছিটিয়ে দিয়ে গাছটি গরু-ছাগল থেকে রক্ষার জন্য বেঁধে দিতে হয়। লিচু চাষের সনাতন পদ্ধতি থেকে চাষিরা আজ আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে শুরু করেছেন। বর্তমানে ইশ্বরদীতে আম-লিচুতে কীটনাশকের পরিবর্তে চার্জওয়াটার নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করে বিষমুক্ত ফল উৎপাদনে চাষিরা ফল ভালো করেছেন। জার্মানি থেকে আমদানি করা এই প্রযুক্তি বাংলাদেশে এ বছরই প্রথম পরীক্ষামূলক ব্যবহার করা হয়। আর তাতে সফলতা আসায় নতুন এ প্রযুক্তি নিয়ে আগ্রহ বেড়েছে কৃষকদের মঝেধ্য। কৃষিবিদরা বলেছেন, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করলে একদিকে যেমন উৎপাদন খরচ কমবে, তেমনি কীটনাশকমুক্ত সবজি ও ফল উৎপাদনে এ প্রযুক্তি সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন স্থানীয় কৃষক ও কর্মকতারা।

লাভজনক বা অর্থকরী ফল প্রাকৃতিক রসগোল্লা লিচু আমাদের দিনাজপুরের গর্ব ও অহঙ্কার। তাই এর যথাযথ আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতির ব্যবহার আরো বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে লিচুচাষিদের উন্নত মানের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ কোর্স সরকারিভাবে দেওয়া যেতে পারে। সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় লিচু সংরক্ষণের জন্য আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার আজ জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সূত্র মতে, ২০১৩ সালে বৈশ্বিক পরিসংখ্যানে বিশ্বে ফল উৎপাদনে বৃদ্ধির হার এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। ২০১৪-১৫ সালে এ দেশে প্রায় এক কোটি টন ফল উৎপাদিত হয়েছে। বিশ্বে মোট ফল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান আঠাশতম। এটা তো কম সুখের কথা নয়। বিশ্বে বাংলাদেশ আম উৎপাদনে সপ্তম ও পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে উঠে এসেছে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দিনাজপুরের লিচু এ দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist